অমর একুশে

একুশের নায়ক ছাত্র জনতা গণমানুষ

প্রকাশ | ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
কোনো নেতা নয়, দল নয় সাধারণ ছাত্রছাত্রীরাই একুশে ফেব্রম্নয়ারির ইতিহাস কাঁপানো ঘটনা ঘটিয়েছিল। সকাল থেকে শত শত ছাত্রছাত্রী কলাভবনে এসে হাজির হয়। স্বতঃস্ফূর্তভাবে তারা ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত নেয়। এতে কারও নির্দেশ বা নেতৃত্ব ছিল না। আর বিকালে পুলিশ ছাত্র মিছিলে গুলি ছুঁড়লে গোটা ঢাকা শহর গণবিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ১৯৫২ সালে জগন্নাথ কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী আমীর আলীর জবানিতে জানা গেছে, 'ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন সাধারণ ছাত্র ও শ্রমজীবী মানুষ। ভাষা আন্দোলনে রাজনৈতিক কিংবা ছাত্রনেতাদের কোনো ভূমিকা ছিল না, তাও নয়। তাদের ভূমিকা ছিল ২০ ফেব্রম্নয়ারি রাত পর্যন্ত। সকালের নায়ক ছাত্র-জনতা ও গণমানুষ। ১৪৪ ধারা জারির ঘোষণা শুনেও তারা রণে ভঙ্গ দেননি। বরং পরের দিন সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় সবাইকে সমবেত হতে আহ্বান জানিয়েছিলেন।' এ ব্যাপারে ভাষাসৈনিক অলি আহাদের ভাষ্য হলো: এই দিন জনসাধারণের বিভিন্ন অংশ শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে দলবদ্ধ হয়ে শোভাযাত্রা বের করে আর ১৪৪ ধারা অগ্রাহ্য করে বর্বর হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকে। গ্রাম থেকে গাড়িওয়ালা, মাঝিমালস্না আর কৃষক-মজুর, ছাত্র-শিক্ষকরা এসে শহরে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছেন। ...শহরের সব প্রান্ত থেকে জনসাধারণ নিজেরাই মিছিল সংগঠিত করে বিক্ষোভ প্রদর্শনও করেছেন। বায়ান্নের ২০ ফেব্রম্নয়ারি রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে মফস্বলের মানুষের মধ্যেও ছিল চরম ক্ষোভ। চলছিল রক্তাক্ত গৌরবের প্রস্তুতি। প্রদেশব্যাপী সাধারণ হরতালের কারণে ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট কোরেশী সমগ্র শহরে ১৪৪ ধারা জারি করলেন। বিকাল থেকেই সারা শহরে জারি হলো এক মাসের কারফিউ। এ অবস্থায় আবুল হাশিমের সভাপতিত্বে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। মধ্যরাত পর্যন্ত বৈঠক হলেও কোনো সিদ্ধান্তে কেউ ঐকমত্যে পৌঁছতে পারেনি। দুটি দলে ভাগ হয়ে যায় ১৪৪ ধারা ভাঙা না ভাঙার ব্যাপারে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছেড়ে ফেলে ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষেই অবস্থান নিয়েছিলেন। সিদ্ধান্ত ছিল ১০ জন করে একেকটি দল গঠন করে মিছিল বের করবে, যাতে পুলিশ একসঙ্গে সবাইকে পাকড়াও করতে না পারে। কিন্তু ২১ ফেব্রম্নয়ারি ১৪৪ ধারা জারি ভঙ্গ দ্বিতীয় বা তৃতীয় দলের মিছিল বের হতেই পুলিশ লাঠিচার্জ শুরু করে। এতে ছাত্ররা নিবৃত্ত না হলে কাঁদানে গ্যাস ছোড়া হয়। ততোক্ষণে আমতলা পরিণত হয়েছে জনারণ্যে। ছাত্রদের সঙ্গে এসে যোগ দেন পেশাজীবী শ্রমজীবী সাধারণ মানুষ। এরপর সমাবেশে পুলিশ গুলি ছুড়লে কয়েকটি তাজা প্রাণ ঝরে যায়, রক্তে রঞ্জিত হয় রাজপথ। সৃষ্টি হলো এক নতুন ইতিহাস। আমরা যদি একুশের শহীদদের তালিকা দেখি, তাহলেও ধারণা করতে অসুবিধা হয় না, এটি ছিল জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন বা গণবিদ্রোহ। তারা ছিলেন কৃষকের সন্তান। একমাত্র আবুল বরকত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, পড়তেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতকোত্তর শেষ বর্ষে। বাকি সবাই বাইরের। ভাষা আন্দোলনে আত্মদানকারী রফিকের নাম রফিক উদ্দিন আহমেদ। ছাপাখানার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বাড়ি মানিকগঞ্জের সারিল গ্রামে। ২১ ফেব্রম্নয়ারি তিনিও কলাভবনের সামনের মিছিলে যোগ দেন এবং পুলিশের গুলিতে নিহত হন। আবদুস সালাম ছিলেন শিল্প অধিদপ্তরের কর্মচারী। তার বাড়ি ফেনীর দাগনভূঞায়। আবদুল জব্বারের বাড়ি ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে। গ্রাম প্রতিরক্ষা দলের কমান্ডার ছিলেন তিনি। শাশুড়িকে চিকিৎসা করাতে নিয়ে এসেছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। হাসপাতাল গেটে মিছিল দেখতে গিয়ে তিনিও এতে শামিল হন। তার হাতে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই স্স্নোগান-সংবলিত একটি ব্যানারও ছিল। সফিউর রহমান ছিলেন হাইকোর্টের কর্মচারী, পাশাপাশি রাতে আইন বিষয়েও পড়াশোনা করতেন। তার পৈতৃক বাড়ি পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার কন্যাঘরে। নবাবপুর রথখোলার কাছে পাকিস্তানি সেনারা গুলি করলে তিনি শহীদ হন।