বিভক্ত আইনজীবীদের নিয়ে বিএনপিতে সংকট বাড়ছে

প্রকাশ | ২১ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
মাহবুব উদ্দিন খোকন
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচন ও এর ফলাফল এবং দায়িত্ব গ্রহণ ঘিরে বিএনপি সমর্থিত আইনজীবীরা বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। ফোরামের শৃঙ্খলা রক্ষায় নেওয়া সিদ্ধান্ত অনুমোদনের দায়িত্ব দলের হাইকমান্ডের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। জনপ্রিয়তার দিক থেকে এগিয়ে থাকা ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসায় এনিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে বিএনপি হাইকমান্ডও বিব্রত। অন্যদিকে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা রক্ষায় আইনজীবী ফোরামের শীর্ষ নেতাদের দাবি উপেক্ষা করাও কঠিন। সবমিলে এই ইসু্য ঘিরে বিএনপিতে সংকট বাড়ছে। গত ৬ ও ৭ মার্চ সুপ্রিম কোর্ট বার আইনজীবী সমিতির নির্বাচন হয়। ৯ মার্চ ঘোষিত ফলে সভাপতি ও কার্যনির্বাহী কমিটির তিনটি সদস্যপদে বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের প্যানেল 'নীল দলের' প্রার্থীরা জয়ী হন। অন্যদিকে সম্পাদক, কোষাধক্ষ্যসহ ১০টি পদে জয়ী হন আওয়ামী লীগপন্থিরা। তবে নির্বাচনে অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগ করেন বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা। নির্বাচনে মারামারিকে কেন্দ্র করে নীল দলের সম্পাদক প্রার্থী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজলসহ বিএনপিপন্থি বেশ কয়েকজন আইনজীবীকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেওয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় গত ২৭ মার্চ জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সভাপতি ও বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট এজে মোহাম্মদ আলী এবং ফোরামের মহাসচিব ও বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকনসহ সুপ্রিম কোর্ট বার নির্বাচনে জয়ী ফোরামের চারজনকে দায়িত্ব গ্রহণে বিরত থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়। এরপরেও গত ৪ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি পদে দায়িত্ব গ্রহণ করেন নির্বাচনে বিজয়ী বিএনপি-জামায়াতের সমর্থনে গঠিত নীল প্যানেলের প্রার্থী মাহবুব উদ্দিন খোকন। ফোরামের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে এই দায়িত্ব নেয়ায় মাহবুব উদ্দিন খোকনকে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আর এই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করতে লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আইনজীবী ফোরামের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও সুপ্রিম কোর্টের সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. গাজী কামরুল ইসলাম সজল যায়যায়দিনকে বলেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ফোরামের সাংগঠনিক অভিভাবক। এজন্য দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষায় মাহবুব উদ্দিন খোকনকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত অনুমোদনের দায়িত্ব তাকে দেওয়া হয়েছে। এখন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত প্রধান যে সিদ্ধান্ত দেবেন সবাই তা মেনে নেবে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সহসভাপতি ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকনকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত কার্যকর করা নিয়ে একটি বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এর কারণ সুপ্রিম কোর্টের বারের শীর্ষ পদে নির্বাচিত হওয়া এই নেতা আইনজীবীদের কাছে অনেক জনপ্রিয়। দায়িত্ব গ্রহণের আগে সুপ্রিম কোর্ট বারের দক্ষিণ হলে সমমনা আইনজীবীদের সঙ্গে মতবিনিময় করে সমর্থন নিয়েই এই সিদ্ধান্ত নেন তিনি। এছাড়া নির্বাচনের দিনে নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও শেষ পর্যন্ত হাল না ছেড়ে গণনায় সময় উপস্থিত থেকে কোনো অনিয়ম করতে দেননি। এর ফলও পেয়েছেন- যাদের নিয়ে খোকন গণনার সময় ছিলেন দল সমর্থিত সেসব নেতাই নির্বাচিত হয়েছেন। শেষ পর্যন্ত হাল না ছাড়ার এই মানসিকতায় বিএনপির শীর্ষ নেতারা খুশি হয়েছেন। এই ধরনের মানসিকতা থাকলে বিএনপি অনেক নির্বাচনে ভালো করত- এমন কথাও অনেকেই বিভিন্ন ফোরামে বলেছেন। সাবেক সংসদ সদস্য খোকন তার নির্বাচনী এলাকাতেও জনপ্রিয়। এর বাইরে দলের নেতাকর্মীদের আইনি সহয়তা দিতেও তার বলিষ্ঠ ভূমিকা প্রশংসনীয়। অন্যদিকে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও ফোরামের সভাপতি এজে মোহাম্মদ আলী, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও ফোরাম নেতা অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন, অ্যাডভোকেট নিতাই রায় চৌধুরী, ফোরামের মহাসচিব ব্যারিস্টার কায়সার কামাল, নির্বাচনে নীল প্যানেল থেকে সম্পাদক পদে অংশ নেওয়া ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল, ফোরামের সুপ্রিম কোর্ট বার ইউনিট শাখার সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট গাজী কামরুল ইসলাম সজলসহ সিনিয়র নেতাদের দাবি দলের শৃঙ্খলার স্বার্থে মাহবুব উদ্দিন খোকনের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার। এসব সিনিয়র আইনজীবীর মতামত উপক্ষো করাও হাইকমান্ডের জন্য সহজ নয়। খোকন বিরোধীদের অভিযোগ, ব্যারিস্টার খোকন দলের সমর্থন নিয়ে সভাপতি পদে নির্বাচন করেছেন। দল ও ফোরামের বারণ সত্ত্বেও দায়িত্ব নিয়েছেন। দায়িত্ব গ্রহণের আগে তথাকথিত কিংস পার্টির কয়েকজনের সমর্থন নিয়েছেন। বিষয়টি দলীয়ভাবে বিএনপি ও ফোরাম ভালোভাবে নেয়নি। যে কারণে তাকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এজন্য তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসনকে অবহিত করা হয়েছে। খোকনের বহিষ্কারের দাবিতে দলের আইনজীবীদের প্রভাবশালী একটি অংশ প্রকাশ্যে সোচ্চার হলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো মন্তব্য করতে রাজি নন আইনজীবী সমিতির নব নির্বাচিত সভাপতি। ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন এ বিষয়ে যায়যায়দিনকে বলেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মনোনয়নে তিনি নির্বাচন করেছেন। তার সিদ্ধান্তের প্রতি সম্মান রেখেই দায়িত্ব নিয়েছেন। এর চেয়ে বেশি কিছু বলার নেই। এখন বিরোধীদের বিষয়ে প্রকাশ্যে কিছু না বললেও দায়িত্ব গ্রহণের আগে সুপ্রিম কোর্ট বারের জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ঐক্য পরিষদ সমর্থিত ও সমমনা আইনজীবীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন নবনির্বাচিত সভাপতি ব্যারিস্টার খোকন। এ সময় তিনি জানান, নির্বাচন নিয়ে সরকারি দলের সঙ্গে ম্যাচ ফিক্সিং করেছিল দলের তিন আইনজীবী নেতা। ভোটের বাক্স সরানো, মারামারি নেপথ্যে যুবলীগ চেয়ারম্যান ফজলে সামস পরশের স্ত্রী নাহিদ সুলতানা যুথীর সঙ্গে নিজ দলের সম্পাদক প্রার্থী ব্যারিস্টার কাজলেরও জড়িত থাকার ইঙ্গিত দেন খোকন। তিনি আরও অভিযোগ করে বলেন, 'সরকারপন্থিরা ব্যালট বাক্স অবরুদ্ধ করে রেখেছিল। ফোরামের কতিপয় আইনজীবী নেতা আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের জয়ী দেখতে চেয়েছিলেন। কেন তাদের (সরকারপন্থি আইনজীবীদের) ওয়াকওভার চেয়েছিলেন? কারা এটা করল, কারা যোগসাজশ করল, কেন করল সেই মুহূর্তে এটা উচিত হয়েছে কি না। আপনারা সভায় উপস্থিত আইনজীবীরা মতামত দেবেন।' এদিকে বিএনপি হাইকমান্ডের ঘনিষ্ট সূত্রমতে, আইনজীবীরা বিভক্ত হওয়া কার লাভ-ক্ষতি এনিয়ে দলের উচ্চ পর্যায়ে আলোচনা হয়েছে। খোকন ও তার বিরোধীদের দলের প্রতিকূল অবস্থায় কার কি ভূমিকা তা নিয়ে পর্যালোচনা হয়েছে। সেই সব আলোচনায় মাহবুব উদ্দিন খোকনের বিরুদ্ধ ব্যবস্থা নেওয়ার বিপক্ষেই বেশির ভাগ নেতা মত দিয়েছেন। আলোচনার ভিত্তিতে সূত্রটির দাবি, খোকনের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।