রোববার রাজধানীর গুলিস্তান এলাকায় ঢাকা ট্রেড সেন্টার মার্কেটের সামনের সড়কে একটি বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা -যাযাদি
বিএনপি-জামায়াতের ডাকা টানা ৪৮ ঘণ্টা অবরোধের প্রথম দিন রোববার সারা দেশে ১২টি যানবাহনে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে খোদ রাজধানীতে দিন দুপুরে যাত্রীবাহী বাসে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। তবে অবরোধ কর্মসূচির মধ্যেই ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় দেখা গেছে তীব্র যানজট। আতঙ্কের মধ্যেই স্বল্প পরিমাণে দূরপালস্নার বাস যাতায়াত করেছে। কর্মসূচি পালনে তেমন সরব ছিল না অবরোধ আহ্বানকারী দলগুলো।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষের মিডিয়া সেলের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহজাহান শিকদার জানান, শনিবার দিনগত রাত ১১টার দিকে ঢাকার আগারগাঁও বাংলাদেশ বেতার ভবনের সামনে ভূঁইয়া পরিবহণের একটি যাত্রীবাহী বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। খবর পেয়ে মোহাম্মদপুর ফায়ার স্টেশনের দু'টি ইউনিট আগুন নেভায়। এমন ঘটনার মাত্র ১০ মিনিট পরেই ঢাকার গাবতলী বাস টার্মিনাল এলাকায় পদ্মা লাইন নামের একটি যাত্রীবাহী বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। কল্যাণপুর ফায়ার স্টেশনের ২টি ইউনিট দ্রম্নত আগুন নিভিয়ে ফেলে। এছাড়া গত ২ ডিসেম্বর শনিবার দিবাগত রাত ৯টার দিকে ঢাকার সায়েদাবাদ এলাকায় একটি বাসে আগুন দিয়ে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা।
পুলিশ জানায়, শনিবার রাত ৯টার দিকে ফার্মগেট ফার্মভিউ সুপার মার্কেটের সামনের রাস্তায় সন্ত্রাসীদের ককটেল হামলায় বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তাসহ দুই জন দগ্ধ হন।
শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড পস্নাস্টিক সার্জারী ইনস্টিটিউট সূত্রে জানা গেছে, চিকিৎসাধীন এমদাদুল হক খান (৫৬) বাংলাদেশ ব্যাংকের যুগ্ম-পরিচালক। অপরজন নাজমুস শাহাদাত আলম (৩৮) একটি কোম্পানিতে চাকরি করেন বলে জানা গেছে।
তেজগাঁও থানার ওসি অপূর্ব হাসান জানান, দগ্ধরা ঢাকার মোহাম্মদপুর থানাধীন সলিমুলস্নাহ রোডের বসবাস করেন। সন্ধ্যায় ঢাকার কারওয়ান বাজারে কাজ শেষে বাসায় ফিরছিলেন। ফার্মভিউ সুপার মার্কেটের সামনের পৌঁছলে ককটেল হামলায় তারা দগ্ধ হন। স্থানীয় জনতা প্রথমে তাদের ফার্মগেটের আল রাজি
হাসপাতালে নিয়ে যান। পরে তাদের উন্নত চিকিৎসার জন্য বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছে। হামলাকারীদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
এদিকে রোববার ভোর ৫টার দিকে ঢাকার সবুজবাগে ১টি যাত্রীবাহী বাসে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। দুপুর আড়াইটার দিকে ঢাকার গুলিস্তানের ফুলবাড়িয়া এলাকায় ভিক্টর ক্লাসিক নামের একটি যাত্রীবাহী বাসে আগুন ধরিয়ে দেয় অগ্নিসন্ত্রাসীরা। ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তরের দু'টি ইউনিট দ্রম্নত আগুন নিভিয়ে ফেলে।
ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা গেছে, গত ১ ডিসেম্বর থেকে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে ১২টি যানবাহনে আগুন লাগানোর ঘটনা ঘটেছে। যার মধ্যে ঢাকা সিটিতে ৫টি, গাজীপুরে ৫টি, সিলেটে ১টি ও দিনাজপুর ১টি। ক্ষতিগ্রস্ত যানবাহনের মধ্যে ৩টি কাভার্ড ভ্যান, ৬টি বাস ও ৩টি ট্রাক রয়েছে। আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ১৯টি ইউনিট এবং ৯৬ জন ফায়ার ফাইটার কাজ করেছেন। এছাড়াও গত ১ ডিসেম্বর রাত ২টার দিকে সিলেটের ছাতকের জয়কলম এলাকায় ১টি বাসে ও শনিবার দিবাগত রাত ১টার দিকে দিনাজপুরের রামপুর বাজারে ১টি ত্রাকে আগুন দেয় অগ্নিসন্ত্রাসীরা।
