শোক আর গৌরবের অমর একুশে আজ

প্রথম প্রহরে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা

প্রকাশ | ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রম্নয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি'- অমর একুশের এই গান তুলে একুশের প্রথম প্রহর থেকে মানুষের সম্মিলিত স্রোত মিশে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। গভীর শ্রদ্ধায়, প্রাণের অঞ্জলিতে ভরে ওঠে মিনার প্রাঙ্গণ
যাযাদি রিপোর্ট 'অপমানে তুমি জ্বলে উঠেছিলে সেদিন বর্ণমালা/সেই থেকে শুরু দিন বদলের পালা/নতুন মন্ত্রে ভরেছিলে অঞ্জলি/আর নয় ভীরু ফাল্গুনী পদাবলী'- কবিতার এমনই পঙ্কতিমালার মতো ছিল দিনটি। এদিন থেকেই রোপিত হয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজ। ১৯৫২ সালের এই দিনে বাংলা মায়ের শোণিত ধারায় সিক্ত হয়েছিল এ মাটি। সেই চিরভাস্বর একটি দিন। আজ অমর একুশে ফেব্রম্নয়ারি। রক্তের কালিতে লেখা বাঙালি জাতির ইতিহাসে বেদনা এবং চিরগৌরবদীপ্ত ও অহঙ্কারে মহিমান্বিত একটি দিন। থোকা থোকা রক্তের ফুলকি সালাম, বরকত. রফিক, জব্বার, সফিউদ্দিনসহ নাম না জানা অগণিত মৃতু্যঞ্জয়ী ভাইয়ের রক্তে রাঙানো দিন। আজ ছেলে হারা মায়ের বিলাপের দিন। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর একুশে ফেব্রম্নয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা বা ইউনেস্কো। ২০০০ সাল থেকে একুশে পালিত হচ্ছে সেই মর্যাদায়। বাংলাদেশের সঙ্গে তালমিলিয়ে সারা বিশ্ব আজ মৃতু্যঞ্জয়ী ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানাবে। হাতে ফুল, হৃদয়ে ভাষা শহীদদের প্রতি গভীর ভালোবাসা আর কন্ঠে 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রম্নয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি'- অমর একুশের এই গান তুলে একুশের প্রথম প্রহর থেকেই মানুষের সম্মিলিত স্রোত গিয়ে মিশে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। বেদিতে ফুল দিয়ে ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পথে নামে লাখো মানুষের ঢল। রীতি অনুযায়ী বুধবার দিবাগত রাত ১২টা এক মিনিটে প্রথমে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এবং পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভাষা শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন। এছাড়া কূটনীতিক, মন্ত্রিপরিষদের সদস্যবৃন্দ, ভাষাসৈনিক, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, বিরোধীদলীয় নেত্রীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অপর্ণ ও শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। পরে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য শহীদ মিনার সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। ভোরে শহীদ বেদিতে নামে সর্বস্তরের মানুষের ঢল। শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যরা। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার রাজপথ, দেয়াল সজ্জিত এখন বর্ণিল সাজে। চারুকলার শিক্ষার্থীরা রাত-দিন খেটে রং-তুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তুলেছে প্রতিবাদের নানা ভাষা। রাতে প্রথম প্রহর থেকে জেগে ওঠা মানুষ সকালে দেখবে এক নতুন আকাশ, নতুন সূর্য। শহীদ মিনার বেদি, কালো রাজপথ, দেয়াল হেসে উঠছে বর্ণিল আল্পনায়। বীর ভাষা শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাতে পথে নামবে মানুষের ঢল। হাতে ফুল, মুখে অমর সে একুশের গান। নগ্ন পা-চিরচেনা সেই অন্তহীন মিছিল এসে থামবে স্মৃতির মিনারে। গভীর শ্রদ্ধায়, ফুলে, প্রাণের অঞ্জলিতে ভরে উঠবে মিনার প্রাঙ্গণ। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে সারাদেশে গড়ে তোলা মিনার, স্মৃতিস্তম্ভ সাজবে শ্রদ্ধার ফুলে। দিবসটি পালন উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। আজ জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকবে। দিনব্যাপী নেয়া হয়েছে নানা অনুষ্ঠানমালা। এদিকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারকে ঘিরে রাজধানীতে নেয়া হয়েছে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা।র্ যাব, পুলিশ, এপিবিএন ও আনসারসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রায় ১০ হাজার সদস্য রয়েছে মোতায়েন। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ঘিরে বসানো হয় ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা। এছাড়া আশপাশ এলাকায় বসানো হয়েছে তিন ডজন চেকপোস্ট। ওইসব চেকপোস্টে বুধবার বিকাল থেকেই শুরু হয় দেহ তলস্নাশি।র্ যাবের ডগ স্কোয়াড ও অত্যাধুনিক মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে পুরো শহীদ মিনার এলাকা সুইপিং করা হয়। ১৯৫২ সালের এইদিন সকালেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলার সভা থেকে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের ডাক এসেছিল। উপস্থিত শিক্ষার্থীরা তখন ১৪৪ ধারা ভাঙার জন্য উদগ্রীব ছিল। একের পর এক ১০ জনের মিছিল বের হতে থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট থেকে। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ চলতেই থাকে। বেলা সাড়ে তিনটায় ছিল প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন। এ জন্য আগের সিদ্ধান্তমতো ছাত্ররা রাষ্ট্রভাষার দাবিতে পরিষদ ভবনের সামনে বিক্ষোভ করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ছাত্ররা সে সময় সমবেত হয় মেডিকেল কলেজ হোস্টেল গেটের সামনে। এ ছাড়া ছাত্র-জনতা স্থান করে নিয়েছিল রাস্তার উল্টো দিকে বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠে ও রাস্তার ধারে। সংঘর্ষ চলাকালেই পুলিশ কয়েকবার মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে যায়, ছাত্রদের এলোপাতাড়ি লাঠিপেটা করে। আর ইট-পাটকেল নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে ছাত্ররা। হটে যায় পুলিশ। এ সময় হঠাৎ মেডিকেল কলেজ হোস্টেল গেটের সামনে ও বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠে সমবেত ছাত্র-জনতার ওপর গুলিবর্ষণ করা হয়। এতে শহীদ হন আবুল বরকত, রফিকউদ্দিন আহমদ, আবদুল জব্বার। সফিউর রহমান, রিকশাচালক আবদুল আউয়াল, অহিউলস্নাহসহ অজ্ঞাতসংখ্যক লোক ২২ ফেব্রম্নয়ারি পুলিশের গুলিতে শহীদ হন। ২১ ফেব্রম্নয়ারি পুলিশের গুলিতে গুরুতর আহত আবদুস সালাম মারা যান ৭ এপ্রিল। তাদের মৃতু্য সংবাদে বাংলা ভাষার প্রাণের দাবি সারা দেশে স্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়ে। পরে শাসকগোষ্ঠী বাংলা ভাষার দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়। এরপর থেকেই একুশে ফেব্রম্নয়ারি অমর ভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হয়। শহীদদের স্মরণে সারা দেশে তৈরি হয় অসংখ্য শহীদ মিনার।