ডিমের দাম আর কত বাড়বে?

বাজারে প্রতি ডজন ফার্মের ডিমের দাম ১১০ টাকা এক বছরে প্রতিহালি ডিমের দাম বেড়েছে ৩৮ শতাংশ খাদ্যের অতিরিক্ত দাম ডিমের উৎপাদন খরচ বাড়িয়েছে চাহিদা ও উৎপাদনে বড় ব্যবধান তৈরি হয়েছে

প্রকাশ | ২৪ মার্চ ২০১৯, ০০:০০

আহমেদ তোফায়েল
ডিমের বাজারে তৈরি হওয়া অস্থিরতায় সাধারণ মানুষ পড়েছেন বিপাকে। ব্যবসায়ীরা দাবি করছেন, ডিমের উৎপাদন কমে যাওয়ার কারণেই দাম বেড়েছে। চাহিদা ও উৎপাদনে বড় ব্যবধান তৈরি হওয়ায় ডিমের বাজারের এই হাল। আর ক্রেতারা বলছেন, সরকারের বাজার মনিটরিংয়ের দুর্বলতার কারণে ব্যবসায়ীরা অস্বাভাবিক মুনাফা করছেন। রাজধানীর কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ফার্মের মুরগির প্রতি হালি ডিম বিক্রি হচ্ছে ৩৭-৩৮ টাকায়। তবে ডজন হিসেবে এই ডিম বিক্রি হচ্ছে ১১০ টাকায়। রাষ্ট্রায়ত্ত বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বলছে, শুক্রবার বাজার বিশ্লেষণের তথ্যানুযায়ী, এক বছর আগে এই সময়ে প্রতি হালি ডিম যে দামে বিক্রি হয়েছে তার চেয়ে প্রায় ৩৮ শতাংশ বেশি দামে এখন বিক্রি হচ্ছে। টিসিবি বলছে শুক্রবার ফার্মের প্রতি হালি ডিম বিক্রি হয়েছে ৩৩ থেকে ৩৬ টাকায়। এক বছর আগে যা ছিল ২৪ থেকে ২৬ টাকা। এ বিষয়ে তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতি মো. হানিফ মিয়া যায়যায়দিনকে বলেন, 'উৎপাদন অনেক কমে গেছে। নানা সংকটে উৎপাদন কমেছে। এই গ্যাপের কারণে দাম বেড়েছে ডিমের। বাড্ডার গুদারাঘাট কাঁচা বাজারের সাইদুল এন্টারপ্রাইজের মালিক সাইদুল ইসলাম জানান, তিনি প্রতি হালি ডিম ৩৭ টাকায় বিক্রি করছেন। পাইকারিতে দাম বেশি। তাই তিনিও বেশি দামে বিক্রি করছেন। রাজধানীর মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটের জনতা ব্রয়লার হাউজের শিবলু হোসেন জানান, ফার্মের মুরগির ডিম তিনি ১১০ টাকা ডজন বিক্রি করছেন। আর হালি ৩৭ টাকা। বেশিদামে কেনা, তাই বেশি দামেই বিক্রি করতে হচ্ছে। তবে এখনি দাম কমার কোনো সুযোগ নেই। এক মাস আগেও তিনি এক ডজন ১০০ টাকায় বিক্রি করেছেন। গত সপ্তাহ থেকে দাম বাড়তে শুরু করেছে। তার জানা মতে, ফার্মে উৎপাদন কমে গেছে। এরফলে মোকামেও সরবরাহ কমে গেছে। তাই বেশি দামে ডিম ক্রয় করে বেশি দামেই বিক্রি করতে হচ্ছে তাকে। শিবলুর মতো মোহাম্মদপুর জনতা মার্কেটের আক্তার বলেন, ডিমের দাম অনেক বেশি। ডজন ১১০ টাকা। দাম বেশি কেন উত্তরে তিনি বলেন, তাদের করার কিছু নেই। মোকাম থেকে বেশি দামে কেনা। তাই বেশি দামেই বিক্রি করতে হচ্ছে। ডিমের দাম বাড়ার কারণ সম্পর্কে ব্যবসায়ীরা বলছেন, এক বছর ধরে খামারিরা ডিমের ভালো দাম না পেয়ে উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছেন। নানা