বাস দুটি একই কোম্পানির, নাম তেঁতুলিয়া পরিবহন

বাসচাপায় মৃতু্য: মনে পড়ে তিশাকে, একই পথে শান্ত

প্রকাশ | ২৬ মার্চ ২০১৯, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
তিশার কথা মনে আছে। পুরো নাম তাসনিম আলম। আদর করে ওকে ডাকা হতো 'তিশা'। ১২ বছর বয়স ছিল তখন তিশার। মিরপুর ১০ নম্বরে গার্লস আইডিয়াল ল্যাবরেটরি ইনস্টিটিউটের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী। ২০১৭ সালে ১২ সেপ্টেম্বর দুপুর ১টার ঘটনা। পরীক্ষা শেষ করে মা রিমা আক্তার ও ছোট ভাইকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফিরছিল। সেনপাড়ায় রিকশা থেকে নেমে রাস্তা পাড় হচ্ছিল। ঠিক তখনই সামনের সড়কে দুটি বাসের প্রতিযোগিতা। কোন বাস কার আগে যাবে, এ নিয়ে দুই চালক দ্রম্নত বাস চালাচ্ছিলেন। সড়ক বিভাজকে উঠতে যাবে, সে সময় দানবের গতি নিয়ে তিশাকে ছোবল দেয় একটি বাস। চোখের পলকে থেঁতলে যায় তিশার শরীর। তাকিয়ে দেখা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না মা রিমা আক্তারের। নিষ্পাপ নিথর তিশার দেহ নিয়ে কী আর্তনাদই না সেদিন কাফরুল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শামীম সিকদারের কক্ষের সামনে করেছিলেন তিনি। সেদিনই তিশাকে নিয়ে চলে যান রংপুরে গ্রামের বাড়িতে। প্রায় দেড় বছরে পর সোমবার সকালে একই সড়কে বাসচাপায় আরেকটি মৃতু্য হয়। দূরত্ব এক কিলোমিটার হবে। স্থান পশ্চিম শেওড়াপাড়া বাসস্ট্যান্ডের মডার্ন উড ফার্নিচারের সামনে। মোটরসাইকেল চালাচ্ছিলেন নূর ইসলাম শান্ত। বয়স ২৭ বছর। রাস্তা ফাঁকা। কোনো তাড়াহুড়ো নেই। তবুও অস্থির বাসচালক। বাস নিয়ে দ্রম্নত যাচ্ছিলেন মিরপুর ১০ নম্বরের দিকে। পেছন থেকে ধাক্কা দেন নূর ইসলাম শান্তের মোটরসাইকেলকে। ছিটকে পড়েন সড়কে। নিথর হয়ে যায় শান্তর দেহ। নিহত নুরুল ইসলাম শান্ত (৩১) পেশায় একজন মোটর মেকানিক। ওয়ান ব্যাংকের গাড়ির গ্যারেজে কাজ করতেন তিনি। স্ত্রী রেশমা ও দুই বছরের ছেলেকে নিয়ে থাকতেন মগবাজারে এক বাসায়। মিরপুরের ওসি বলেন, একটি বাস শান্তর মোটরসাইকেলে ধাক্কা দিলে ছিটকে পড়ে গুরুতর আহত হন তিনি। সেখান থেকে তাকে উদ্ধার করে শেরেবাংলা নগরে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। শান্তর ভায়রা জাহাঙ্গীর আলম হাসপাতালে বলেন, সকালে বাসা থেকে বেরিয়ে মনিপুরি পাড়ায় কর্মস্থলে যান শান্ত। সেখান থেকে মোটরসাইকেলের কাগজপত্রের কাজে মিরপুরে বিআরটিএ কার্যালয়ে যাওয়ার পথে দুর্ঘটনায় পড়েন। দুর্ঘটনার জন্য দায়ী বাসটি এবং চালক সাইফুলকে পুলিশ আটক করেছে বলে জানিয়েছেন ওসি। দুটি ঘটনার ব্যবধান বছর দেড়েক। দুটি বাসের