'স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ এখন একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য'

প্রকাশ | ০৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০

বীরেন মুখার্জী
১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর সারা দেশের রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে পাকিস্তানি বাহিনী। সম্মিলিত বাহিনী চারদিক থেকে এগিয়ে আসতে থাকে। যুদ্ধে ব্যাপক সুফল পেতে থাকে মিত্রবাহিনী। মুজিবনগর থেকে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ জাতির উদ্দেশে বেতার ভাষণে বলেন, 'স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ এখন একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য। পাকিস্তানি হানাদাররা এখন প্রাণ বাঁচাতে পালাচ্ছে। বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের পরাজয় এখন কেবল সময়ের অপেক্ষা।' ওই বেতার ভাষণে তিনি ভুটান ও ভারতের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে বিশ্বের গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর কাছে আবেদন জানান। এদিকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল এস এইচ এফ জে মানেকশ পাকিস্তানিদের উদ্দেশে তার বার্তায় বলেন, 'সমুদ্রপথে পালানোর সব পথ আমরা বন্ধ করে দিয়েছি। ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ না করলে নিশ্চিত মৃতু্যর হাত থেকে কেউ তোমাদের রক্ষা করতে পারবে না। যদি তোমরা আত্মসমর্পণ করো, তবে জেনেভা চুক্তি অনুযায়ী তোমাদের প্রতি মানবিক আচরণ করা হবে।' আকাশবাণী রেডিও থেকে জেনারেলের এই বার্তা উর্দু, হিন্দি ও পশতুন ভাষায় প্রচারিত হয়। মূলত এটি ছিল পাকিস্তান বাহিনীর উদ্দেশে মিত্রবাহিনীর চূড়ান্ত ও কঠোর বার্তা। এই দিন বাংলাদেশের সামগ্রিক যুদ্ধ পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে মিত্রবাহিনী তিনটি ব্যবস্থা নেয়। প্রথম ব্যবস্থায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়। দ্বিতীয় ব্যবস্থায় লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরাকে বলা হয় দ্রম্নত ঢাকার দিকে এগিয়ে যেতে। তৃতীয় ব্যবস্থায় একটি ব্রিগেডকে বাংলাদেশের হালুয়াঘাট থেকে ময়মনসিংহের দিকে এগিয়ে আনা হয়। একাত্তরের ৮ ডিসেম্বর মুক্ত হয় কুমিলস্না, মৌলভীবাজার, বরিশাল, ঝালকাঠি, চাঁদপুর, পিরোজপুরসহ বিভিন্ন এলাকা। বিজয় উলস্নাসে মেতে ওঠে মুক্তাঞ্চলের বাঙালিরা। উত্তোলন করা হয় স্বাধীন দেশের পতাকা। ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান বিভিন্ন ভাষায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়ে আকাশ থেকে লিফলেট ছড়িয়ে দেন এই দিনে। ডিসেম্বরের এই দিনে বাংলাদেশের পূর্ব সীমান্ত থেকে মিত্রবাহিনীর সব কয়টি ডিভিশন এ দিন প্রচন্ড গতিতে ঢাকার দিকে এগোতে থাকে। দুপুরে বরিশাল থেকেও পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তারা গানবোট, লঞ্চ ও স্টিমারে করে গোপনে পালায়। ভারতীয় নৌবাহিনী রাতে বিমান বহর থেকে বোমা নিক্ষেপ করে বরিশাল, বাকেরগঞ্জ ও পটুয়াখালীতে পাকিস্তান বাহিনীর সৈন্য, অস্ত্র ও সরঞ্জামাদিসহ তিনটি বার্জের সলিল সমাধি ঘটায়। ফলে সমুদ্রপথে পাকিস্তানি বাহিনীর পালানোর পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। মিত্রবাহিনী আক্রমণ জোরদার করতে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সব বিদেশি জাহাজকে নিরাপদে বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিয়েছিল। মোংলার চালনা ও খুলনায় নৌবাহিনীর কমান্ডো হামলা চালানোর জন্য ভারতীয় নৌবাহিনী ও বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনী 'পদ্মা' ও 'পলাশ' গানবোট নিয়ে ফোর্স 'আলফা' অপারেশনে গড়ানিখালে দিয়ে এগিয়ে আসতে থাকে। এই দিন রাতে সম্মিলিত বাহিনী কুমিলস্না বিমানবন্দরে পাকিস্তান বাহিনীর ২২ বেলুচ রেজিমেন্টের প্রধান ঘাঁটিতে আক্রমণ শুরু করে। মিত্রবাহিনীর ১১ গুর্খা রেজিমেন্টের আর কে মজুমদারের নেতৃত্বে কুমিলস্না বিমানবন্দরের তিন দিক থেকে আক্রমণ চালানো হয়। সারা রাতের যুদ্ধে ২৬ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। একপর্যায়ে পাকিস্তান সেনাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা বিমানবন্দরের প্রধান ঘাঁটি দখল করে