কারণে খামারি পর্যায়ে কমপক্ষে এক-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত উৎপাদন কমে গেছে। ব্যবসায়ীদের মতে, উৎপাদন থেকে খামারিদের সরে আসার বড় কারণ খাদ্যের অতিরিক্ত দাম। অনেককে আবার উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামেও বিক্রি করতে হয়েছে। বাড়তি খরচ করে যথাযথ দাম না পেয়ে অনেকেই ডিমের উৎপাদন থেকে সরে এসেছে। তবে এখন আবার ডিমের ভালো দাম থাকায় কেউ কেউ উৎপাদনে ফিরছে। তবে উৎপাদন আগের অবস্থায় যেতে আরও কিছুটা সময় লাগবে বলে জানান তারা। বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) হিসাব মতে, দেশে বর্তমানে ডিমের বাণিজ্যিক উৎপাদন দৈনিক প্রায় তিন কোটি ৮০ লাখ। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, বাণিজ্যিক উৎপাদন এবং গৃহপালিত মুরগি, হাঁস ও কোয়েল পাখির ডিম হিসাব করলে দৈনিক গড় উৎপাদন চার কোটি ৭১ লাখের ওপর। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ডিম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে এক হাজার ৬৬৫ কোটি পিস। তরে লক্ষ্যমাত্রানুযায়ী ডিমের উৎপাদন সেভাবে বাড়ছে না। এ বিষয়ে ওয়ার্ল্ড পোল্ট্রি সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ শাখার সাধারণ সম্পাদক মাহবুব হাসান বলেন, 'গত দেড় বছর ধরেই খামারিরা ঠিকমতো দাম পাননি। সে কারণে অনেক ছোট ছোট খামার বন্ধ হয়েছে বা ডিমের উৎপাদন থেকে সরে এসেছে। এর মধ্যে খাদ্যের দাম একটি বড় কারণ। কিন্তু এখন আবার চাহিদা বেড়েছে। এ কারণে অনেকেই আবার উৎপাদনে ফিরছে। এতে ধীরে ধীরে দাম আবার স্বাভাবিক হবে। তবে ক্রেতাদের প্রশ্ন ডিমের দাম আর কত বাড়বে? এ প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই কারো কাছে। ক্রেতাদের অভিযোগ, ব্যবসায়ীদের একটি অংশ সরকারের বাজার মনিটরিংয়ের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগ নিয়ে অবৈধ মুনাফা করছেন। ওয়ার্ল্ড পোল্ট্রি সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা গেছে 'কয়েকটি কারণে ডিমের দাম বেড়েছে। বছর খানেক আগে বার্ড ফ্লুতে অনেক মুরগি মারা যায়। এতে মুরগির উৎপাদন কমে যায়। ফলে ডিমও কম উৎপাদন হয়েছে। প্রতিটি ডিম উৎপাদনে খরচ হয় ছয় টাকা। কিন্তু খামারিদের বেচতে হয়েছে চার থেকে সাড়ে চার টাকায়। ওই লোকসানের ফলে অনেক খামারি মুরগি বেঁচে দিয়েছেন। এতে প্রোডাকশন কমে গেছে। এখন বাজারে ডিমের চাহিদাও বেড়ে গেছে। ফলে দাম বেড়ে গেছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, ডিমের দাম বাড়ার আরেকটি বড় কারণ মধ্যস্বত্বভোগী। খামারি থেকে ভোক্তার মাঝে একটি শ্রেণি আছে যারা দুই থেকে আড়াই টাকা