বেঁচে যাওয়া ইয়াসমিন আক্তারের বর্ণনায় বাঘাইছড়ি হত্যাকান্ড

প্রকাশ | ২০ মার্চ ২০১৯, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
রাঙামাটির বাঘাইছড়ি এলাকায় নির্বাচনী দায়িত্ব শেষে ফেরার পথে ব্রাশফায়ারে নিহত ৭ জনের মধ্যে ৬ জনের মরদেহ মঙ্গলবার ময়নাতদন্ত করা হয় -ফোকাস বাংলা
সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল, পাহাড়ের কোলে বাঘাইহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কেন্দ্রে সারাদিন ভোট হয়েছিল শান্তিপূর্ণভাবে। কিন্তু সন্ধ্যায় ভোটের সরঞ্জাম নিয়ে চাঁদের গাড়িতে করে ফেরার পথে পাশের উঁচু পাহাড় থেকে ছুটে এল গুলি। রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি-দিঘিনালা সড়কের নয় মাইল এলাকায় সোমবার সন্ধ্যার ওই হামলা কেড়ে নিয়েছে দুই ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাসহ সাতজনের প্রাণ। সবুজ পাহাড়ে এই সহিংসতা নাড়িয়ে দিয়েছে পুরো বাংলাদেশকে। দেশের পার্বত্য জেলাগুলোতে বিবদমান পাহাড়ি সংগঠনগুলোর মধ্যে হানাহানি আর হত্যা নতুন কোনো ঘটনা নয়। কিন্তু রাস্তার ওপর অ্যামবুশ করে ভোটগ্রহণের দায়িত্বে থাকা কর্মীদের এভাবে হত্যার ঘটনা নজিরবিহীন। দেশের বিভিন্ন স্থানের ১১৫টি উপজেলার সঙ্গে বাঘাইছড়ি উপজেলাতেও সোমবার ভোট হয়। তবে পাহাড়িদের সবচেয়ে বড় সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি-জেএসএস সমর্থিত প্রার্থীরা কারচুপির অভিযোগ এনে সকালেই ভোট বর্জনের ঘোষণা দিলে কিছুটা উত্তেজনা তৈরি হয়। এরপর সন্ধ্যায় ঘটে ওই হত্যাকান্ড। সেখানে ঠিক কী ঘটেছিল, তার একটি বর্ণনা পাওয়া যায় বাঘাইছড়ি উপজেলার মুসলিম বস্নক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ইয়াসমিন আক্তারের কথায়। নিজে প্রাণে বেঁচে ফিরতে পারলেও চোখের সামনে সহকর্মীদের খুন হতে দেখার পর স্বাভাবিক হতে পারছেন না তিনি। পোলিং অফিসারের দায়িত্ব দিয়ে ইয়াসমিনকে পাঠানো হয়েছিল বাঘাইহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে। দুর্গম পাহাড়ে নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে রোববার দুপুরেই তারা কেন্দ্রে পৌঁছে যান। সোমবার সকালে নির্ধারিত সময়েই ভোট শুরু হয়। 'পুরোটা সময় বেশ ভালোভাবে সব হচ্ছিল। ভোটাররা এসে ভোট দিচ্ছিলেন, শান্তিপূর্ণভাবেই চলছিল ভোটগ্রহণ। কোনো ঝামেলা ছাড়াই বিকাল ৪টায় ভোটগ্রহণ শেষ হলো। এরপর আমরা গণনাও শেষ করলাম।' ওই কেন্দ্রে চেয়ারম্যান পদে জয়ী হন জনসংহতি সমিতির এমএন লারমা অনুসারী অংশের প্রার্থী সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান সুদর্শন চাকমা। তার প্রতীক ছিল ঘোড়া। সুদর্শনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকা জনসংহতি সমিতির সন্তু লারমার অনুসারী অংশের সাধারণ সম্পাদক এবং উপজেলা পরিষদের গত মেয়াদের চেয়ারম্যান বড়ঋষি চাকমা ভোটের সকালেই জালিয়াতির অভিযোগ তুলে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন। নির্বাচনে তার প্রতীক ছিল দোয়াত কলম। ইয়াসমিন জানান, ফলাফল ঘোষণার পর ওই কেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করা প্রায় ২৫ জন গাদাগাদি করে একটি চাঁদের গাড়িতে উঠে রওনা হন বাঘাইছড়ির উদ্দেশে। কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার, পোলিং অফিসার ছাড়াও পুলিশ ও ভিডিপি সদস্যরা ছিলেন ওই গাড়িতে। তাদের গাড়ি যখন বাঘাইহাট পৌঁছায়, তখন সেখানে অপেক্ষা করছিল আরও দুটো চাঁদের গাড়ি। সাজেক ইউনিয়নের কংলাক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং মাচালং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট শেষে ভোটগ্রহণকর্মীরা ওই দুটি গাড়িতে করে তাদের সরঞ্জাম নিয়ে ফিরছিলেন। 'আমাদের তিনটি গাড়ি তখন একসঙ্গে বাঘাইছড়ির দিকে রওনা করল। আমাদের নিরাপত্তার জন্য সঙ্গে ছিল বিজিবির একটা টহল গাড়ি। চারটি গাড়ির বহর, সবার সামনে বিজিবির গাড়ি। তার পেছনেই ছিল আমাদের গাড়িটা।' ইয়াসমিন বলেন, তাদের গাড়িগুলো নয়মাইল এলাকায় পৌঁছামাত্র পাশের উঁচু পাহাড় থেকে পেছনের তিনটি গাড়ি লক্ষ্য করে বৃষ্টির মতো গুলি শুরু হয়। 