চকবাজারে আগুনের গ্রাসে ৭৮ প্রাণ

শোকে স্তব্ধ ঢাকা, কাঁদছে বাংলাদেশ ১৫ ঘণ্টা পর লেলিহান নিয়ন্ত্রণে

প্রকাশ | ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
বুধবার রাতে পুরান ঢাকার চকবাজারের পাঁচটি ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে লন্ডভন্ড হয়ে যায় পুরো এলাকা। ছবিতে পুড়ে যাওয়া বাড়ি, গাড়ি ও ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের উদ্ধার তৎপরতা -যাযাদি
দাউ দাউ আগুনে পুড়ে মৃতু্যর কোলে ঢলে পড়া মানুষের স্বজনদের কান্না আর আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছে চকবাজারের চুড়িহাট্টার বাতাস। শোকে স্তব্দ ঢাকা, কাঁদছে সারা বাংলাদেশ। মর্মন্তুদ এ ঘটনার শোকের ঢেউ দেশের সীমানা ছাড়িয়ে আছড়ে পড়েছে গোটা বিশ্ব পরিমন্ডলে। বুধবার রাতে পুরান ঢাকার চকবাজারের পাঁচটি ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে এখন পর্যন্ত ৭৮ জনের মৃতু্যর খবর নিশ্চিত হওয়া গেছে। এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে ধারণা করছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা। স্থানীয়রা জানান, বুধবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে প্রথমে রাজধানীর পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টা এলাকার একটি ভবনে লাগা আগুন মুহূর্তের মধ্যে পাশের আরও চারটি ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। সরু গলিতে যানজটে আটকে পড়া রিকশাযাত্রী ও পথচারীসহ সেখানকার দোকানপাটের মালিক-কর্মচারী মিলিয়ে শতাধিক ব্যক্তি আগুনে দগ্ধ ও আহত হন। চকবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে হতাহতের ঘটনায় রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। তারা নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, অগ্নিকান্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের ১ ক্ষতিপূরণ দেবে সরকার। ঘটনা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, পুরান ঢাকায় নন্দকুমার সড়কের চুড়িহাট্টায় বুধবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে শাহী মসজিদের সামনে একটি বৈদু্যতিক খুঁটির ট্রান্সফরমার বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়ে জামাল কমিউনিটি সেন্টারে আগুন লাগে। পরে তা ছড়িয়ে পড়ে পাশের চারতলা ওয়াহিদ ম্যানশনে। ভবনটির প্রথম দুই তলায় প্রসাধন সামগ্রী, পস্নাস্টিকের দানা ও রাসায়নিক দাহ্য পদার্থের গুদাম থাকায় আগুনের লেলিহান শিখা মুহূর্তেই পাশের আরও চারটি ভবন গ্রাস করে। পাশের কয়েকটি খাবারের হোটেলের গ্যাস সিলিন্ডারেরও বিস্ফোরণ ঘটে। পুড়ে যায় সড়কে থাকা একটি প্রাইভেট কারসহ কয়েকটি যানবাহন। তবে অপর একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, রাত ১০টা ৩৮ মিনিটে রাজধানীর পুরান ঢাকার চকবাজার থানার চুড়িহাট্টা শাহী মসজিদের সামনে একটি পিক-আপের সিলিন্ডার বিস্ফোরণের পর আশপাশের ভবনে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। খবর পেয়ে প্রথমে পুরান ঢাকাসহ আশপাশের এলাকার ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে ছুটে এসে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালায়। তবে দাহ্য পদার্থের আগুন দ্রম্নত চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলে জরুরি ভিত্তিতে রাজধানীর সব কটি ফায়ার