'ভুল ছকে' ডেঙ্গু রোধের চেষ্টা
প্রকাশ | ৩০ মে ২০২৩, ০০:০০
সাখাওয়াত হোসেন
সারা দেশে এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। যা আগামীতে আরও কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অথচ বরাবরের মতো 'ভুল ছকে' ডেঙ্গু প্রতিরোধে চেষ্টা চলছে। এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের প্রস্তুতিও বিগত সময়ের মতো ঢিলেঢালা। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসার জন্য সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলো এখনও সেভাবে প্রস্তুত করা হয়নি। ফলে দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ মহামারিতে রূপ নিলে মৃতু্যর মিছিল দীর্ঘ হবে বলে আশঙ্কা করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
কীটতত্ত্ববিদ এবং বিশেষজ্ঞদের ধারণা, অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে এ বছর ডেঙ্গু ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। এতে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বিগত সময়ের সর্বোচ্চ পরিসংখ্যান ছাড়িয়ে যেতে পারে। অথচ এ আশঙ্কা দিনে দিনে জোরালো হলেও ডেঙ্গু ডেডিকেটেড হাসপাতাল তৈরির প্রস্তুতি জোরেশোরে নেওয়া হচ্ছে না। বরং গতানুগতিক ব্যবস্থাপনাতেই মশক নিধনসহ সব ধরনের কার্যক্রম মোকাবিলা করতে চাচ্ছে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে আগামী ১৫ জুন থেকে ৪ মাসব্যাপী ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা এবং আগামী ১৫ জুলাই থেকে ৩ মাসব্যাপী কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ প্রতিষ্ঠা করবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। আর এডিসের লার্ভা পেলে জরিমানা করাসহ নগরবাসীর মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করবে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনও (ডিএনসিসি) এডিস মশা দমনে জনসচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি লার্ভিসাইডে জোর দিচ্ছে। বর্ষা মৌসুমে এডিসের বংশবিস্তার নিয়ন্ত্রণে, মশক নিধন কার্যক্রমে উত্তর সিটির সঙ্গে বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর (বিএনসিসি) ও জাতীয় স্কাউট দল যুক্ত হয়েছে। তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে মশক নিধন কার্যক্রম- জনসচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করবে।
যদিও এসব কার্যক্রম বিগত সময়ের মতোই গতানুগতিক ও দায়সারা বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগ) অধ্যাপক ডাক্তার বে-নজির আহমেদ বলেন, আবহাওয়ার যে ধরন সে অনুযায়ী এখন ডেঙ্গুর সংক্রমণ দ্রম্নত হারে বেড়ে যাবে। সঠিকভাবে এডিস মশা দমন করতে না পারলে ডেঙ্গুতে সংক্রমণ ও মৃতু্য কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে আমরা বলতে পারি না। বিগত বছরগুলোর সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যেতে পারে।
এ বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, আমরা ভুল পথে মশা মারতে চাচ্ছি। আমরা বিষয়টি ভুল জেনেও এর থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করছি না। আমরা অনেক রোগ নির্মূল করতে পেরেছি। কিন্তু গত ২৩ বছরে ডেঙ্গু নির্মূল তো দূরের কথা, নিয়ন্ত্রণই করতে পারিনি। এজন্য আমাদের পর্যাপ্ত কীটতত্ত্ববিদ দরকার এবং এর ওপর গবেষণা দরকার। এজন্য স্থানীয় সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।
তার সঙ্গে সুর মিলিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক, কীটতত্ত্ববিদ ডক্টর কবিরুল বাশার ভুল কৌশলে ডেঙ্গু প্রতিরোধের চেষ্টার কথা তুলে ধরে বলেন, 'আমরা আগেই থেকেই বলে আসছি এ দেশে সমন্বিত বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যবস্থা প্রয়োগ না করলে মশা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। যা উত্তরের মেয়র যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে বুঝতে পেরেছেন। আমরা চারটি বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়ার জন্য বলে আসছি। সেগুলো হলো-
\হপরিবেশগত নিয়ন্ত্রণ, বায়োলজিক্যাল কন্ট্রোল, কেমিক্যাল বা কীটনাশক কন্ট্রোল এবং কমিউনিটি পার্টিসিপেশন। কিন্তু বাংলাদেশে কীটনাশক প্রয়োগকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে ফগিং অন্যতম। কিন্তু বেশির ভাগ ফগিং ভালো ফলাফল দেয় না। এ ক্ষেত্রে আমরা লার্ভিসাইডিংকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেছি। এর পাশাপাশি বাকি তিনটি বিষয়কেও সমানভাবে গুরুত্ব দিয়ে মশা দমনে ভূমিকা নিলে মশা দমন হবে। এছাড়া কীটনাশক প্রয়োগে কার্যকারিতা নিয়েও পরীক্ষার দরকার রয়েছে। আমাদের সিটি করপোরেশনগুলোর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সম্পৃক্ততা নেই; যা অত্যন্ত জরুরি।
কীটতত্ত্ববিদরা জানান, বাংলাদেশে ১২৩ প্রজাতির মশা রয়েছে। ঢাকায় ১২ থেকে ১৪ প্রজাতির মশা পাওয়া গেছে। মশা সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে মশার প্রজাতি ও আচরণভেদে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আলাদা হতে হবে। মশাকে সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে প্রয়োজন সমন্বিত ব্যবস্থাপনার।
সমন্বিত ব্যবস্থাপনার চারটি অংশ রয়েছে। প্রথমত, মশার প্রজননস্থল কমানো এবং ধ্বংস করে পরিবেশগত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সহজভাবে মশা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। দ্বিতীয়ত, জীবজ নিয়ন্ত্রণ, অর্থাৎ উপকারী প্রাণীর মাধ্যমে মশাকে নিয়ন্ত্রণ করার বিভিন্ন পদ্ধতি পৃথিবীতে প্রচলিত আছে। তৃতীয়ত, মশা নিয়ন্ত্রণে লার্ভিসাইড এবং অ্যাডাল্টিসাইড কীটনাশক ব্যবহার করা। আর জনগণের সম্পৃক্ততা ছাড়া মশা নিয়ন্ত্রণে সফল হওয়া দুষ্কর। তাই এ প্রক্রিয়ায় জনগণকে সম্পৃক্ত করার জন্য নানা ধরনের উদ্যোগ নেওয়া দরকার। এছাড়া সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে বাস্তবায়নের জন্য অভিজ্ঞ কীটতত্ত্ববিদ দিয়ে আধুনিক এবং সময়োপযোগী গাইডলাইন তৈরি করে নিতে হবে।
মশা নিয়ন্ত্রণের কাজটি সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে আলাদা করে স্বতন্ত্র মশা নিয়ন্ত্রণ বিভাগ করা জরুরি। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের প্রতিটি জোনে একজন করে কীটতত্ত্ববিদের পদ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। যেসব জেলায় কীটতত্ত্ববিদ পদগুলো ফাঁকা রয়েছে, সেসব জেলায় এই পদগুলো পূরণ করে মশা নিয়ন্ত্রণের কাজ জোরদার করা দরকার।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সারা দেশের মশা এবং অন্যান্য বাহক নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি স্বতন্ত্র সেন্টার তৈরি করতে পারে। এই সেন্টার দেশব্যাপী মশা ও অন্যান্য বাহক নিয়ন্ত্রণের অভিভাবক হিসেবে কাজ করবে। এখানে সারা বছর মশা, অন্যান্য বাহক ও কীটনাশক নিয়ে গবেষণা হবে এবং তারাই নির্দেশনা দেবে কখন কোন কীটনাশক কোন বাহকের জন্য ব্যবহৃত হবে। কীটতত্ত্ববিদরা বারবার তাগিদ দিলেও দীর্ঘদিনেও এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বরং গতানুগতিক ভুল পথেই এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা আরও বলেন, ডেঙ্গু এমন একটি সমস্যা, যেটিকে সরকার বা সিটি করপোরেশন একা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। পৃথিবীর কোনো দেশেই জনগণের সম্পৃক্ততা ছাড়া ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সাফল্য আসেনি। নাগরিকদের সম্পৃক্ততা ছাড়া মশা নিয়ন্ত্রণ কখনোই সম্ভব নয়। মশা নিয়ন্ত্রণে নাগরিকদের সম্পৃক্ত করার জন্য পৃথিবীতে বিভিন্ন দেশে আইন রয়েছে। সে রকম একটি আইন বাংলাদেশে তৈরি করা এবং সেটি বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। অথচ দীর্ঘদিনেও সরকার এ পথে হাঁটেনি।
