কৃত্রিম অঙ্গ হাসপাতালে নেই, আছে ফুটপাতে

প্রকাশ | ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

জাহিদ হাসান
রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতালে না পাওয়া গেলেও কৃত্রিম অঙ্গ পাওয়া যাচ্ছে ফুটপাতে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দুর্ঘটনায় শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হারিয়ে পঙ্গু হাসপাতলে ছুটে আসেন ভুক্তভোগীরা। কিন্তু প্রায় দেড় যুগের বেশি সময় ধরে হাসপাতালের কৃত্রিম অঙ্গ তৈরির কেন্দ্র (লিম্ব সেন্টার) বন্ধ থাকায় ফুটপাত থেকে উচ্চ দামে নিম্নমানের সরঞ্জাম কিনতে বাধ্য হচ্ছেন রোগীরা। তবে এ বিষয়ে নানা অযুহাতে কোনো ব্যবস্থাই নিচ্ছে না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। বেশ কয়েকদিন শেরেবাংলা নগরের জাতীয় অর্থপেডিক্স ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের (নিটোর) ফুটপাতে গিয়ে এমন অন্তত ৩০টি দোকান দেখা যায়। সেখানে বিভিন্ন সার্জিক্যাল সরঞ্জাম বিক্রির আড়ালে কিছুটা রাখঢাক করে উচ্চমূল্যে নিম্নমানের বিভিন্ন কৃত্রিম অঙ্গ বিক্রি হচ্ছে। এ সব দোকানে। এরমধ্যে কৃত্রিম পা, সার্জিক্যাল জুতা ও হাত ছাড়াও সার্জিক্যাল কলার, ওয়াকার, ট্রেইলার ব্রেইচ, পেলভিক ট্রাকসন, ক্র্যাচ, চেস্ট বাইন্ডার, অ্যাবডোমিনাল বাইন্ডার, পোস্ট অপারেটিভ রোগীদের জন্য ওয়েস্ট-শেপার, অ্যাঙ্কেল ইনজুরি প্রিভেন্টিভ সাপোর্ট ব্রেস, ব্যাক ইঞ্জুরি প্রিভেনটিভ ব্রেস, নি ব্রেসসহ প্রায় ৪০ ধরনের সার্জিক্যাল সরঞ্জাম দেদার বিক্রি হতে দেখা যায়। ভুক্তভোগী রোগীর স্বজনেরা অভিযোগ করছেন হাসপাতালের নিজস্ব লিম্ব সেন্টার কৃত্রিম (অঙ্গ তৈরি কারখানা) বন্ধ থাকার সুযোগে এ সব দোকান মালিকরা নিরুপায় রোগীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন। চিকিৎসা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মানহীন এ সব কৃত্রিম সরঞ্জাম ব্যবহার করে মানুষের ভোগান্তি বাড়ছে। কারণ সব সরঞ্জামই রোগীর চাহিদা বা স্থাস্থ্যসম্মত উপায়ে তৈরি হয় না। এগুলোর মান যাচাইয়েরও কোনো পদ্ধতি নেই। এতে সাময়িক চাহিদা মিটলেও কেউ কেউ দীর্ঘমেয়াদি নানা শারীরিক জটিলতায় আক্রান্ত হচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অর্থপেডিক্‌স বিশেজ্ঞ অধ্যাপক ডা. শহিদুল ইসলাম যায়যায়দিনকে বলেন, সাধারণত কৃত্রিম অঙ্গ বাইরে তৈরি বা বিক্রি হওয়ার কথা না। যদি হয়ে থাকে তবে সেটা কতটা মানসম্মত তা দেখতে হবে। কারণ এ সব অঙ্গের প্রস্তুত কাঠামো সঠিক না হলে যেমন; সঠিক ওজন ও দৈর্ঘ্য-প্রস্থ ঠিক না থাকলে দীর্ঘমেয়াদে রোগীর ক্ষতি হবে। কোয়ালিটি নিশ্চিত না হলে সরঞ্জামটিও দ্রম্নত নষ্ট হয়ে