রাজনৈতিক ডামাডোলে ফের স্থবিরতার শঙ্কা

প্রকাশ | ০১ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০ | আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০২৩, ০০:৩৭

সাখাওয়াত হোসেন
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হলেই হরতালের মতো কঠোর কর্মসূচি দেবে বিএনপি। এক দফার যুগপৎ আন্দোলনে তাদের সঙ্গে থাকা দলগুলোও এই কর্মসূচি পালন করবে। চলতি মাসে অনুষ্ঠিত বিএনপির স্থায়ী কমিটির দুটি বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। দলের নীতিনির্ধারকরা বলছেন, অবৈধ সরকারকে হটিয়ে দেওয়ার জন্য হরতাল-অবরোধসহ যা যা করা দরকার গণতান্ত্রিক পন্থায় সব ধরনের কর্মসূচি হবে। সেজন্য নেতাকর্মী-সমর্থকসহ সবাইকে প্রস্তুতি নেওয়ার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। এবারের আন্দোলন 'ডু অর ডাই' হবে বলে জানান দিয়েছেন দলের শীর্ষ নেতারা। এদিকে আগামী ৩৬ দিনের মধ্যে অপরাজনীতি, নাশকতা ও গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র পরিহার করতে বিএনপির প্রতি আলটিমেটাম দিয়েছে আওয়ামী লীগ। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এ হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, এই আলটিমেটামে সংশোধন না হলে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপির অপরাজনীতির কালো হাত গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে। নির্বাচনের আগ পর্যন্ত নেতাকর্মীদের নিয়ে রাজপথে সতর্ক পাহারায় থাকার ঘোষণাও দিয়েছে ক্ষমতাসীন এ দলটি। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আগামী নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করার কথা বলা হয়েছে। তবে বর্তমান সরকারের অধীন না কি অন্য কোনো সরকার ব্যবস্থায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে তা এখন নির্ধারিত হয়নি। ফলে এ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে ক্রমেই উত্তেজনা সৃষ্টি হচ্ছে। পাল্টাপাল্টি বক্তব্য আর মাঠ দখলের হুঁশিয়ারি দিচ্ছে রাজনৈতিক জোটগুলো। নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক এ ডামাডোলে দেশে অর্থনৈতিক স্থবিরতা দেখা দেওয়ার আশঙ্কা প্রকট হয়ে উঠেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্বাচন এলে রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়- এটি স্বাভাবিক। তবে এ পরিস্থিতি যদি দীর্ঘায়িত হয় তবে অর্থনীতির জন্য তথা দেশের জন্য ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি হবে। এ নিয়েই আতঙ্কে পড়েছেন ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তারা। ব্যবসায়ীরা আতঙ্কে থাকার কথা স্বীকার করে বলেন, রাজনৈতিক কর্মকান্ডে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন ব্যবসায়ীরা। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, পরিবহণ ব্যবসায়ী, হকার ও শ্রমিক শ্রেণি সীমাহীন দুর্ভোগের শিকার হন। যা থেকে বাদ পড়ে না সাধারণ ভোক্তারাও। তাই সহিংস কর্মসূচি পরিহার করে সব পক্ষের সঙ্গে সমঝোতায় শন্তিপূর্ণ নির্বাচন চান তারা। এ প্রসঙ্গে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) নেতারা বলেন, রাজনীতি ও অর্থনীতি একে-অপরের পরিপূরক। একটির অবস্থা খারাপ হলে অন্যটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই রাজনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ হলে অর্থনীতিতে সরাসরি প্রভাব পড়বে। তবে তাদের অনেকে আশাবাদী, নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে যে উত্তেজনা সৃষ্টি হচ্ছে তা এবার সহিংস রূপ নেবে না। কারণ জ্বালাও-পোড়াও, সংঘাতপূর্ণ আন্দোলন মানুষ পছন্দ করে না। যা এরই মধ্যে নানাভাবে স্পষ্ট হয়ে গেছে। সংঘাতপূর্ণ আন্দোলনকারীদের দেশের মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বয়কট করেছে। এ বার্তা রাজনীতিবিদদের কাছেও স্পষ্ট। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও অর্থনীতিবিদ সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ব্যবসা-বাণিজ্য। শিল্প কারখানার উৎপাদনও কমে যায়। মানুষের মধ্যে এক ধরনের ভয়ভীতি কাজ করে। এতে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়। তিনি আরও বলেন, যখনই দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয় তখন উদ্যোক্তারা নতুন করে বিনিয়োগ করতে চান না। বিদেশিরাও সংঘাতপূর্ণ দেশে বিনিয়োগ করতে চান না। আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে এক ধরনের স্থবিরতা সৃষ্টি হয়। তাই রাজনৈতিক অস্থিরতা হলে দেশের অর্থনীতি সামগ্রিকভাবে পিছিয়ে পড়ে। নির্বাচন এলে রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তেজনা সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক। তবে এ পরিস্থিতি যদি দীর্ঘায়িত হয় তবে অর্থনীতির জন্য ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি হবে- যোগ করেন প্রবীণ এ অর্থনীতিবিদ। এদিকে তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর নেতারা বলেন, আমরা ব্যবসায়ীরা নিরাপদে ব্যবসা করতে চাই। এজন্য প্রয়োজন ব্যবসার সুষ্ঠু পরিবেশ। এটি নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। যারাই ক্ষমতায় থাকবে তারা এটি নিশ্চিত করবে। গার্মেন্টস খাত হরতাল অবরোধের আওতামুক্ত থাকলেও দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থির হলে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই আমরা সংঘাতময় পরিস্থিতি চাই না। একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন হবে- এটাই সবার প্রত্যাশা। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আসন্ন জাতীয় দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে শুধু ব্যবসায়ী কিংবা শিল্পপতিরাই নয়, সব পেশার মানুষের মধ্যেই নানামুখী উদ্বেগ-আতঙ্ক ক্রমেই জেঁকে বসছে। শহর থেকে গ্রামে, সর্বত্রই নির্বাচন নিয়ে আলোচনা চলছে। অনেকে তাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও আতঙ্ক প্রকাশ করছে। উৎসুক মানুষের প্রশ্ন, নির্বাচন কী হবে? হলে তা কোন প্রক্রিয়ায় হবে? নির্বাচন কতটা সুষ্ঠু হবে? নির্বাচন ঘিরে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ কতটা ভয়াবহ রূপ নেবে? আন্তর্জাতিক মহলের চাপ উপেক্ষা করে ক্ষমতাসীন সরকার দেশের সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন করলে আমদানি-রপ্তানিসহ বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্যে কী ধরনের প্রভাব পড়বে? এ জাতীয় হাজারও প্রশ্নের চাপে জর্জরিত পুরো দেশ। মাঝখানে চ্যাপ্টা হওয়ার অবস্থা অর্থনীতির। নির্বাচন ঘিরে ধীর হয়ে গেছে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি। বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ী-শিল্পপতির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় বেশ কিছুদিন ধরে ব্যবসা-বাণিজ্যে এক ধরনের মন্দাভাব বিরাজ করছে। নির্বাচন ঘিরে অনিশ্চয়তায় নতুন বিনিয়োগে ধীরগতি বেশ কিছুদিন থেকেই। ভোটের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই স্থবির হয়ে যাচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্য। বিশেষ করে কেউ নতুন কোনো উদ্যোগ নিচ্ছেন না। পুরনো ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙ্গা করার জন্যও নেই বিশেষ উদ্যোগ। একটু বড় লেনদেনের ক্ষেত্রেও বাধা হিসেবে দেখা দিচ্ছে নির্বাচন। অনিবার্য না হলে ছোটখাটো লেনদেনেও রাজি নন অনেকে। সবাই অপেক্ষা করছেন নির্বাচনের। নির্বাচনের অজুহাতে পাওনা টাকা কেউই দিচ্ছেন না জানিয়ে এফবিসিসিআইর একজন পরিচালক বলেন, নতুন করে কোনো কাজকারবারে জড়ানো তো দূরের কথা; নির্বাচনের দোহাই দিয়ে অতি জরুরি পাওনা টাকাও মানুষ দিতে চাচ্ছেন না। নিয়মিত লেনদেন করতেও মানুষ গড়িমসি করছেন। অবস্থা এমন, যেন ভোটেই সবকিছু আটকে গেছে। তবে নির্বাচন হবে কি না সে বিষয়ে আশঙ্কা রয়েছে সবার মনেই। ইলেকট্রিক্যাল সরঞ্জাম ব্যবসায়ী তামিম আহমেদ বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্যের খুব দুরবস্থা যাচ্ছে। মানুষ এখন বাড়ি-ঘর বানানোও বন্ধ করে দিয়েছে। ফ্ল্যাট বিক্রিও কম। নির্মাণকাজে চলছে স্থবিরতা। এসব কারণে পাইকারি ইলেক্ট্রিক মার্কেটগুলোয় বিক্রি অস্বাভাবিক কমে গেছে। রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোডে গাড়ির ব্যবসা করেন ফরিদ আহমেদ। তিনি জানান, আগে প্রতি মাসে ৫-৬টি গাড়ি বিক্রি করতেন। গত দুই মাসে একটিও বিক্রি হয়নি। কারণ রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় কেউ গাড়ি কেনার মতো বড় সিদ্ধান্ত নিতে সাহস পাচ্ছেন না। অনেকেই যোগাযোগ করেন কিন্তু চূড়ান্তভাগে এগিয়ে আসেন না। ইতালি প্রবাসী পিয়াল হোসেন বলেন, 'দেশে কিছু একটা করার ইচ্ছা দীর্ঘদিনের। কিন্তু রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে সাহস পাই না। নির্বাচনের পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেন, একটা দেশের অর্থনীতি তো বেশিদিন স্থবির থাকতে পারে না।' যেমন নির্বাচনই হোক, যে দলই ক্ষমতায় আসুক, ভোটের পর অর্থনীতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। এদিকে ব্যবসায়ীদের অনেকের আশঙ্কা, দেশের অর্থনৈতিক মন্দা সহসাই কেটে ওঠার সম্ভাবনা খুবই কম। বরং আগামীতে তা আরও বাড়তে পারে। তাদের মতে, করোনা মহামারি পরবর্তী ও রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতির পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন সংকটের মধ্যে নির্বাচনকে সামনে রেখে নতুন করে রাজনৈতিক অস্থিরতায় আমদানি-রপ্তানিসহ দেশের সার্বিক ব্যবসার জন্য বড় ধরনের আশঙ্কা তৈরি করবে। দেশের বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক একটি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার রাজীব আহমেদ বলেন, 'বিদেশি বায়াররা (ক্রেতা) আমাদের কাছে পরিস্থিতি জানতে চাচ্ছেন। তাদের আমরা আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছি। তবে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দল বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন নির্বাচন ঘিরে যেভাবে মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়েছে, তাতে সংঘাতময় পরিস্থিতি এড়িয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন কতটা সম্ভব হবে তা নিয়ে আমরা নিজেরাই সংশয়ে রয়েছি।' তিনি আরও বলেন, এমনিতেই আমাদের রপ্তানির অবস্থা ভালো নয়। রাজনৈতিক পরিস্থিতি জটিল হলে বিদেশি ক্রেতারা শঙ্কিত থাকবেন, তারা কারখানা পরিদর্শন করতে চাইবেন না। এতে রপ্তানি ব্যাহত হবে। ঢাকার অদূরে নরসিংদীর একটি টেক্সটাইল মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুলস্নাহ আল মামুন বলেন, গ্যাস-বিদু্যৎ পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। ক্রয়াদেশ কম হওয়ায় শিল্প অর্ধেক সক্ষমতায় চলছে। এমন অবস্থায় নির্বাচন ঘিরে উদ্বেগ রয়েছে। বর্তমানে বস্ত্র খাতের কঠিন পরিস্থিতিতে কোনো ধরনের রাজনৈতিক সহিংসতা হলে এই শিল্প টিকতে পারবে না- যোগ করেন তিনি। অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ডক্টর আহসান এইচ মনসুরও মনে করেন, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরি হলে এর বড় আঘাত আসে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ওপর। তিনি বলেন, দেশের অর্থনীতি ও রাজনীতি-দুটোই আগামী দিনগুলোতে খারাপের দিকে যাচ্ছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে দেশ থেকে অর্থ পাচার বাড়তে পারে উলেস্নখ করে তিনি বলেন, 'টাকা পাচার বাড়তে পারে, বিনিয়োগ থমকে যাবে।' এ ছাড়া রপ্তানিও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।