ফায়ার সার্ভিসের পরিসংখ্যান মোতাবেক, গত ২৮ অক্টোবর থেকে ৩ ডিসেম্বর সকাল দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত সারা দেশে ২৪৫টি অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটিয়েছে অগ্নিসন্ত্রাসীরা। এর মধ্যে ২৩৯টি যানবাহন ও ১৫টি স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ এবং ১টি অ্যাম্বুলেন্স ভাংচুরের ঘটনা রয়েছে। এর মধ্যে অগ্নিসংযোগের শিকার হয়েছে ১৫০টি বাস, ট্রাক ৩৯টি, কাভার্ড ভ্যান ২০টি, মোটর সাইকেল ৮টি ও অন্য গাড়ি ২২টি।
সরেজমিনে রোববার গাবতলী, শ্যামলী, মিরপুর-১, চাইনিজ, শাহ আলী (রা.) মাজার, ঢাকার আগারগাঁও বাংলাদেশ বেতার, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের সামনে, বিজয় সরণী, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, বাংলা মোটর, শাহবাগ মোড়, পুরানা পল্টন, নয়া পল্টন, মতিঝিল ও গুলিস্তানসহ আশপাশের এলাকা ঘুরে দেখা গেছে জীবনযাত্রা ছিল অনেকটাই স্বাভাবিক। এসব এলাকায় মাঝে মধ্যে তীব্র যানজটও চোখে পড়েছে।
তবে নগরীতে গণপরিবহণের চলাচল তুলনামূলকভাবে কিছুটা কম ছিল। ব্যক্তিগত যানবাহন অন্য দিনের মতোই স্বাভাবিকভাবে চলাচল করেছে। এছাড়া ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার দাপট ছিল রাজধানী জুড়েই। এছাড়া মহাখালী, গাবতলী ও সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে বেশ কিছু দূরপালস্নার বাস ছেড়ে গেছে। যাতায়াত করেছে পণ্যবাহী যানবাহনও। যদিও তা স্বাভাবিক দিনের তুলনায় অনেকাংশেই কম। যদিও রাজধানী ঘুরে কোথাও অবরোধের সমর্র্থনে বিএনপি-জামায়াতসহ সমমনা দলগুলোর কোনো তৎপরতা চোখে পড়েনি।
আমাদের কালিয়াকৈর (গাজীপুর) প্রতিনিধি জানান, রোববার ভোরে গাজীপুরের কালিয়াকৈর থানাধীন গোয়ালবাথন এলাকায় চলন্ত একটি ট্রাকে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় ট্রাক চালকসহ দু'জন দগ্ধ হয়েছেন। ট্রাক রড বোঝাই ছিল। পরে ফায়ার সার্ভিসের ৩টি ইউনিট আধা ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। ট্রাকসহ মালামাল পুড়ে গেছে। দগ্ধ চালককে উদ্ধার করে কালিয়াকৈর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সে ভর্তি করা হয়েছে। এছাড়া গাজীপুরের জয়দেবপুরে ২টি কাভার্ড ভ্যানে ও টঙ্গীর মেঘনা রোডে ১টি কাভার্ড ভ্যানে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা।
কালিয়াকৈর উপজেলার নিবার্হী কর্মকর্তা তাজওয়ার আকরাম সাকাপি ইবনে সাজ্জাদ জানান, অগ্নিসন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তারে কাজ করছে পুলিশসহ সংশ্লিষ্টরা। যদিও রোববার সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। তবে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে।
প্রসঙ্গত, গত ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশে ব্যাপক নাশকতার ঘটনার পরদিন থেকেই সপ্তাহের ৫ কর্মদিবসের মধ্যে একদিন বাদ দিয়ে সকাল-সন্ধ্যা অবরোধ বা হরতালের মতো কর্মসূচির ডাক দিচ্ছে বিএনপি-জামায়াতসহ সমমনা দলগুলো। তারই ধারাবাহিকতায় গত ৩০ নভেম্বর বিকালে এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে রোববার ও সোমবার টানা ৪৮ ঘণ্টা অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
পুলিশ মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুলস্নাহ আল মামুন ইতোমধ্যেই রাজনৈতিক কর্মসূচিকে ঘিরে নাশকতামূলক কর্মকান্ড ঠেকাতে সারাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। সেই সঙ্গে অপরাধীদের গ্রেপ্তারে চলমান অভিযানের তীব্রতা আরও বাড়ানোর নির্দেশনা জারি করেছেন।
র্
যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, ঢাকাসহ সারা দেশে অবরোধে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতের্ যাবের চার শতাধিক টহল দল কাজ করছে।
বিজিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরীফুল ইসলাম জানান, অবরোধে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ঢাকা ও এর আশপাশে ২৩ পস্নাটুনসহ সারা দেশে ১৬২ পস্নাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।