মুক্তিবাহিনী। কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা আত্মসমর্পণ করে। অন্যদিকে এই দিনে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে যুদ্ধবিরতি পালন ও সৈন্য প্রত্যাহারের জন্য ভারত এবং পাকিস্তানের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রস্তাব পাস হয়। সাধারণ পরিষদে ভারতীয় প্রতিনিধি সমর সেন বলেন, 'বাংলাদেশকে অবশ্যই স্বীকার করে নিতে হবে পাকিস্তানকে। উপমহাদেশে শান্তি পুনঃস্থাপনের জন্য আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে হবে। বাংলাদেশ সরকারের কাছে গ্রহণযোগ্য না হলে জাতিসংঘের কোনো প্রস্তাবই বাস্তবায়ন করা যাবে না।' সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী এলেকসি কোলিগিন বলেন, 'ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে মধ্যস্থতা করার সম্ভাবনা আপাতত আছে বলে মনে হয় না।' এই দিন নয়াদিলিস্নর মার্কিন দূতাবাসের সামনে সংসদ সদস্য চন্দ্র শেখর, জ্যোতির্ময় বসু, ইন্দ্রিজিৎ গুপ্ত, সুভদ্রা যোশীসহ বিরোধী ও ৩০ জন কংগ্রেস সদস্য বিক্ষোভ দেখান। তারা স্স্নোগান দেন, 'মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এশিয়া ছাড়' এবং 'শেখ মুজিব জিন্দাবাদ।' এদিকে জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানি প্রতিনিধি দলের নেতা হিসেবে নিউইয়র্কের উদ্দেশে পেশোয়ার ত্যাগ করেন। রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী তার '৭১ এর দশমাস' গ্রন্থে লিখেছেন, বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধের তীব্রতা বাড়তে থাকে এই দিনে। প্রতিটি যুদ্ধক্ষেত্রে পাকিস্তান বাহিনী পর্যুদস্ত হয়। পাকিস্তান বাহিনী দিনাজপুরের কান্তনগরে একটি সেতু উড়িয়ে মিত্র-মুক্তিবাহিনীর অগ্রগতি রোধের চেষ্টা করলে প্রচন্ড লড়াই হয়। পাকিস্তান বাহিনীর ঢাকার সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে দশবার বিমান হামলা চালায় মিত্রবাহিনী। ৮ ডিসেম্বর জামালপুরে অবস্থানরত ভারতীয় মিত্র বাহিনীর অনুরোধে কাদেরিয়া বাহিনীর কমান্ডার কাদের সিদ্দিকির নেতৃত্বে কাদেরিয়া বাহিনীর বড় একটি দল টাঙ্গাইলে চূড়ান্ত হানাদারমুক্ত অভিযান না চালিয়েই জামালপুরের দিকে যাত্রা করে। পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে এই দিন তুমুল লড়াই চলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হিলি, সুনামগঞ্জ, ছাতক, জয়ন্তিয়াপুর, লালমনিরহাট, দুর্গাপুর, হালুয়াঘাট ও আখাউড়ায়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া মুক্তিবাহিনীর একটি দল ব্রাহ্মণবাড়িয়া হানাদারমুক্ত করে আশুগঞ্জের দিকে এগিয়ে যায়। এর আগে ভারতীয় বাহিনীর ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশনের ভারতীয় সেনারা আখাউড়া-ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রেললাইন ও উজানিসার রোড দিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে এগিয়ে গিয়ে এক পর্যায়ে বিনা বাধায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া হানাদার মুক্ত করে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া দখল করে একদল এগোয় আশুগঞ্জের দিকে। এই দিন কুমিলস্নার সাধারণ মানুষ, সিভিল প্রশাসন, বীর মুক্তিযোদ্ধা, মিত্রবাহিনী এবং ৯ বেঙ্গল-এর অধিনায়ক মেজর (পরবর্তী সময়ে মেজর জেনারেল এবং বীর প্রতীকে ভূষিত) আইনুদ্দিনের উপস্থিতিতে তৎকালীন পশ্চিম পূর্বাঞ্চলের প্রশাসনিক কাউন্সিলের চেয়ারম্যান জহুর আহমেদ চৌধুরী দলীয় পতাকা এবং কুমিলস্নার প্রথম প্রশাসক অ্যাডভোকেট আহমেদ আলী কুমিলস্না টাউন হল ময়দানে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। এই দিন এস ফোর্স কমান্ডার লে. কর্নেল কে এম শফিউলস্নাহ ফোর্স নিয়ে মাধবপুর হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল পৌঁছান। মেজর সুবিদ আলী ভূঁইয়া রোড বস্নক করে চান্দুরা থেকে সরাইল এলাকা শত্রম্নমুক্ত করেন। ১১ বেঙ্গল পাইকপাড়ায় এলে মেজর নাসিম শাহবাজপুর, সরাইল এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেন। এভাবেই মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি দিন রচিত হতে থাকে বাঙালির বিজয়গাথা। তথ্যসূত্র : '৭১ এর দশমাস', রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র পঞ্চম, ষষ্ঠ, একাদশ, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খন্ড।