সার্ভিসের ইউনিট চকবাজারে ডেকে আনা হয়। বিমান বাহিনীর দুটি হেলিকপ্টারও আগুন নেভানোর কাজে অংশ নেয়। প্রায় ১৫ ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনলেও এর আগেই পাঁচটি ভবনের আসবাবপত্র, মালামাল ও জানালা-দরজা সব পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ঘটনাস্থলে উপস্থিত ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানান, ঘন বসতি এবং রাস্তা সরু হওয়ায় আগুন নেভাতে তাদের যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। এ ছাড়া ঘটনাস্থলের আশপাশে পানির আধার না থাকায় আগুন নেভানোর কাজে বেশকিছুটা বিলম্ব ঘটে। ঘটনাস্থলে দায়িত্ব পালন করা ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মকর্তা জানান, সেখানে বেশ কয়েকটি দাহ্য পদার্থের গুদাম থাকায় আগুন দ্রম্নত চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এ ছাড়া রাসায়নিক কন্টেইনারগুলো ভয়ঙ্করভাবে বিস্ফোরিত হওয়ায় আগুন নেভানো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আগুন লাগার পর ওয়াহিদ ম্যানশনের একতলা ও দোতলা থেকে লাভার মতো বস্তু আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে। সেই 'লাভা' যেখানেই গেছে, সেখানেই সবকিছু পুড়েছে। একজন দোকানি বলেন, 'টিভিতে লাভা দেখছি, আগুনটা ছিল হেই রকম। যেইখানে এইডা পড়ছে, হেইখানেই আগুন লাগছে।' পারভেজ নামের এক ব্যবসায়ী জানান, গ্রেনেড বিস্ফোরণের মতো বিকট শব্দে একের পর এক সিলিন্ডার ও ট্রান্সফরমার বিস্ফোরিত হতে থাকলে দোকানি-পথচারীসহ সবার মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় দিগ্‌বিদিক হয়ে সবাই ছোটাছুটি শুরু করে। আগুন লাগার সময় চুড়িহাট্টা মোড়টি যানজটে ঠাসা থাকায় কেউই বেশি দূর এগোতে পারেনি। এ সময় আগুনের লেলিহান শিখা থেকে বাঁচতে অনেকে দোকানের শাটার নামিয়ে দেন। তবে আগুনের তীব্রতা বাড়ার কারণে তারা সেখানেই পুড়ে মারা যান। পথচারীরা কেউ কেউ যানবাহনে বসেই অগ্নিদগ্ধ হন; অনেকে কিছুটা পথ ছুটে গিয়েও আগুনের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারেননি। প্রত্যক্ষদর্শী ইকবাল জানান, বিস্ফোরণের শব্দের পরপরই পুরো এলাকায় বিদু্যৎ চলে যায়। অন্ধকারে সবাই ছোটাছুটি শুরু করেন। ভবনের ভেতর থেকে মানুষ আর্তচিৎকার করে বাঁচার আকুতি জানান। তবে এ সময় জীবন বাঁচাতে কেউ কারও দিকে ফিরেও তাকায়নি। দমকল বাহিনীর একজন কর্মী জানান, ওয়াহিদ ম্যানশনের করিডরের শেষ মাথা থেকে তারা একসঙ্গে ২৪টি লাশ উদ্ধার করেন। এ ছাড়া আশপাশের দোকান ও রেস্টুরেন্ট থেকেও বেশ কয়েকটি লাশ উদ্ধার করা হয়। ওই দমকল কর্মীর ধারণা, আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে তারা দৌড়ে নিরাপদ আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সেখানেই তারা দগ্ধ হয়ে মারা যান। বৃহস্পতিবার সরেজমিনে দেখা যায়, রাস্তার ওপর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে পোড়া দুটি পিকআপ ভ্যান, একটি প্রাইভেটকার, অসংখ্য রিকশা, ভ্যান, সাইকেল, মোটরবাইক, ঠেলাগাড়ির কাঠামো, জুতা ও পারফিউমের ছোট-বড় অসংখ্য কন্টেইনার। এ ছাড়া ভেঙে পড়া কংক্রিটের দেয়ালে কোথাও কোথাও রাস্তা ঢাকা পড়েছে। বুধবার ভোরের আগেই ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা হয় অর্ধশতাধিক মৃতদেহ। ভোরে বিভিন্ন বাড়ির সামনের নালা, সাটার টানা দোকানের ভেতর থেকে আরও লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়া অগ্নিদগ্ধ ও আহত অন্তত ৬০ জন ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন। হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৬ জন। এর মধ্যে অগ্নিদগ্ধ নয়জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ক্যাম্পের পরিদর্শক বাচ্চু মিয়া জানান, চকবাজারে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় ৭৮ জনের লাশ ঢাকা মেডিকেলে এসেছে। এদের মধ্যে ৬৫ জন পুরুষ, পাঁচজন শিশু ও সাতজন নারী। বৃহস্পতিবার বিকাল পর্যন্ত এদের মধ্যে ৪১ জনের লাশ শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। এর মধ্যে দুইজন নারী, দুইজন শিশু ও ৩৭ জন পুরুষ। পরিচয় শনাক্ত হওয়া নিহতরা হলেন- রাজু (৩০), তার ভাই মাসুদ রানা (৩৫), সিদ্দিকুলস্নাহ (৪৫), আবু বকর সিদ্দিক (২৭), আলী মিয়া (৭৫), মোশাররফ হোসেন (৩৮), কামাল হোসেন (৫২), ইয়াসিন খান রনি (৩২), জুম্মন (৬৫), এনামুল হক (২৮), মজিবর হাওলাদার (৪৫), মুফতি ওমর ফারুক (৩৫), মোহাম্মদ আলী (৩২) ও তার ভাই আবু রায়হান (৩১), তার ছেলে আরাফাত (৩), ইমতিয়াজ ইমরোজ (২৪), হেলাল (৩০), ওয়াফিউলস্নাহ (২৫), সোনিয়া (২৮), স্বামী মিঠু (৩৫), তাদের ছেলে শাহিদ (৩), রহিম দুলাল (৪৫), হিরা, নাসির, মঞ্জু, আনোয়ার, কাওসার, শায়লা খাতুন, আরমান হোসেন রিমন, মামুনুর রশীদ, আবু তাহের, রুবেল হোসেন, সৈয়দ সালাউদ্দিন, মুসা, ইলিয়াস মিয়া, মিজানুর, আসিফ, মো. হোসেন বাবু, খলিলুর রহমান সিরাজ, নূর ইসলাম হানিফ ও নবীউলস্নাহ খান। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদ জানান, অগ্নিদগ্ধদের অনেকের দেহ পুড়ে বিকৃত হয়ে গেছে। তাদের লাশ দেখে শনাক্ত করার কোনো উপায় নেই। ডিএনএ টেস্ট করে তাদের পরিচয় শনাক্ত করে স্বজনদের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হবে। এ ব্যাপারে নিহতদের স্বজনদের জানানো হয়েছে বলে জানান তিনি। তবে তার পরও স্বজনের লাশ নেয়ার জন্য মর্গের পাশে অপেক্ষমাণ ছিলেন অনেকেই। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত অন্তত অর্ধশত মানুষকে সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। ইসমাইল হোসেন নামের এক যুবক জানান, ঘটনার সময় তার ফুফাতো ভাই চুড়িহাট্টাতেই ছিল। ভোর পর্যন্ত তার কোনো খোঁজ মেলেনি। তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটিও বন্ধ রয়েছে। তাদের ধারণা, তার লাশ মর্গেই রয়েছে। তবে তার সারা শরীর হয়তো পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে। এজন্য তারা চিনতে পারছেন না। লাশ না নিয়ে বাড়ি ফিরবেন না বলে জানান ইসমাইল। শুধু ইসমাইলই নন, ঘটনার সময় সেখানে থাকা যাদের হদিস নেই- এমন অনেকের স্বজনেরা অপেক্ষমাণ ঢামেক হাসপাতালের মর্গের আশপাশে। এদিকে দগ্ধ ব্যক্তিদের মধ্যে যারা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি হয়েছেন তারা হলেন রেজাউল (২১), জাকির হোসেন (৫০), সেলিম (৪৫), আনোয়ার (৫০), মোস্তাফিজ (৪০), জাহিদুল (২৮), ইভান (৩০), মাহমুদ (৫৭), রামিম (১২), সালাউদ্দিন (৫০), মোজাফ্‌ফর হোসেন (৩২), সোহাগ (২৬), সোহান (৩৫), ফজর আলী (২৫), হেলাল (২৫) ও সুজন (৪০)। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের এক চিকিৎসক জানান, ক্লোজ জায়গায় বিস্ফোরণ ঘটেছে। সবারই শ্বাসনালি পুড়েছে কমবেশি। চারজনের বেশি পুড়েছে। তাদের অগ্নিদগ্ধের পরিমাণও বেশি।