টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদন
হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে সেবার মান তলানিতে
রাজনৈতিক নিয়োগ ও সুশাসনের ঘাটতি হ আয় কমেছে অসম চুক্তিতে হ ২০৮ কর্মকর্তা-কর্মচারীর কাজ নেই হ নবায়ন করা হয় না লাইসেন্স হ রয়েছে আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাব হ বেতন বকেয়া ১০ কোটি টাকা
প্রকাশ | ২৬ জুন ২০২৩, ০০:০০
যাযাদি ডেস্ক
রাজধানীর হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। রাজনীতির কারণে ঐতিহ্যবাহী এ হাসপাতালের সেবার মান তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে।
রোববার এক গবেষণা প্রকাশ অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। 'হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল : সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়' শীর্ষক টিআইবির গবেষণাটি ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়। গবেষণাটি উপস্থাপন করেন টিআইবির গবেষক তাসলিমা আক্তার ও মাহফুজুল হক।
হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালটি বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির একটি অলাভজনক স্বাস্থ্যসেবামূলক প্রতিষ্ঠান। টিআইবির গবেষণা দেখা গেছে, ৫২৮ শয্যার এ হাসপাতালে রোগী ভর্তি থাকে গড়ে ৩০০ জন। শয্যা খালি থাকার কারণে হাসপাতালের আয় কমছে। অন্যদিকে হাসপাতাল পরিচালনার জন্য যে জনবল প্রয়োজন, তার চেয়ে তিন গুণ বেশি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
টিআইবির গবেষণা বলছে, হিসাব করে দেখা গেছে, হাসপাতালটির ২০৮ কর্মকর্তা-কর্মচারীর কোনো কাজই নেই। গবেষকেরা বলছেন, এসব নিয়োগ দেওয়া হয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায়। নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো নিয়মনীতি মানা হয়নি। নিয়োগের ক্ষেত্রে অনেক সময় ব্যক্তিগত পরিচয়ের বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে। নিয়োগের সময় এই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দক্ষতা যাচাই করা হয়নি। এর প্রভাব পড়ে সেবার ওপরে। এখানকার রোগীরা সেবার মান নিয়ে অসন্তুষ্ট। গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে।
গবেষণায় কেনাকাটায় অনিয়ম,
পদোন্নতিতে অনিয়ম- এ রকম নানা ধরনের অনিয়মের তথ্য পেয়েছে টিআইবি।
টিআইবি মনে করে, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির চেয়ারম্যানের একচ্ছত্র ক্ষমতা ও আধিপত্যের কারণে ঐতিহ্যবাহী এ প্রতিষ্ঠান এমন দুর্বল অবস্থায় চলে গেছে। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, হাসপাতালটি পরিচালনার প্রতিটি ক্ষেত্রে সুশাসনের ঘাটতি আছে। প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান পরিস্থিতি অত্যন্ত বেদনাদায়ক, উদ্বেগজনক।
গবেষণা অনুযায়ী, রাজধানীর হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের লাইসেন্স নিয়মিত নবায়ন করা হচ্ছে না। সর্বশেষ ২০২১ সালে তিন বছরের নবায়ন একত্রে করা হয়েছিল। কথামতো কাজ না করায় হাসপাতাল পরিচালকের কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন রাজনৈতিক বিবেচনায় হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা কমিটির চেয়ারম্যান। পরিচালক পরিবর্তন হলে হাসপাতালের সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে অজুহাতে ঘন ঘন পরিচালক পরিবর্তন করা হয়।
গবেষণা প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়, হাসপাতালের জন্য পৃথক জনবল কাঠামো না থাকায় অপরিকল্পিত নিয়োগ, পদায়ন ও পদোন্নতিসহ হাসপাতালের মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমে জবাবদিহিতা নেই। একটি মানবিক সহায়তা সংস্থা এবং রেড ক্রিসেন্ট আন্দোলনের অংশ হলেও হাসপাতালটি ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও সরকার কর্তৃক অনুদান এবং আয় ও ব্যয়ের হিসাব হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সঠিকভাবে নথিভুক্ত করেনি, যা অংশীজনদের আস্থার সংকট তৈরি করেছে। প্রতিষ্ঠানটি আয়-ব্যয়ের নিরীক্ষা প্রতিবেদন স্ব-প্রণোদিতভাবে প্রকাশ ও প্রচার করা হয়নি। ফলে হাসপাতাল কার্যক্রমে অস্বচ্ছতা ও অব্যবস্থাপনার সঙ্গে সঙ্গে অনিয়ম ও দুর্নীতির সুযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে।