চাপায় তিশা ও শান্তের মৃতু্য। কিন্তু বাস দুটি একই কোম্পানির, নাম তেঁতুলিয়া পরিবহন। তিশার মৃতু্যর পর জনতা বাসটি পুড়িয়ে দেয়। চালক আবদুর রহিম ধরা পড়ে। তিশার পরিবার মামলা করেনি। পুলিশের পক্ষ থেকে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতু্যর কারণ দেখিয়ে মামলা করা হয়। পোড়া বাসটি মাস কয়েক কাফরুল থানার সামনে রাখা ছিল। ঘটনার কয়েক দিন রহিম জামিনে ছাড়া পেয়ে আবারও স্টিয়ারিংয়ে বসে যান। পোড়া বাসটি থানা থেকে ছাড়িয়ে মালিক মেরামত করেন। এখন দিব্যি চলছে তেঁতুলিয়া পরিবহনের বাস মোহাম্মদপুর থেকে আবদুলস্নাহপুর পর্যন্ত। অন্যদিকে একমাত্র মেয়েকে হারিয়ে শোকে স্তব্ধ হয়ে যায় তিশার পরিবার। বাবা খোরশেদ আলম ঢাকা ছেড়ে বদলি করিয়ে নেন রংপুরে। কিছুদিন পর বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের চাকরি ছেড়ে বেকার জীবনযাপন করেন তিনি। রংপুর থেকে এখন বসবাস করছেন বগুড়া শহরে। সোমবার মুঠোফোনে কথা হয় খোরশেদ আলমের সঙ্গে। তেঁতুলিয়া পরিবহনের বাসে আরেকটি মৃতু্যর ঘটনার কথা জানাতে দীর্ঘ শ্বাস ফেলেন তিনি। তিশার মৃতু্যর মামলার কথা জানতে চাইলে খোরশেদ আলম বলেন, আমাকে হাজিরা দিতে বলা হয়েছিল। আমি বলেছি, আপনারা যা পারেন করেন। আমার পক্ষে ঢাকা আসা সম্ভব না। তিনি বলেন, 'এখন আমার কিছুই ভালো লাগে না। আমি যাকে হারিয়েছি, তাকে তো ফিরে পাব না। দেড় বছর বেকার ছিলাম। কিন্তু কিছু তো করতে হবে। তাই কয়েক মাস আগে বগুড়ায় আরেকটি চাকরি নিয়েছি।' জানা গেছে, তিশার মৃতু্যর পর তেঁতুলিয়া পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মাসুম তিশার বাবা খোরশেদ আলমের সঙ্গে তার ঢাকার বাসায় দেখা করেছিলেন। তিশার মিলাদে আসতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু খোরশেদ আলম আসতে মানা করেন। তেঁতুলিয়া পরিবহনের এমডি মো. মাসুমের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, 'আমি তিশার বাসায় গিয়েছিলাম। ক্ষতিপূরণও দিতে চেয়েছি। তবে ওর বাবা মেয়ের জন্য দোয়া করতে বলেন। পরে আমি আমাদের অফিসে তিশার আত্মার শান্তি কামনা করে মিলাদ দিয়েছিলাম।' মো. মাসুম বলেন, 'সেদিনের ঘটনায় বাসচালক জামিনে ছাড়া পান। তবে আমাদের পরিবহনের বাস সে চালায় না। অবশ্য তেঁতুলিয়া পরিবহনের ওই বাস এখনো চলছে।' গতকাল শেওড়াপাড়ায় দুর্ঘটনার কথা জানতে চাইলে মো. মাসুম বলেন, 'আমরা সব সময় জড়িত বাসচালকের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। শেওড়াপাড়ায় দুর্ঘটনায় বাসচালক যদি জড়িত থাকে, তাহলে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে। কোনো ছাড় দেয়া হবে না।'