এদিকে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম গত ২৪ মে সাংবাদিকদের জানান, ডেঙ্গু মোকাবিলায় সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। তার মন্ত্রণালয় সতর্কতার সঙ্গে এবার আগে থেকেই ব্যবস্থা নিয়েছে। যদিও সে প্রস্তুতির বিষয়ে তিনি বিস্তারিত কিছু জানাতে পারেননি। তবে গত বছর সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও ফিলিপাইনের চেয়ে বাংলাদেশে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা কম ছিল এ তথ্য উপস্থাপন করে আত্মতুষ্টি প্রকাশ করেন মন্ত্রী।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস ডেঙ্গু প্রতিরোধের প্রস্তুতি প্রসঙ্গে জানিয়েছেন, তারা অগ্রিম আরও হুইলব্যারো, ফগার ও লার্ভি সাইডিং মেশিন আমদানি করছেন। এছাড়া অভিযান চালাতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের সংখ্যা আরও বাড়ানোর কথা জানান তিনি। তার যুক্তি ডেঙ্গু প্রতিরোধে সফল দেশগুলো বেশি বেশি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেছে, জরিমানা করেছে। আষাঢ়-শ্রাবণ ও ভাদ্র-আশ্বিন- এ ৪ মাসে ঠিকমতো ১০ জন করে ম্যাজিস্ট্রেট পেলে সাফল্যের ব্যাপারে দৃঢ় আশাবাদী তিনি।
এদিকে ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসা ব্যবস্থাতেও যে এখনও আশানুরূপ পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি, তা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগী ও তাদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে স্পষ্ট চিত্র পাওয়া গেছে। তারা জানান, ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসা ব্যয় অনেক বেশি। বিশেষ করে বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে যারা ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন, তাদের চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে রীতিমতো নাভিশ্বাস উঠছে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক গবেষণার তথ্য বলছে, দেশে ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসা বেশ ব্যয়বহুল। ফলে নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে। একজন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসায় ব্যয় হচ্ছে গড়ে ৩৩ হাজার ৮১৭ টাকা। তবে সরকারি হাসপাতালগুলোয় এ চিকিৎসায় খরচ করতে হয় ২২ হাজার ৩৭৯ টাকা আর বেসরকারি হাসাপাতালে রোগীপ্রতি গড় খরচ ৪৭ হাজার ২৩০ টাকা।
হাসপাতালগুলো তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী ফি নেয় উলেস্নখ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জনস্বাস্থ্য বিষয়ক পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, সব হাসপাতালে রোগীদের খরচ এক নয়। অনেক হাসপাতাল ইচ্ছামতো ফি নেয়। সরকার পরীক্ষার ফি নির্ধারণ করে দিলেও বেশির ভাগ বিষয়ই অনির্ধারিত। এর সুযোগ হাসপাতালগুলো নেয়। তবে কোনো রোগীর অবস্থা সংকটাপন্ন হলে তার চিকিৎসার ব্যয়ও বেড়ে যায়।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসা ব্যয় উদ্বেগজনক দাবি করে দু'টি বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়ার সুপারিশ করেছেন। প্রথমত, ডেঙ্গুর প্রকোপ কমাতে ও খানা পর্যায়ে এর আর্থিক বোঝা লাঘব করতে এ মুহূর্তে একটি কার্যকর জাতীয় ডেঙ্গু প্রতিরোধ কৌশল বাস্তবায়ন করা। পাশাপাশি এডিস মশাকে সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করার জন্য বিভিন্ন এলাকাভিত্তিক সচেতনতামূলক কার্যক্রম জোরদার করা। ডেঙ্গু সংক্রমণের বিরুদ্ধে বিপর্যয়মূলক স্বাস্থ্য ব্যয় মোকাবিলা করার জন্য ঢাকা মহানগরীতে নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর জন্য স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচিসহ বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প চালু করারও সুপারিশ করেন তারা।