খোঁপায় গাঁদা পলাশ: নগরে এলো বসন্ত

প্রকাশ | ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০০:০০ | আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১০:২৬

যাযাদি রিপোটর্
রাজধানীতে জাতীয় বসন্ত উদযাপন পরিষদ বুধবার ঢাবির চারুকলার বকুলতলায় আয়োজন করে বসন্ত বরণ উৎসব। এতে অংশ নেন তরুণ-তরুণীসহ সবর্স্তরের মানুষ। ছবিতে লাল টিপ, হলুদ ফুল আর বাসন্তী রঙা শাড়ি আর মাথায় ফুলের মুকুট পরা এক তরুণী Ñফোকাস বাংলা

শীত শেষে এসেছে ঋতুরাজ বসন্ত। ফাগুনের প্রথম দিনে যেন আগুন লেগছে সবার মনে। সব জরা ভেঙে প্রকৃতি নিজেকে রাঙিয়েছে নতুন রঙে। তাই বসন্তবরণে মেতেছেন তরুণ-তরুণীরা। হাতে খোঁপায় হলুদ গাঁদা গায়ে বাসন্তী পাঞ্জাবি-সালোয়ার এবং শাড়ি পরে সেজেছেন অনেক তরুণ-তরুণী। এক মুহূতের্র জন্য যেন তারা সব ব্যস্ততা ভুলে মেতেছেন আনন্দের জোয়ারে। লাল, হলুদ, সবুজ, বেগুনি, কমলা বা সাদা রঙে নিজেদের সাজিয়েছেন বাসন্তী সাজে। এসেছে শিশুরাও মা-বাবার হাত ধরে। একদিন পরে ১৪ ফেব্রæয়ারি ভালোবাসা দিবস। আর ১৩ ফেব্রæয়ারি পহেলা ফাল্গুন। দোয়েল চত্বর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার বকুলতলায় বুধবার সকাল থেকেই তরুণ-তরুণীদের ভিড়। শাহবাগ-টিএসসি সড়কেও এ ভিড় লক্ষ করা গেছে। বয়সের ভেদাভেদ ও মত ভুলে সবাই বসন্তে একাকার হয়েছেন। যেকোনো উৎসবে ফুলের বিশেষ চাহিদা। সেটা ১৩ ফেব্রæয়ারিও। শাহবাগ মোড়ে ফুলের দোকানগুলোতে সকাল থেকে ফুলের বাড়তি চাহিদা দেখা যায়। প্রিয়জনদের হাতে ফুল তুলে দিতে এখানে ভিড় করেন আবার অনেক। নেন পছন্দের ফুল। এ ছাড়া প্রতি বছরের মতো এবারও চাহিদা মাথায় রেখে ব্যাপক পরিমাণ ফুল আগে থেকেই দোকানে তোলেন ব্যবসায়ীরা। এ বছর ফুলের বিক্রি কেমন- প্রশ্নের জবাবে শহবাগের ফুল বিক্রেতা মনোয়ার হোসেন মিন্টু বলেন, ‘তরুণ-তরুণীরা ফুল কিনতে বেশি আগ্রহী। আজ ও কাল ফুলের চাপ থাকবে অনেক বেশি। তা ছাড়া ফুল শৌখিন মানুষরাই কেনেন। সেইসঙ্গে বিভিন্ন দলের সভা-সেমিনারের জন্যও ফুল নিতে আসেন অনেকে।’ ফুলের দাম এবার একটু বেশি মনে হচ্ছে- এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘চাহিদা বেশি হওয়ায় আমাদেরও পাইকারদের কাছে থেকে বেশি দামে ফুল কিনতে হয়েছে। তবে সবাই কিনতে পারবে, এমন দামেই বিক্রি করছি। বেশি দাম বললে তো কেউ কিনবে না। দেখছেনই তো আপনার সামনেই ফুল কিনে নিচ্ছে সবাই।’ কী ধরনের ফুল তরুণ-তরুণীদের আকৃষ্ট করে- এ প্রশ্নে সানফ্লাওয়ার শপের বিক্রেতা ভূঁইয়া আনিসুজ্জামান বলেন, চাইনিজ বেলি (কাঠ বেলি), গোলাপ, রজনিগন্ধা, লিলি, গাঁদা জারবেরা, অকির্ড, চাইনিজ রোজ-ইন্ডিয়ান রোজ, গø্যাডিওলাস, জিপসি (বুনোফুল) এসব ফুল বিক্রি করেন তারা। তবে তরুণ-তরুণীরা গোলাপ আর গঁাদা নেন বেশি। গোলাপ গিফট দেন আর গঁাদার মালা খোঁপায় । শাহবাগে ফুল কিনতে আসা সোহেলী আক্তার সম্পা ও তার বন্ধু রুবেল দোকানে দোকানে ঘুরে ঘুরে ফুল কিনছিলেন। গঁাদা ও গোলাপের দিকেই নজর তাদের। কী ফুল কিনলেন জানতে চাইলে সম্পা বলেন, ‘গোলাপ আমার প্রিয় ফুল। খোঁপায় দেয়ার জন্য ফুলের মালা নেব; আর গোলাপ। তবে দামটা একটু বেশি মনে হচ্ছে।’ রামপুরা থেকে আসা অনন্যা রহমানও গোলাপ কিনছেন। তিনি বলেন, ‘রেড রোজ আমার পছন্দের। ভালোবাসা দিবস বলেন আর বসন্ত। ফুল মানেই আমার কাছে গোলাপ। আমি সবসময় বেজোড় সংখ্যায় গোলাপ কিনি। আজ ১৩ তারিখ, তাই ১৩টি গোলাপ কিনব।’ শাহবাগ ফুল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মতিউর রহমান বলেন, ‘প্রতিবছরই ফুলের চাহিদা থাকে। এবারও আছে। ফুল সবসময় নতুন ও তরুণদের কাছে টানে। অনেক দূর থেকে এই ফুলগুলো আমাদের কিনে নিজস্ব খরচে পরিবহন করে এখানে আনতে হয়। তাই একটু দাম বাড়তি মনে হতে পারে ক্রেতাদের কাছে। আমরাও চাই সবাই কিনতে পারে- এমন দামেই রাখতে।’ বসন্ত বরণ অনুষ্ঠান বুধবার ফাগুনের প্রথম প্রহরে ষড়ঋতুর শেষ ঋতুটিকে বরণ করে নিতে কতো আয়োজন, কতো রং! হাজারো প্রাণের কল্লোলে নগর এখন সবুজ-শ্যামল প্রকৃতির জয়গানে মুখর। সে মুখরতায় রাজধানীতে জাতীয় বসন্ত উদযাপন পরিষদ প্রতি বছরের মতো এবারও চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় করেছে বসন্ত আয়োজন। সে আয়োজনে ঋদ্ধতায় নিজেদের সব থেকে প্রিয় ঋতুটিকে বরণ করেন নগরবাসী। সকাল ৬টা ৫৫ মিনিটে বেঙ্গল পরম্পরার যন্ত্রসহযোগে ধ্রæপদী সংগীতের মূছর্নায় শুরু হয় উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা। এরপরই আবৃত্তি শিল্পী ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বসন্তের আবাহন’ এবং আহকাম উল্লাহর ‘নিঝের্রর স্বপ্নভঙ্গ’ পরিবেশনায় ভোরের উৎসব পায় অন্য মাত্রা। এরপর তাতে নান্দনিকতা যোগ করে লাইসা আহমেদ লিসার রবীন্দ্রসংগীত, মিতা হকের সুরতীথর্ বসন্তের গান, বিজন চন্দ্র মিস্ত্রি এবং প্রিয়াংকা গোপের নজরুলগীতি। আয়োজনে ‘ভাবনা দোলা লাগিল আজি দক্ষিণ পবনে’ গানের সঙ্গে পরিবেশিত হয় সম্মেলক নৃত্য। পরিচালনা করেন নৃত্যশিল্পী প্রেমা। এরপর সমবেত সত্যেন সেনের পক্ষ থেকে সমবেত সংগীতে পরিবেশিত হয় ‘বিহুর লগন’ গানটি। নৃত্য সংগঠন নৃত্যমের পক্ষ থেকে নজরুলগীতির সঙ্গে পরিবেশিত হয় দলীয় নৃত্য। সমবেত ফোক ‘বসন্ত বাতাসে সই গো’ পরিবেশন করে বহ্নিশিখা। বিমান চন্দ্র বিশ্বাস পরিবেশন করেন লোকসংগীত ‘তোমার কুঞ্জ সাজাও গো’। এ ছাড়া পূজা সেনগুপ্তের পরিচালনায় ‘মাদল বাজে, বাজে বঁাশের বঁাশি’ গানের সঙ্গে আদিবাসী নৃত্য পরিবশেন করে তুরঙ্গম নৃত্য সংগঠন। ‘আজ বসন্ত জাগ্রত দ্বারে’ গানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশিত হয় নায়লা হাসানের পরিচালনায়। আর স্পন্দন পরিবশেন করে ‘ফাগুনেরও মোহনায়’ গানের সঙ্গে নৃত্য। আয়োজনে অংশ নেয় রেওয়াজ পারফরমির্ং আটর্ (উচ্চাঙ্গ সংগীত), ভাবনা, নটরাজ, নৃত্যনন্দন, অনন্ত রাঙামাটি (আদিবাসী)। সবমিলিয়ে গান, কবিতা আর সম্মেলক নৃত্যে বসন্ত উদযাপন করে নগরের ভালোবাসা প্রিয় মানুষগুলো। সে ভালোবাসায় লাল, হলুদ আর বাসন্তী রঙা শাড়িতে তরুণীরা তখন মাথায় ফুলের মুকুট পরে, গালে আবির লাগিয়ে উৎসব উদযাপনে ব্যস্ত। বিভিন্ন বয়সি ছেলেরাও এসেছে নিজেদের প্রিয় রঙের পাঞ্জাবি আর ফতুয়া পরে। তবে সেসব রঙের ভাষাগত প্রকাশ করে আয়োজনের বসন্ত কথন পবির্ট। এতে অংশ নেন বসন্ত উদযাপন কমিটির সহ-সভাপতি এবং আয়োজনের সভাপতি শফিউর রহমান, বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ সাধারণ সম্পাদক ও বিশিষ্ট আবৃত্তি শিল্পী আহকাম উল্লাহ এবং সংগীতশিল্পী মাহমুদ সেলিম। এ সময় তারা সবাইকে বসন্তের শুভেচ্ছা জানান।