এছাড়া হাসপাতালটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রূপান্তরিত হলেও প্রয়োজনীয় আধুনিক যন্ত্রপাতি নেই। বাইপাস সার্জারি, এনজিওগ্রামসহ জটিল রোগের চিকিৎসা ব্যবস্থাও হাসপাতালটিতে নেই। এন্ডোসকপি ও কোলোনোস্কোপি যন্ত্রটি পুরনো হওয়ায় সেবা কার্যক্রম ব্যাহত হয়। ওটিতেও আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাব রয়েছে।
হাসপাতালে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ঘাটতি রয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কেবিনে গুমোট গন্ধ, সঁ্যাতসঁ্যাতে দেয়াল, ফ্যান ও জানালা নিয়মিত পরিষ্কার না করা এবং রাস্তায় রাখা বর্জ্য থেকে কেবিনে দুর্গন্ধ আসাসহ বিবিধ অভিযোগ রয়েছে।
চিকিৎসা সেবা কাজে ডাক্তার ও নার্সদের গাফিলতি সম্পর্কে অভিযোগ তুলে ধরা হয়েছে গবেষণা প্রতিবেদনে।
হাসপাতালের আর্থিক সামর্থ্যের ঘাটতি রয়েছে। একটানা পাঁচ থেকে সাত মাসের বেতন বকেয়া থাকার নজির রয়েছে। গ্র্যাচুইটি, প্রভিডেন্ট ফান্ড, ওষুধ কোম্পানির কাছে বকেয়া ওষুধের দামসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে টাকা বকেয়া রয়েছে। অবসর নেওয়া ২৩৬ জনের এককালীন গ্র্যাচুইটির অর্থ বকেয়া থাকা। অবসরের পর গ্র্যাচুইটির টাকা এককালীন প্রদানের কথা থাকলেও টাকা না দেওয়ায় ডাক্তার, নার্স ও কর্মীরা আদালতে মামলা করেন।
২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বরের তথ্যানুযায়ী, বেতন বকেয়ার পরিমাণ প্রায় ১০ কোটি টাকা, প্রভিডেন্ট ফান্ডে টাকার ঘাটতি প্রায় আট কোটি টাকা, হাসপাতালের কাছে ওষুধ কোম্পানির বকেয়া প্রায় চার কোটি টাকা, অবসরপ্রাপ্তদের গ্র্যাচুয়িটির প্রায় ৩১ কোটি টাকা এবং অন্যান্য খাতে প্রায় ১৮ লাখ টাকা বকেয়া রয়েছে।
গবেষণায় দেখা যায়, ২০ শয্যার একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ডায়ালাইসিস সেন্টার থাকা সত্ত্বেও নতুনভাবে বিতর্কিত জেএমআই হসপিটাল রিকু্যইজিট ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করা হয়। জেএমআইকে সুবিধা দিতে হাসপাতালের নিজস্ব মেশিন অকেজো রাখারও অভিযোগ রয়েছে। এটি একটি অসম চুক্তি এবং শুভংকরের ফাঁকি বলে মনে করে টিআইবি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, হলি ফ্যামিলিতে হাসপাতাল ইউনিট প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখনো লাভ করতে না পারলেও প্রতি মাসে জেএমআইকে বিল দিয়েছে। ফলে এ খাত থেকে হাসপাতালের আয় ২০১৯ সালে প্রায় ১.৫ কোটি টাকা থেকে ২০২০ সালে প্রায় ৭১ লাখ, ২০২১ সালে প্রায় ৫১ লাখে এসে দাঁড়ায়।
হাসপাতালের ক্রয়-প্রক্রিয়ায় নির্ধারিত পদ্ধতি যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয়নি। নির্দিষ্ট সীমা বা তিন লাখ টাকার বেশি ক্রয়ে উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান না করে প্রাইস কোটেশন পদ্ধতি অনুসরণ, একই ব্যক্তি থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে প্রাইস কোটেশন সংগ্রহ ও পছন্দের ব্যক্তিকে কাজ প্রদান করা হয়েছে। তুলনামূলক প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠান ও পণ্যের প্রযুক্তিগত ও আর্থিক মূল্যায়ন না করে একক বিক্রেতাকে কার্যাদেশ প্রদান করা হয়েছে।
গবেষণায় কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। সুপারিশগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো সোসাইটির চেয়ারম্যানের একচ্ছত্র আধিপত্য কমানো, জনবলের একটি কাঠামো তৈরি করা, প্রতিষ্ঠানটিকে রাজনীতিমুক্ত করা, ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আনা।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ডক্টর ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা (নির্বাহী ব্যবস্থাপনা) অধ্যাপক ডক্টর সুমাইয়া খায়ের, টিআইবির পরিচালক (গবেষণা ও পলিসি) মুহাম্মদ বদিউজ্জামান, পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান। গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরেন কনসালটেন্ট তাসলিমা আক্তার ও সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (গবেষণা ও পলিসি গবেষণা) মো. মাহ্ফুজুল হক।