লাভ করেন। এটা নিয়ে ভাবতে হবে। তাদের মতে, সরাসরি খামারি থেকে খুচরা বাজারে ডিম পৌঁছাতে পারলে ডিম প্রতি আরও দুই টাকা কমে ক্রেতারা কিনতে পারবেন। কবে নাগাদ বাজার স্থিতিশীল হতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে খামারিরা বলেন, খামারে নতুন করে মুরগি ওঠালেও ডিম আসতে সময় লাগবে অন্তত চার থেকে পাঁচ মাস। এই সময়ের মধ্যে দাম কমার কোনো সম্ভাবনা নেই। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, বর্তমানে বাজারে চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ অপ্রতুল। কারণ, গত এক দেড় বছর ধরে ডিমের দাম বিভিন্ন কারণে নিম্নমুখী ছিল। তখন অনেক ব্যবসায়ী লোকসান দিয়ে চলে গেছে। তারা আর পুঁজি নিয়ে ব্যবসায় ফিরে আসতে পারেননি। সেসব খামারি যে পরিমাণ ডিম বাজারে সরবরাহ করতো সেই পরিমাণ ডিম তো বাজারে আসছে না। অথচ বাজারে তো চাহিদা রয়েই গেছে। ব্যবসায়ীরা জানান, প্রতি পিস ডিমের দাম ৭ টাকা না পেলে উৎপাদনকারী খামারি লোকসানের মুখে পড়বেন। কারণ প্রতি পিস ডিমের উৎপাদন খরচ ৬ টাকা ১৫ পয়সা থেকে ৬ টাকা ৫০ পয়সা পর্যন্ত। কাজেই প্রতি পিস ডিমের দাম ৭ টাকা পেতে হবে খামারিকে। জানতে চাইলে বাংলাদেশ পোল্ট্রি কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলের কনভেনার মসিউর রহমান খান বলেন, লোকসান দিয়ে দিয়ে যেসব খামারি সর্বস্বান্ত হয়ে চলে গেছেন, তাদের ফিরিয়ে আনার কোনো উদ্যোগ নেই। তিনি প্রশ্ন তোলেন, বাজারে ডিমের সরবরাহ বাড়বে কোন উপায়ে? আর বাজারে ডিমের সরবরাহ না বাড়লে ডিমের ওপর চাপ কমবে কীভাবে? আর চাপ না কমলে দাম কমবে কীভাবে? এসব সমস্যা নিরসনের কি কোনো উদ্যোগ আছে কারও? মসিউর রহমান বলেন, একজন খামারির প্রতি পিস ডিম উৎপাদনের খরচ ৬ টাকার ওপরে। কাজেই তাকে টিকে থাকতে হলে প্রতি পিস ডিম ৭ টাকা দরে ডিম বেঁচতে হবে। না পারলে তিনি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। আর খামারি ক্ষতিগ্রস্ত হলে খাত টিকবে না। যাত্রাবাড়ী বাজারের ডিম ব্যবসায়ী জহির মিয়া বলেন, গত রোজায় সময় ডিমের ডজন ছিল ৬৫-৭০ টাকা। শনিবার এক ডজন ডিম বিক্রি হয়েছে ১১০ টাকায়। তবে খুচরা দোকানে আরও বেশি দামে বেঁচা হচ্ছে বলে জানান তিনি। মাদারটেকের নন্দীপাড়া বাজারের ডিম ব্যবসায়ী মো. বেলাল হোসেন বলেন, 'এক বছর আগে ডিম যে দামে কিনে আনতাম এখন তার দ্বিগুণ হয়েছে। ডিমের দাম এতটাই বেড়েছে যে, এক ডজন ডিম ১১০ টাকার নিচে বেচার উপায় নেই। জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বাজার মনিটরিং টিম নিয়মিত কাজ করছে। ডিমের দাম বাড়ার বিষয়ে যদি কোথাও কোনো অসঙ্গতি চোখে পড়ে, অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।