আতঙ্ক কাটছে না চুড়িহাট্টাবাসীর

প্রকাশ | ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট

ভয়াবহ আগুন ৬৭ জন মানুষের প্রাণ আর বিপুল সম্পদ গিলে নেয়ার পর পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টা এখন অনেকটাই ভুতুড়ে এলাকা। তিনদিন আগের আগুনের বিভীষিকা যেন পিছু ছাড়ছে না স্থানীয়দের। অগ্নিকান্ডের সময় স্থানীয় যারা বাসাবাড়ি ছেড়ে সরে গিয়েছিলেন, তাদের কেউ কেউ ফিরলেও এখনো আতঙ্ক বিরাজ করছে অনেকের মধ্যে। চুড়িহাট্টা মোড় থেকে পূর্ব দিকে কয়েক গজ গেলে বাম দিকের গলির শেষ মাথার বাড়ির মালিক মো. মঈন উদ্দিন। তার সামনের ভবনে আগুন লাগায় পরিবারের সবাইকে নিয়ে বাড়ির পেছনের গেট দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন বুধবার রাতে। তার বাড়ির অর্ধেক ভাড়াটিয়া ফিরে এলেও অন্যরা আতঙ্কে ফিরছেন না বলে জানান তিনি। 'তাদেরকে ভরসা দিচ্ছি যে কিছু আর হবে না, কিন্তু তারা ভরসা পাচ্ছে না,' বলেন ষাটোর্ধ্ব মঈন উদ্দিন। নন্দ কুমার দত্ত লেনের পাশে হায়দার বখশ লেনের একটি বাড়ির বাসিন্দা ৫২ বছর বয়সি মো. আনোয়ার হোসেনের চোখে এখনো আটকে আছে ভয়াল সেই রাতের বিভীষিকা। চুড়িহাট্টা শাহী মসজিদের পাশেই তার বাসা। আগুন লাগার পর ভবনের আর সব বাসিন্দার সঙ্গে প্রাণ বাঁচাতে তিনিও সপরিবারে ছুটেছিলেন নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। দৌড়াতে গিয়ে আহত হন তার স্ত্রী মুনিরা বেগম। সেই রাতের কথা মনে করে শিউরে ওঠেন আনোয়ার। তিনি বলেন, 'আমরা এখনো ঘুমাইতে পারি না। ঘুমের মধ্যেও কান্নার আওয়াজ পাই। সকালে এলাকায় আইস্যা দেখি, লাশ আর লাশ! এই দৃশ্য সহ্য করা যায় না।' নন্দ কুমার দত্ত লেনের হায়দার ফার্মেসির মর্মান্তিক ঘটনার বর্ণনা দেন পস্নাস্টিক ব্যবসায়ী শরীফ হোসেন। এই সড়কে তার বসবাস ২৩ বছর ধরে। তিনি বলেন, 'আগুন লাগার আগে ফার্মেসিতে অন্তত নয়জন ছিল। ডাক্তার মঞ্জু ভাই, তার দুজন সহকর্মী, আর বাচ্চা কোলে আসা মহিলা.... আরও কেউ কেউ...... আগুন লাগার পরে বাঁচার জন্য শাটার নামায়া দিছিল..... ভাইরে... ভিতরে সব পুইড়া মরল। সকালে তাদের লাশ যখন বাইর করে।" বলতে বলতে কেঁদে ওঠেন শরীফ। তাকে সান্ত্বনা দিতে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠেন আনোয়ার হোসেনসহ চুড়িহাট্টার আরও দুই বাসিন্দা। আগুনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ওয়াহেদ ম্যানশনের তৃতীয় তলার বাসিন্দা মো. রফিকুল ইসলামকে পাওয়া যায় চুড়িহাট্টা মোড়ের এক কোণে। ফ্যালফ্যাল চোখে তিনি তাকিয়ে ছিলেন পোড়া বাসার দিকে। তিনি বলেন, 'বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে বের হয়ে আসতে পেরেছি। কীভাবে বের হয়ে গেছি সবাই জানি না।' ওয়াহেদ ম্যানশনের নিচতলাতেই একসঙ্গে ২৪টি মৃতদেহ পাওয়া যায়, সিঁড়ি ঘরের ফ্লোরে দলা পাকানো অবস্থায় ছিল পোড়া লাশগুলো। বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেও পারেনি হতভাগ্য মানুষগুলো। চকবাজারের ব্যবসায়ী নূর হোসেন মাত্র মিনিট কয়েকের জন্য প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। তিনি বলেন, 'মাত্র মিনিট কয়েক আগে আমি রানা-রাজুর দোকান আসছিলাম। আমার এক বন্ধু কামালও আমারে চা খাওয়াতে চাইছিল। আমি বললাম, কালকে খামু। 'একটু পরে জোরে জোরে আওয়াজ আর বিস্ফোরণ। চারপাশে আগুন আর আগুন। এমন ঘটনা আমি আর কখনো দেখি নাই। বিশ্বাস করেন, রাতে দুই চোখের পাতা এক করলে এখন খালি রানা-রাজু আর কামাল ভাইরে দেখি। কত ভালা ভালা মানুষগুলা কেমন কইরা চইলা গেল।' অগ্নিকান্ডের পর ধ্বংসস্তূপ থেকে মৃতদের লাশ বের করতে সহযোগিতা করেছিলেন মোহাম্মদ সুরুজ। মঞ্জুর ফার্মেসি, মদিনা ডেকোরেটর্স আর সড়ক থেকে ৩০টি লাশ তিনি নিজ হাতে উদ্ধার করেন। শনিবার দুপুরে তিনি ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন নন্দ কুমার দত্ত লেনে। বললেন, দুর্ঘটনার বর্ণনা শোনার পর তার দুই শিশুকন্যার মনেও বড় প্রভাব পড়েছে। 