চলতি বছর ডেঙ্গুতে মৃতু্য হাজার ছাড়াল

এক দিনে আরও ১৭ মৃতু্য

প্রকাশ | ০২ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু চিকিৎসা নিতে আসা মানুষের উপচেপড়া ভিড়। প্রতিদিনই বাড়ছে নতুন রোগী ভর্তির সংখ্যা। ছবিটি রোববার কামরাঙ্গীর চর ৩১ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল থেকে তোলা -ফোকাস বাংলা
দেশে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে বাড়ছে মৃতু্যর সংখ্যা। চলতি বছর ডেঙ্গু রোগে মৃতু্য একের পর এক রেকর্ড ভাঙছে। ইতোমধ্যে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ভয়ংকর হয়ে উঠছে দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি। মৃতু্যর পাশাপাশি বাড়ছে সংক্রমণ। এরই মধ্যে মৃতু্যর দিক থেকে ছাপিয়ে গেছে বিশ্বের সব দেশকে। যতই দিন যাচ্ছে, ততই ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ হচ্ছে। এতে মানুষের মধ্যে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা বাড়ছে। গত এক দিনে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে আরও ১৭ জনের মৃতু্যর তথ্য দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এ নিয়ে চলতি বছরের ৯ মাসে এডিস মশাবাহিত রোগটিতে ১ হাজার ৬ জনের মৃতু্য হল। এ ছাড়া এক দিনে নতুন করে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে আরও ২ হাজার ৮৮২ জন বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। রোববার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের ইনচার্জ মো. জাহিদুল ইসলাম স্বাক্ষরিত ডেঙ্গুবিষয়ক নিয়মিত প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, শনিবার সকাল ৮টা থেকে রোববার সকাল ৮টা পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২ হাজার ৮৮২ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৬২৯ জন ও ঢাকার বাইরের দুই হাজার ২৫৩ জন। ২৪ ঘণ্টায় মারা যাওয়া ১৭ জনের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা নয়জন ও ঢাকার বাইরের আটজন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১ অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন দুই লাখ ছয় হাজার ২৮৮ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৮৩ হাজার ৮৫১ জন। ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হয়েছেন এক লাখ ২২ হাজার ৪৩৭ জন। একই সময় হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন এক লাখ ৯৫ হাজার ৯২৫ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৮০ হাজার ৮৩ জন এবং ঢাকার বাইরের এক লাখ ১৫ হাজার ৮৪২ জন। বর্তমানে সারা দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন নয় হাজার ৩৫৭ জন ডেঙ্গু রোগী। তাদের মধ্যে ঢাকায় তিন হাজার ১২০ জন এবং ঢাকার বাইরে ছয় হাজার ২৩৭ জন। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ডেঙ্গুর চারটি ভ্যারিয়েন্টের মধ্যে এ বছর তিনটিই সক্রিয়। আর এই একাধিক ডেঙ্গুর ধরনে মৃতু্য ও জটিলতা বাড়ছে। আর মশা আচরণ বদলে ফেলেছে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এডিস মশা বৃদ্ধির অনুকূল পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। একসময় বাংলাদেশে ডেঙ্গু রোগটি মৌসুমি রোগ বলে মনে করা হলেও, গত কয়েক বছর ধরে বছরজুড়ে এর প্রকোপ দেখা যাচ্ছে। আর চলতি বছর এডিস মশা ছড়িয়েছে দেশের সর্বত্র। বর্তমানে ঢাকার চেয়ে ঢাকার বাইরে সংক্রমণ ও মৃতু্যর ঘটনা বাড়ছে। এ বছর আগস্ট শেষে এডিস মশার প্রকোপ কমতে থাকবে বলে আশা করেছিলেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু তা হয়নি। এ বছর বিলম্বে বৃষ্টির কারণে মশার প্রকোপ কমেনি। এ ছাড়া গত কয়েক বছর ধরে অব্যাহতভাবে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ঘটলেও তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। তাই সামনের বছরগুলোতে ডেঙ্গুর প্রকোপ মহামারি আকার ধারণ করতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তারা। বিশেষজ্ঞরা ডেঙ্গুর ভয়াবহতা ঠেকাতে ডেঙ্গুর টিকা দেওয়ার ওপর জোর দিয়েছেন। তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে ডেঙ্গুর টিকার সফল পরীক্ষা হয়েছে। তবে এটি আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন নিয়ে প্রয়োগের কথা ভাবছে সরকার। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ১৯৬৫ সালে দেশে প্রথম ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। তখন ঢাকা ফিভার নামে এই রোগটি পরিচিত ছিল। কিন্তু ২০০০ সালের পর থেকে রোগটির সংক্রমণ বাড়তে শুরু করে। ওই বছর ডেঙ্গুতে ৯৩ জনের মৃতু্য হয়। আর ৫ হাজার ৫৫১ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন। ২০০১ সালে ২ হাজার ৪৩০ জন, ২০০২ সালে ৬ হাজার ২৩২ এবং ২০০৩ সালে ৪৮৬ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন। ওই ৩ বছরে যথাক্রমে ৪৪, ৫৮ এবং ১০ জন ডেঙ্গুতে মারা যান। এরপর ২০১৬ সাল পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা কখনোই ৪ হাজারের ঘর পার হয়নি। কোনো বছরই ১৪ জনের বেশি মানুষের মৃতু্য হয়নি। ২০১৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃতু্যর মাসভিত্তিক তথ্য মেলেনি। তবে এই ৬ বছরে দেশে প্রকোপ অতটা বেশি ছিল না। ২০১৯ সালে রেকর্ড ১ লাখ ১ হাজারের বেশি মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। তাদের মধ্যে ১৭৯ জনের মৃতু্য হয়। এরপর ২০২০ সালে ৭ জন, ২০২১ সালে ১০৫ জন এবং ২০২২ সালে রোগীর সংখ্যা ছিল সর্বমোট ৬২ হাজার ৩৮২ জন এবং ২৮১ জন মারা যান, যা ছিল দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। ওই বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে ডেঙ্গুতে ২৭ জনের মৃতু্য হয়। চলতি বছরের ২০ সেপ্টেম্বর ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে ২১ জন মারা যান, যা এক দিনে সর্বোচ্চ সংখ্যক মৃতু্য। এর আগেও গত ২ সেপ্টেম্বর ডেঙ্গুতে এক দিনে সর্বোচ্চ ২১ জনের মৃতু্যর কথা জানিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃতু্যর সরকারি পরিসংখ্যান গত ২৪ বছরের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। ডেঙ্গুর ভয়াবহতা থেকে রক্ষা পেতে হলে মশা নিধন করতে হবে। মশা মারার কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।