যাবে। তবে ভারতের জয়পুরের একটি সংস্থা ও দেশের মঈন ফাউন্ডেশনের যৌথ উদ্যোগে প্রতি বছর নিটোরে প্রায় ৭০০ রোগীকে কৃত্রিম অঙ্গ দেয়া হয়ে থাকে। বিএসএমএমইউ'র অর্থপেডকিস্‌ চিকিৎসক ডা. মো. কামরুল আহসান বলেন, দেশে হাতেগোনা দুয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আছে। কিন্তু তাদের ডিজাইন শতভাগ সঠিক হয় না। আর কোয়ালিটি নিশ্চিত করতে না পারলে রোগীকে কষ্ট করে টেনে নিয়ে বেরাতে হয়। এমনকি বৈজ্ঞানিকভাবে মানসম্মত পদ্ধতিতে তৈরি না হলে পরবর্তী সময়ে রোগীর জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। মাদারীপুর থেকে পঙ্গু হাসপাতালে কৃত্রিম পা লাগাতে আসা আবদুর রাজ্জাক (৪০)-এর পিছু নেন শ্যামলী এলাকার এক কৃত্রিম পায়ের দোকানের দালাল। রোগীর স্বজন সেজে কথা বললে তিনি জানান, তার মতো আরও ১০ থেকে ১৫ জন পঙ্গু হাসপাতালে এই কাজ করেন। প্রতি মাসে বেতন দেয়া হয় তাদের। পাশাপাশি কৃত্রিম অঙ্গ তৈরির বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও ক্লিনিকগুলোতে রোগী বাগিয়ে নেয়ার বিনিময়ে মোটা অংকের কমিশনও পান। হাসপাতালের লিম্ব সেন্টারে জুতা বানাতে আসা শাহনাজ বিউটি অভিযোগ করে বলেন, ১৯৮৪ সাল থেকে তিনি এই হাসপাতাল থেকে জুতা প্রস্তুত করে পরছেন। লিম্ব সেন্টারটি বন্ধ থাকায় ভারত থেকে তৈরি করে আনা জুতা ব্যবহার করলেও পায়ে ফিট হয়নি। এখানে তৈরি সরঞ্জাম সঠিক মাপের হয় যা অন্যরা পারে না। তাই সেন্টারটি পুরোদমে চালু হলে অসহায় রোগীদের বাইরে গিয়ে ঠকতে হবে না। ৬০ ফিট এলাকার রিকশাচালক কামাল হোসেন সড়ক দুর্ঘটনায় বুকে আঘাত পেয়ে পঙ্গু হাসপাতালে এলে বহির্বিভাগের চিকিৎসক টানা ১৪ দিন 'চেষ্ট-বাইন্ডার' ব্যবহারের পরামর্শ দেন। তিনি হাসপাতাল থেকে বের হতেই গেটে ওতপেতে থাকা সার্জিক্যাল দোকানের কয়েকজন দালালের খপ্পরে পড়েন। প্রেসকিপশন দেখে স্বল্পদামে কেনার আশ্বাস দিয়ে ৮০০ টাকার একটি সরঞ্জাম ১৪শ' টাকায় কিনতে বাধ্য করেন। বিষয়টি প্রতিবেদকের নজরে এলে ফুটপাতের ওই দোকনির সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় অতিরিক্ত দাম নেয়ার ব্যাপারে জানত চাইলে 'সার্জিক্যাল ওয়ার্ল্ড' নামক দোকানের কর্মচারী রায়হান যায়যায়দিনকে বলেন, ফুটপাতে বসে ব্যবসা করলেও দোকান ভেদে প্রতিমাসে ৭ থেকে ১০ হাজার টাকা ভাড়া দিতে হয়। এ ছাড়া কর্মচারীদের বেতন ও নেতাদের বকশিস দিতে হয়। ফলে ক্রেতাদের কাছ থেকে দাম একটু বেশি রাখা হয়। বিষয়টি সম্পর্কে নিটোরের একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা যায়যায়দিনকে বলেন, হাসপাতালের সামনের সড়কেই রয়েছে সাজ্জাত স্টোর ও আবুল ক্র্যাচ স্টোর অ্যান্ড স্যানেটারি নামে দুটি দোকান। যেটির মালিক