'আমার বড় মাইয়াডা ভয়ে আমারে সারাক্ষণ জড়ায়া থাকে। এই যে আসছি, সে তো আসতেই দিতে চাইতাছিল না। খালি কয়, আব্বা আবার যদি আগুন লাইগ্যা যায়, তুমি যাইও না।' রাসায়নিকের গুদামগুলো যেন মৃতু্যফাঁদ নন্দ কুমার দত্ত লেনের চাল ব্যবসায়ী মো. সালাউদ্দিন মনে করেন পস্নাস্টিক, রাসায়নিকের মজুদের কারণে আগুন এত বেশি বিস্তৃত হয়। তিনি বলেন, 'আমরা কতবার বলছি, আবাসিক এলাকা থেকে এসব বিপজ্জনক জিনিস সরান। থানার লোকজনের সামনেই এসব ব্যবসা হইত। থানায় গিয়া অভিযোগ দিয়াও তো কোনো লাভ হয় নাই। নিমতলীর ঘটনায় কারো শিক্ষা হয় নাই। এই এলাকার বাড়িওয়ালারাও বেশি টাকার লোভে গোডাউন ভাড়া দেয়, আর তাতে এসব মালামাল মজুদ করা হয়। দোষ তাদেরও কম না।' ওয়াহেদ ম্যানশনের উল্টো দিকের ভবনের মালিকানা চুড়িহাট্টা শাহী মসজিদের। সেই ভবনের পেছনে ছোট ঘরে হোটেলের গ্যাস সিলিন্ডারগুলো মজুদ করা হতো বলে এলাকাবাসী জানায়। নন্দ কুমার দত্ত লেনের বাসিন্দা আশিকউদ্দিন সৈনিক বলেন, 'ওই ভবনে বেআইনিভাবে মজুদ করা সিলিন্ডারগুলো একবার বের করে দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলাম আমরা। পারা যায়নি। বাড়ির পাশে এসব সিলিন্ডার রাখা মানেই যেন বাড়ির পাশে বোমা-বারুদের গোডাউন।' ওয়াহেদ ম্যানশনের উল্টো দিকে আনাস হোটেল। তার পেছনের ভবনের মালিক দুই ভাই সোহেল ও ইসমাইল। এ ভবনের নিচতলায়ও রাসায়নিকের গুদাম রয়েছে বলে জানান পাশের বাড়ির বাসিন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আলিম উদ্দিন। তিনি বলেন, 'আমাদের তিনতলা ভবনে কোনো ভাড়াটিয়া নেই। কোনো গোডাউনের জন্যও ভাড়া দেয়া নেই। আমরা ও চাচাদের পুরো পরিবার সেখানে বাস করি। কিন্তু আমাদের বাড়ির সামনের ভবনটিতে নানা ধরনের কেমিক্যালের গোডাউন হিসেবে ভাড়া দেয়া আছে। এসব তো আমাদের জন্য ভয়ঙ্কর বিপদের কারণ।' আলিম বলেন, 'সরকারের কাছে আমাদের আকূল-আবেদন এসব কেমিক্যালের গোডাউন যেন আবাসিক এলাকা থেকে সরিয়ে অন্যত্র নেয়া হয়। আমাদের জীবনের মূল্যের কথা যেন রাষ্ট্র একবার চিন্তা করে।' চুড়িহাট্টা মোড় থেকে এক মিনিটের দূরত্বে ১৫/১ নম্বর বাড়ির মালিকদের একজন মো. সোহেল বলেন, 'তাদের সামনের লাভলু সাহেবের বাড়ির পুরোটাই বিভিন্ন রাসায়নিকের গুদাম হিসেবে ভাড়া দেয়া আছে। এখন তো দেখছি এসব গোডাউন আমাদের মরণের ফাঁদ হয়ে দাঁড়িয়েছে।' রাসায়নিকের কারণেই জানমালের বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে মন্তব্য করে সোহেল বলেন, 'যারা আবাসিক ভবনে গোডাউন ভাড়া দিয়েছে, এর পরবির্তে বাসাবাড়ি হিসেবে যেন ভাড়া দেয়া হয় সেই ব্যবস্থা করতে হবে।' ১৪ নম্বরের পাঁচতলা বাড়ি 'আশিকিন স্কয়ারের' মালিকের ছেলে আশিকিন পারভেজ জানান, তাদের বাড়ির আশপাশের বিভিন্ন বাড়িতেই রাসায়নিকের গুদাম রয়েছে। 'এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে নিমতলীর আগুনের পরও আবাসিক ভবন থেকে কেমিক্যাল গুদাম সরানো গেল না। আইনশৃঙ্খলাবাহিনী যদি শক্ত অবস্থানে থাকত তাহলে এসব অব্যবস্থাপনা দূর করা সম্ভব হতো।' চুড়িহাট্টা মোড় এখন যেমন চুড়িহাট্টা এলাকায় আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত পাঁচটি ভবনসহ আশপাশের অন্তত ১০টি ভবন ছাড়া অন্যান্য ভবনে শুক্রবার দুপুর ১২টার দিকে বিদু্যৎ, পানি ও গ্যাস সংযোগ দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া চুড়িহাট্টা মোড়ের আগুনে পোড়া যানবাহনের অংশ, পারফিউম, প্রসাধনী ও অন্যান্য ছাইয়ের অংশ পরিষ্কার করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। বৃহস্পতিবার রাত ১২টা থেকে শুক্রবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত ১০০ পরিচ্ছন্নকর্মী এ কাজে অংশ নেন। ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিট এখনো সেখানে অবস্থান করছে। উৎসুক মানুষের ভিড় ঠেকাতে আছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও।