বিদায় রাজনীতির 'রহস্য পুরুষ'

প্রকাশ | ১০ জুন ২০২৩, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
সিরাজুল আলম খান :১৯৪১-২০২৩
সিরাজুল আলম খান বাংলাদেশের রাজনীতির 'রহস্য পুরুষ' হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি কখনও জনসম্মুখে আসতেন না এবং বক্তৃতা-বিবৃতিও দিতেন না; আড়ালে থেকে তৎপরতা চালাতেন বলে তার এই পরিচিতি। শেষ ইচ্ছার কথা জানাতে গিয়েও তিনি এক 'রহস্য' রেখে গেছেন। মহিউদ্দিন আহমদের লেখা 'প্রতিনায়ক সিরাজুল আলম খান' বইটিতেই তিনি বলেছেন, 'আমার মৃতু্যর পর কোনো শোকসভা হবে না। শহীদ মিনারে ডিসপেস্ন হবে না লাশ। যত দ্রম্নত সম্ভব নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে আমার গ্রামের বাড়িতে পাঠাতে হবে মরদেহ, যা ঢাকা থাকবে একটা কাঠের কফিনে। মায়ের একটা শাড়ি রেখে দিয়েছি। কফিনটা শাড়িতে মুড়ে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে, মায়ের কবরে।' সেই 'রহস্য পুরুষ' ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক সিরাজুল আলম খান আর নেই। শুক্রবার বেলা আড়াইটায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে তার মৃতু্য হয় (ইন্না লিলস্নাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তার মৃতু্যর বিষয়টি নিশ্চিত করেন হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক। এদিন বিকালে সিরাজুল আলম খানের ছোট ভাইয়ের মেয়ে ব্যারিস্টার ফারাহ খান জানান, শনিবার (আজ) সকাল ১০টায় বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে তার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। সেখান থেকে মরদেহ নেওয়া হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাবির কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে দ্বিতীয় জানাজার পর তার মরদেহ নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার আলীপুর গ্রামের বাড়িতে নেওয়া হবে। সেখানে তৃতীয় জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হবে। এর আগে ৭ মে রাতে শ্বাসকষ্টসহ বার্ধক্যজনিত অসুস্থতা নিয়ে ঢাকার পান্থপথে শমরিতা হাসপাতালে ভর্তি হন সিরাজুল আলম খান। চিকিৎসকদের পরামর্শে ২০ মে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয় এই প্রবীণ রাজনীতিবিদকে। গত ১ জুন তাকে আইসিইউতে রাখা হয়। অবস্থার অবনতি হলে বৃহস্পতিবার (৮ জুন) রাতে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। ১৯৪১ সালে জন্ম নেওয়া এই কিংবদন্তি রাজনীতিককে বিগত কয়েক বছরে নিয়মিত হাসপাতালে যেতে হয়েছে। দেশে এবং বিদেশে দীর্ঘ সময় চিকিৎসা নিয়েছেন তিনি। এদিকে, রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল আলম খানের মৃতু্যতে গভীর শোক প্রকাশ করেন। তিনি এক শোক বার্তায় সিরাজুল আলম খানের রুহের মাগফিরাত কামনা করেন ও তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। অপরদিকে, এক শোকবার্তায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, 'স্বাধীনতা আন্দোলনের সূচনা লগ্নের অন্যতম সংগঠক সিরাজুল আলম খানের মৃতু্যতে আমরা শোকাভিভূত। তিনি আমাদের সত্তার মাঝে অমর হয়ে থাকবেন।' এছাড়া সিরাজুল আলম খানের মৃতু্যতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করে এক শোক বার্তায় জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ (জি এম) কাদের বলেন, 'স্বাধীনতা সংগ্রামে সিরাজুল আলম খানের অবদান অনস্বীকার্য। তিনি আজীবন দেশ ও মানুষের কল্যাণে কাজ করেছেন।' সিরাজুল আলম খান ১৯৪১ সালের ৬ জানুয়ারি নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ থানার আলীপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা খোরশেদ আলম খান ছিলেন স্কুল পরিদর্শক। মা সৈয়দা জাকিয়া খাতুন ছিলেন গৃহিণী। ছয় ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। জন্মের কয়েক বছর পর পিতার চাকরির সুবাদে তিনি খুলনায় চলে যান। ১৯৫৬ সালে খুলনা জিলা স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে এসএসসি পাস করেন। তার পর ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৫৮ সালে এইচএসসি পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগে সম্মান শ্রেণিতে ভর্তি হন। থাকতেন ফজলুল হক হলে। গণিতে স্নাতক ডিগ্রি নেওয়ার পর তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয় 'কনভোকেশন মুভমেন্টে' অংশগ্রহণ করার কারণে। প্রতিদিন রাত করে হলে ফিরতেন। ফলে হল থেকেও একবার বহিষ্কৃত হন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করায় তার পক্ষে মাস্টার্স ডিগ্রি নেওয়া সম্ভব হয়নি। ১৯৬১ সালে ছাত্রলীগের সহ-সাধারণ সম্পাদক হন। ১৯৬৩ সালে সিরাজুল আলম খান ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। জাতীয়তাবাদী চেতনাকে বিকশিত করে বাংলাদেশিদের স্বাধীন জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে '৬২ সালে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে যে নিউক্লিয়াস গড়ে উঠে, তিনিই ছিলেন তার মূল উদ্যোক্তা। এই নিউক্লিয়াসের সদস্য ছিলেন আবদুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদ। তার পর মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত এই নিউক্লিয়াসের মাধ্যমে সব কর্মকান্ড পরিচালনা করেন। ছয় দফার সমর্থনে জনমত গঠনে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন সিরাজুল আলম খান। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বাতিল ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে আন্দোলন ও ঊনসত্তরের গণঅভু্যত্থানে ছাত্র-শ্রমিকদের সম্পৃক্ত করতে প্রধান ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধ শেষে স্বাধীন স্বদেশ ভূমিতে ফিরে এলে আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার বিপস্নবী জাতীয় সরকার গঠন প্রশ্নে মতভেদ দেখা দেয়। গড়ে তোলেন একমাত্র বিরোধী দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরে অনুষ্ঠিত 'অভু্যত্থান' বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসে এক ঘটনা। জাসদ গঠন এবং 'অভু্যত্থান' এর নেপথ্য পরিকল্পনাকারী ছিলেন সিরাজুল আলম খান। আর এই দুটি বৃহৎ ঘটনার নায়ক ছিলেন মেজর জলিল, আ স ম আবদুর রব এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবু তাহের। সিরাজুল আলম খান ভিন্ন ভিন্ন তিন মেয়াদে প্রায় সাত বছর কারাভোগ করেন। কনভোকেশন মুভমেন্টের কারণে ১৯৬৩ সালের শেষ দিকে গ্রেপ্তার হন। ১৯৭৬ সালে জিয়াউর রহমানের আমলে আবার গ্রেপ্তার এবং ১৯৭৯ সালে মুক্তি পান। ১৯৯২ সালে বিদেশ যাওয়ার প্রাক্কালে ঢাকা বিমানবন্দর থেকে ২৪ মার্চ সিরাজুল আলম খানকে গ্রেপ্তার করা হলে চার মাস পর হাইকোর্টের রায়ে মুক্তি পান। সিরাজুল আলম খানের বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রি অঙ্ক শাস্ত্রে হলেও দীর্ঘ জেলজীবনে তিনি দর্শন, সাহিত্য, শিল্পকলা, রাজনীতি-বিজ্ঞান, অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, সমাজবিজ্ঞান, পরিবেশ বিজ্ঞান, সামরিক বিজ্ঞান, মহাকাশ বিজ্ঞান, সংগীত, খেলাধুলা সম্পর্কিত বিষয়ে ব্যাপক পড়াশোনা করেন। ফলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ওপর গড়ে উঠে তার অগাধ পান্ডিত্য ও দক্ষতা। সেই কারণে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক নিযুক্ত হন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন রাজ্যের ওশকোশ বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৯৬-৯৭ সালে। আর্থ-সামাজিক বিশেষণে সিরাজুল আলম খানের তাত্ত্বিক উদ্ভাবন বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়। মার্কসীয় 'দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ'র আলোকে বাংলাদেশের জনগণকে শ্রমজীবী-কর্মজীবী-পেশাজীবী হিসেবে বিভক্ত করে 'রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক' মডেল হাজির করেন সিরাজুল আলম খান। চিরাচরিত পার্লামেন্টারি ধাঁচের 'অঞ্চলভিত্তিক' প্রতিনিধিত্বের পাশাপাশি শ্রম, কর্ম, পেশায় নিয়োজিত সমাজ শক্তিসমূহের 'বিষয়ভিত্তিক' প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা সংবলিত 'দুই কক্ষ' বিশিষ্ট পার্লামেন্ট গঠন, ফেডারেল সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন, বাংলাদেশকে কয়েকটি প্রদেশে ভাগ করে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচন এবং প্রাদেশিক সরকার গঠন, উপজেলা পর্যায়ে স্বশাসিত স্থানীয় সরকার পদ্ধতি চালু করার মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ-পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক আইনব্যবস্থা ও শাসন কাঠামোর পরিবর্তে স্বাধীন দেশের উপযোগী শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলার মডেল উত্থাপন করেন তিনি। সিরাজুল আলম খান দেশে-বিদেশে 'রাজনৈতিক তাত্ত্বিক ব্যক্তিত্ব' হিসেবে পরিচিত। তার দীর্ঘ ৫০ বছরের রাজনৈতিক জীবনে অসংখ্য ছাত্র-যুব নেতার সঙ্গে সুসম্পর্ক রয়েছে তার। ব্যক্তিগত জীবনে সিরাজুল আলম খান অবিবাহিত। জাসদের শোক ও কর্মসূচি: এদিকে, এক শোক বার্তায় জাসদের প্রতিষ্ঠাতা সিরাজুল আলম খানের মৃতু্যতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু এমপি ও সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার এমপি। তারা সিরাজুল আলম খানের প্রতি দলের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, ৬০ দশকে বাঙালি জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম-স্বাধিকার সংগ্রাম, '৬৯ এর ঐতিহাসিক গণঅভু্যত্থান-স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের মাঠে অগ্রণী ও অন্যতম প্রধান চিন্তক ও সংগঠক হিসেবে সিরাজুল আলম খানের ঐতিহাসিক ও কিংবদন্তিতুল্য ভূমিকা ও অবদানের জন্য তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। অন্যদিকে, সিরাজুল আলম খানের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ আজ (শনিবার) দেশব্যাপী শোক পালন করবে। এদিন ভোর ৬টায় জাসদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দলীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ এবং কালো পতাকা উত্তোলন করা হবে।