'কিন্তু আমাদের গাড়িগুলো থামেনি। গুলি উপেক্ষা করে চালকরা গাড়ি টেনে চালিয়ে সরাসরি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সে আসে। এ এক বীভৎস অভিজ্ঞতা। কান্না, চিৎকার, রক্ত...। রক্তাক্ত চাঁদের গাড়ি থেকে নামানোর পর একে একে ছয়জনের মৃতু্য হয়। রাতে চট্টগ্রামের হাসপাতালে নেয়ার পথে মারা যান আরও একজন। নিহতরা হলেন- পোলিং অফিসার আমির হোসেন ও আবু তৈয়ব, আনসার-ভিডিপি সদস্য মিহির দত্ত, আল আমিন, বিলকিস আক্তার ও জাহানারা বেগম এবং মন্টু চাকমা। 'সারা দিন আমরা একসঙ্গে কাজ করলাম, সেই মানুষগুলো একের পর এক...,' বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন ইয়াসমিন আক্তার। একটু সামলে নিয়ে কিছুক্ষণ পরে তিনি বলেন, 'এটা ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা ভাই, মৃতু্যর দুয়ার থেকে ফিরে আসা। আমার সহকর্মী আমির হোসেন, তৈয়ব আলী মারা গেছে। আমার বান্ধবী কাঞ্চি, বড় ভাই বদিউজ্জামান, ওরা গুরুতর আহত। হতাহত সবাইতো আমার কমবেশি চেনা। সরকারি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কেন তাদের মরতে হলো?' 'কবে বন্ধ হবে এসব বর্বরতা। আর কত লাশ পড়বে পাহাড়ে? এর মধ্যে কীভাবে আমরা সরকারি দায়িত্ব পালন করব?' প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে ইয়াসমিন বলেন, 'পার্বত্য চট্টগ্রামে নির্বাচন কিংবা যেকোনো সরকারি দায়িত্ব পালন করা সবসময়ই কঠিন। আমাদের নানা ধরনের চাপে থাকতেই হয়। কিন্তু এ রকম ভয়াবহ বর্বরতা ভবিষ্যতে আমাদের আরও বেশি চাপে ফেলবে। আমি অনুরোধ করি, আপনি আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন।' মামলা হয়নি, ময়নাতদন্তের অপেক্ষা বাঘাইছড়ির ঘটনায় মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি থানায়; পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তারও করেনি। বাঘাইছড়ি স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সে নিহত ছয়জনের লাশ এখনো স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি। স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে আছে হাসপাতালের পরিবেশ। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ছুফি উলস্নাহ জানান, পোস্টমর্টেম করার জন্য মৃতদেহগুলো খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে। 'একের পর এক ঘটনায় আমরা বেশ চাপের মধ্যে আছি। এর মধ্যে বিলাইছড়িতে আজ আরেকটি হত্যাকান্ড ঘটে গেছে। দুর্গম এলাকা আর বাস্তবতার কারণেই দ্রম্নত কিছু করা কঠিন হচ্ছে।' ৬ জনের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন এদিকে বাঘাইছড়িতে ব্রাশফায়ারে নিহত ছয়জনের ময়নাতদন্ত খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে সম্পন্ন হয়েছে। ময়নাতদন্ত শেষে লাশ বাঘাইছড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে স্বজনদের কাছে মরদেহ হস্তান্তর করা হয়। মঙ্গলবার দুপুরে বাঘাইছড়ি থেকে সড়কপথে পুলিশ ও বিজিবির পাহারায় ছয়টি মরদেহ খাগড়াছড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর ময়নাতদন্ত শুরু হয়। বেলা সাড়ে ৩টার দিকে ময়নাতদন্ত শেষ হয়। লাশের সঙ্গে আসা বাঘাইছড়ি থানার পরিদর্শক (তদন্ত) জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ময়নাতদন্ত শেষে লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। লাশগুলো বাঘাইছড়ি নিয়ে স্বজনদের হাতে তুলে দেয়া হয়। এ ছাড়া সোমবারের ঘটনার ব্যাপারে মামলার প্রস্তুতি চলছে। সন্ত্রাসীদের ধরতে সেনা, বিজিবি ও পুলিশের সমন্বয়ে যৌথ অভিযান চলছে। তদন্ত কমিটি গঠন বাঘাইছড়িতে ভোট শেষে ফেরার পথে ভোটগ্রহণকারী কর্মকর্তাদের ওপর ব্রাশফায়ারের ঘটনায় সাত সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। অতিরিক্ত সচিব দীপক চক্রবর্তীকে কমিটির প্রথম প্রধান এবং রাঙ্গামাটির অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ নজরুল ইসলামকে সদস্যসচিব করা হয়েছে। কমিটিকে ১০ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার মঙ্গলবার বিকালে এই কমিটি গঠন করেন। বিভাগীয় কমিশনার মো. আবদুল মান্নান বলেন, তদন্ত কমিটিতে পুলিশ, বিজিবিসহ বিভিন্ন দপ্তরের প্রতিনিধিদের রাখা হয়েছে। ১০ কর্মদিবসে কমিটি প্রতিবেদন দেবে।