আবুল হোসেন। তিনি পঙ্গু হাসপাতালের নিরাপত্তাকর্মী সুলতান আহমেদের ভাই। তার সঙ্গে হাসপাতালের আরও কয়েকজন স্টাফ জড়িত আছে। এর আগে রোগীদের হয়রানি ও অন্য ক্লিনিকে ভাগিয়ে নেয়ার দায়ে ২০১৭ সালে ১৬ জন ও ২০১৮ সালে ২৪ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড দিয়েছিলেনর্ যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। যাদের মধ্যে হুমায়ুন কবির ও মাহফুজা আক্তার নামে হাসপাতালের দু'জন কর্মচারীও ছিল। লিম্ব সেন্টারের একমাত্র লেদার ওয়ার্কার মুখলাল রবিদাস যায়যায়দিনকে বলেন, আগে প্রতি মাসে কৃত্রিম অঙ্গসহ বিভিন্ন আইটেমের সরঞ্জাম তৈরি হলেও এখন বন্ধ রয়েছে। মূলত হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অনিয়ম-অবহেলা সরকারের তদারকির অভাব ও লোকবল সংকটের কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ১২টি পদের মধ্যে একমাত্র তিনি (টেকনিশিয়ান) ছাড়া সবাই অবসরে গেছেন। বর্তমানে লিম্ব মেকারের ৮টি, লেদার ওয়ার্কার ১টি, কম্পোজিটর ১টি এবং কার্পেন্টারের ১টি পদ খালি আছে। নাম না প্রকাশের শর্তে আরেক চিকিৎসক বলেন, হাসপাতালে কৃত্রিম অঙ্গ লাগাতে আসা গরিব রোগীদেরকে উপজীব্য করে দেড় যুগ ধরে এমন প্রতারণামূলক ব্যবসা করছে একটি সংঘবদ্ধ চক্র। সঙ্গে এখানকার একশ্রেণির তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী, ওয়ার্ডবয় ও স্থানীয় ক্ষমতাসীন নেতারা জড়িত রয়েছেন। চক্রটি হাসপাতালে কৃত্রিম অঙ্গের ব্যবস্থা না থাকা এবং ভালো চিকিৎসা পাওয়া যায় না বলে সহজ-সরল রোগীদের প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে যেতেও উদ্বুদ্ধ করে থাকেন। এরপর শ্যামলী ও মোহাম্মদপুর এলাকায় গড়ে ওঠা একাধিক প্রাইভেট হাসপাতাল-ক্লিনিকের হয়ে ওই সব প্রতিষ্ঠানে কৃত্রিম হাত-পা সরবরাহ করেন। এ ব্যাপারে হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. মো. ইকবাল হোসাইনের কাছে জানতে চাইলে তিনি যায়যায়দিনকে বলেন, এখানে নতুন এসেছেন বলে বেশিকিছু জানেন না। তবে হাসপাতালে কৃত্রিম অঙ্গ তৈরির ব্যবস্থা বন্ধ থাকার কারণেই রোগীরা বাইরে যাচ্ছে। এই সুযোগে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠছে। এর সঙ্গে স্থানীয় কিছু ক্ষমতাসীন ব্যক্তিও জড়িত আছে বলে শুনেছেন। এ ছাড়া ১৯৮৫ সালে নিয়োগবিধি মোতাবেক শিক্ষাগত যোগ্যতাসম্পন্ন লোক না থাকায় শূন্য পদগুলো পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। ২০১৪ ও ২০১৭ সালে বিজ্ঞপ্তি দেয়া হলেও নানা জটিলতায় বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে নিয়োগবিধি পরিবর্তনের জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে আবেদন করা হয়েছে।