ভোটের মাঠে সশস্ত্র বাহিনী

১০ জানুয়ারি পর্যন্ত বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা করতে তারা মাঠে থাকবেন

প্রকাশ | ০৪ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করতে বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা দিতে মাঠে নেমেছেন সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা। ছবিটি বুধবার রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে থেকে তোলা -পিবিএ
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বেসামরিক প্রশাসনকে সহযোগিতা দিতে ভোটগ্রহণের চার দিন আগে মাঠে নেমেছেন সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা। বুধবার সকাল ৮টা থেকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের জিয়া কলোনি ও সৈনিক ক্লাব থেকে সেনা সদস্যরা মাঠে নামেন; মহাখালী, নাবিস্কো ও তিব্বত হয়ে তাদের গাড়িবহর ছুটতে দেখা যায়। সেনাবাহিনীর গাড়ি দেখা যায় মালিবাগ ও খিলগাঁও এলাকাতেও। ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা করতে তারা মাঠে থাকবেন। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর-আইএসপিআর মঙ্গলবার এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা প্রতিটি জেলা/উপজেলা/মেট্রোপলিটন এলাকার 'নোডাল পয়েন্ট' ও অন্যান্য সুবিধাজনক স্থানে অবস্থান করবে। সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং অফিসারের অনুরোধক্রমে ও সমন্বয়ের মাধ্যমে বাহিনীগুলো এলাকাভিত্তিক মোতায়েন সম্পন্ন করবে। "উপকূলীয় দুটি জেলাসহ (ভোলা ও বরগুনা) ১৯টি উপজেলায় দায়িত্ব পালন করবে নৌবাহিনী। সমতলে সীমান্তবর্তী ৪৫টি উপজেলায় বিজিবি এককভাবে দায়িত্ব পালন করবে। এ ছাড়া সীমান্তবর্তী ৪৭টি উপজেলায় সেনাবাহিনী বিজিবির সঙ্গে এবং উপকূলীয় চারটি উপজেলায় কোস্টগার্ডের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে যৌথভাবে দায়িত্ব পালন করবে।' অপরদিকে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী পার্বত্য অঞ্চলের ভোটকেন্দ্রগুলোতে প্রয়োজনীয় হেলিকপ্টার সহায়তা দেবে। জরুরি প্রয়োজনে বিমান বাহিনীর প্রয়োজনীয় সংখ্যক হেলিকপ্টার প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সশস্ত্র বাহিনী বিভাগে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/বিভাগ ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে যৌথ সমন্বয় সেল স্থাপন করা হয়েছে, যা ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত কার্যকর থাকবে। আগামী ৭ জানুয়ারি হবে ভোটগ্রহণ। ভোটের আগের চারদিন, ভোটের দিন ও পরের তিনদিন পর্যন্ত মাঠে কাজ করবে সশস্ত্র বাহিনী। সেনাবাহিনী কী করতে পারবে, কী পারবে না বিবিসি বাংলা জানায়, 'স্থানীয় বেসামরিক প্রশাসনকে' সহায়তা করার জন্য 'ইন এইড টু সিভিল পাওয়ার'-এর আওতায় সশস্ত্র বাহিনীকে নির্বাচনী দায়িত্বে মোতায়েন করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের সচিব জাহাঙ্গীর আলম জানান, 'রিটার্নিং অফিসার ও সহকারী রিটার্নিং অফিসারের সঙ্গে পরামর্শ করে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে সেনাবাহিনী। তারা (সেনাবাহিনী) নির্বাচনী আসনের বিভিন্ন নোডাল পয়েন্টে অবস্থান করবে। কোনো সংকটের ক্ষেত্রে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে সঙ্গে নিয়ে তারা ঘটনাস্থলে যাবে। এরপর নির্বাহী \হম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশ অনুযায়ী তারা কাজ করবে।' কোন আসনের কোথায় এবং কতগুলো 'নোডাল পয়েন্ট' থাকবে, তা নির্ধারণ করবেন আসন সংশ্লিষ্ট স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা। রিটার্নিং অফিসার, সহকারী রিটার্নিং অফিসার, পুলিশ সুপারসহ স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা নির্ধারণ করবেন সেনাবাহিনী কোথায় অবস্থান করবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নির্বাচনী আসনগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ, অতি গুরুত্বপূর্ণ ও সাধারণ- এই তিন ভাগে ভাগ করেছে। ভোট কেন্দ্রে বড় ধরনের গোলযোগ যদি পুলিশ বা স্থানীয় প্রশাসন সামাল দিতে না পারে তখন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী ঘটনাস্থলে যাবে এবং ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশ অনুযায়ী সেখানে পদক্ষেপ নেবে। সিআরপিসি'র দন্ডবিধি অনুযায়ী ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে ঘটনাস্থলে সেনাবাহিনী বল প্রয়োগ থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারবে। উদাহরণ হিসেবে ইসি সচিব বলেন, 'যদি ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার একটি রাস্তা কেউ বন্ধ কর রাখে, তাহলে ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী সেখানে যাবে এবং ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে বুঝিয়ে বা বল প্রয়োগ করে সেখানকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার ব্যবস্থা করবে।' আইন অনুযায়ী নির্বাচনের সময় সেনাবাহিনীর সঙ্গে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট থাকায় ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে তারা প্রয়োজনে কোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করতে পারে। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে নিয়োজিত থাকলেও সেনাবাহিনী কোনো ঘটনায় মামলা করতে পারবে না বলে জানান নির্বাচন কমিশন সচিব জাহাঙ্গীর আলম। কেন সেনাবাহিনী মোতায়েন? এবারের নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দল অংশ নিচ্ছে না বলে অন্যান্যবারের তুলনায় সহিংসতার সম্ভাবনা কম বলে ধারণা করা হচ্ছে। কাজেই নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন করার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেক নির্বাচন পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষক। আবার অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, অন্য যে কোনো নির্বাচনের ক্ষেত্রে যে ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হতো, কমিশন সে রকমভাবেই নির্বাচনের প্রস্ততি নিচ্ছে। সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেন বলেন, 'সেনাবাহিনী মোতায়েনের প্রয়োজন আছে না নাই সেটি এখানে বিষয় নয়। সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হলে কমিশন যা যা করত, ঠিক তাই করছে এই নির্বাচনের ক্ষেত্রেও।' পাশাপাশি সাবেক এই নির্বাচন কমিশনার মনে করছেন নির্বাচনের পূর্ণ প্রস্তুতি নেওয়ার মাধ্যমে কমিশন আন্তর্জাতিক পক্ষগুলোকেও একটি বার্তা দিতে চাইছে। তিনি বলেন, 'এই নির্বাচনকে ঘিরে নির্বাচন কমিশনের ওপর যে আন্তর্জাতিক চাপ রয়েছে, তা সিইসি নিজেই বলছেন। হয়তো তারা আন্তর্জাতিক পক্ষগুলোকে বলার চেষ্টা করছেন যে সাংবিধানিক স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমাদের দায়িত্ব আমরা সব সতর্কতা মেনে পালন করেছি। তারা হয়তো একটা বার্তা দিতে চাচ্ছেন, সংবিধান অনুযায়ী আমরা আমাদের কাজে গাফিলতি করি নাই।' অর্থাৎ নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে যেন সমালোচনা বা প্রশ্ন তৈরি না হয়, তা নিশ্চিত করতে কমিশন যথাযথ প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে মনে করেন সাখায়াত হোসেন। তার মতে, নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েনের আরেকটি বড় কারণ বাংলাদেশের মানুষের কাছে সেনাবাহিনীর 'ভাবমূর্তি'। বাংলাদেশের মানুষ সেনাবাহিনীকে 'নিরপেক্ষ' বাহিনী হিসেবে মনে করে এবং তাদের উপস্থিতিতে মানুষ 'নিরাপত্তার বিষয়ে আস্থা' পায় বলে মন্তব্য করেন তিনি। এ ছাড়া প্রতিবেশী দেশগুলোর বিচারে বাংলাদেশে কোনো রিজার্ভ ফোর্স না থাকার কারণে নির্বাচনের মতো গুরুত্বপূর্ণ সময়ে সেনাবাহিনী মোতায়েন জরুরি হয়ে পড়ে বলে মনে করেন তিনি। সাখাওয়াত হোসেন বলেন, 'ভারতে সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ, সিআরপি নামে আলাদা ফোর্স আছে। নির্বাচনের সময় তারা প্রাদেশিক পুলিশের চেয়ে বেশি ক্ষমতা রাখে এবং তারা সরাসরি নির্বাচন কমিশনের অধীন চলে আসে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে পুলিশ ফোর্স নির্বাচন পরিচালনাকারী সরকারের অধীন থাকে।' তাই এ রকম পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর 'রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত' এবং 'নিরপেক্ষ' ভাবমূর্তির জন্যই তাদের নির্বাচনী দায়িত্বে মোতায়েন করা হয় বলে জানান সাখাওয়াত হোসেন। সেনাবাহিনী মোতায়েনের ইতিহাস স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচন থেকেই নির্বাচনকে ঘিরে সেনাবাহিনী মোতায়েনের রেওয়াজ চলে আসছে। ১৯৭৩ সালের নির্বাচন থেকে বাংলাদেশে সেনাবাহিনী মোতায়েনের চল শুরু হয়েছে বলে বলছিলেন ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেন, '১৯৭৩ সালের নির্বাচনে বেশিসংখ্যক পুলিশ ছিল না। অন্যান্য বাহিনীতেও যথেষ্ট পরিমাণ সদস্য ছিল না। তাই জনবল বাড়ানোর জন্য সে সময় সেনাবাহিনীকে ডাকা হয়েছিল। এরপর ১৯৯১ সালের আগ পর্যন্ত সব নির্বাচনই হয়েছে সেনা সমর্থিত প্রশাসনের অধীন। স্বাভাবিকভাবেই সেসব নির্বাচনে সেনা উপস্থিতি ছিল।' আগের নির্বাচনগুলোর ওই ধারাই ১৯৯১ সালের নির্বাচনে অনুসরণ করা হয় এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয় বলে মন্তব্য করেন সাখাওয়াত হোসেন। এরপর ১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রম্নয়ারির 'একতরফা নির্বাচন'-সহ সে বছরের ১২ জুন ও ২০০১ সালের পহেলা অক্টোবর হওয়া নির্বাচনেও সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছিল। এরপর ২০০৮ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠিতই হয় সেনাবাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন। ২০১৪ সালে পরের নির্বাচনে মোট ১৫ দিনের জন্য নিয়োজিত হয়েছিল সেনাবাহিনী। সবশেষ ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময় ৩৮৮টি উপজেলায় ৩৫ হাজারেরও বেশি সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়েছিল।