যেসব খাবারের মাধ্যমে দেহে ঢুকছে অ্যান্টিবায়োটিক

প্রকাশ | ২৬ এপ্রিল ২০১৯, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী ভেবে যে দুধ খাচ্ছেন বা মাছ, মাংস খাচ্ছেন- তা নিয়ে কি ভেবেছেন কখনো? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কয়েক বছর আগে থেকেই জানাচ্ছে, বিশ্বে যে পরিমাণ অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি হয় তার অর্ধেকই ব্যবহৃত হয় পশু উৎপাদনে। আর অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার জন্য হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র বা আইসিইউতে থাকা রোগীদের একটি বড় অংশের মৃতু্য হয়ে থাকে বলে জানাচ্ছেন বাংলাদেশের চিকিৎসকরা। ২০১৮ সালে শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিইউতে মোট ৯০০ রোগী ভর্তি হয়েছিল, যাদের মধ্যে ৪০০ জন মারা যায়। এদের প্রায় ৮০ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে তাদের শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া বা 'সুপারবাগের' উপস্থিতি ছিল। ফলে আপনি যা খাচ্ছেন, তা মানুষের জন্য বয়ে আনতে পারে ব্যাপক স্বাস্থ্যঝুঁকি। ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সায়েদুর রহমান বিবিসি বাংলাকে বলেন, যেসব ব্যাকটেরিয়া সাধারণত মানুষের শরীরকে আক্রমণ করে, তারা দীর্ঘদিন ধরে ওষুধের সংস্পর্শে থাকার কারণে ওইসব ওষুধ থেকে বেঁচে যাওয়ার কিছু ক্ষমতা অর্জন করে। এটাকেই চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় 'অ্যান্টিবায়োটিক রেসিস্ট্যান্স'। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) আর্থিক সহায়তায় সরকারি প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরি (এনএফএসএল) গাভীর খাবার, দুধ, দই ও প্যাকেটজাত দুধ নিয়ে সম্প্রতি একটি গবেষণা জরিপের কাজ করে। গবেষণায় যে ফলাফল উঠে আসে সেখানে গাভীর দুধে (প্রক্রিয়াজাতকরণ ছাড়া) সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি কীটনাশক ও নানা ধরনের অ্যান্টিবায়োটিকের উপাদান পাওয়া গেছে। পাওয়া গেছে বিভিন্ন অণুজীবও। একই সঙ্গে প্যাকেটজাত গাভীর দুধেও অ্যান্টিবায়োটিক ও সিসা পাওয়া গেছে মাত্রাতিরিক্ত। এনএফএসএলের এই গবেষণা কার্যক্রমে যুক্ত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক লুৎফুল কবির। তিনি বলেন, যেসব উপাদান পাওয়া গেছে, এর মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিকের উপাদানই বেশি-টেট্রাসাইক্লিন, এনরোফ্লোক্সাসিন, সিপ্রোসিন ও আফলাটক্সিন অ্যান্টিবায়োটিক। এগুলো সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি পাওয়ার অর্থ হলো এগুলো যেকোনো বয়সি মানুষের শরীরে ঢুকে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট করে দেবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ বিজ্ঞান বিভাগের এই সহযোগী অধ্যাপক বলেন, যেসব কারণে অ্যান্টিবায়োটিক রেসিসট্যান্স হয় তার মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হলো: নির্দিষ্ট সময়মাফিক অ্যান্টিবায়োটিক না খাওয়া বা প্রয়োগ না করা প্রেসক্রিপশন ছাড়া ইচ্ছামাফিক খাওয়া (২০১৫ সালে ইউরোপিয়ান জার্নাল অব সায়েন্টিফিক রিসার্চের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রতি তিনজন রোগীর একজন চিকিৎসকের কোনো পরামর্শ ছাড়াই অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করে থাকেন) এবং বিভিন্ন খাবারের মাধ্যমে মানবদেহে অ্যান্টিবায়োটিক প্রবেশ করার ফলে। যেসব খাবার থেকে মানবদেহে প্রবেশ করতে পারে অ্যান্টিবায়োটিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক লুৎফুল কবির বলেন, 'আমরা প্রতিদিন যেসব খাবার খাচ্ছি তার অনেকগুলো থেকেই অ্যান্টিবায়োটিক শরীরে প্রবেশ করতে পারে।' যেমন- মুরগির মাংস, গরু, ছাগল বা খাসির মাংস, দুধ এবং দুগ্ধজাতীয় খাবার, মাছেও হরমোন ব্যবহার করা হয়, সেখানেও এন্টিবায়োটিক দেয়া হয় রোগ প্রতিরোধী করার জন্য, শাকসবজি যদিও এতে সরাসরি অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া হয় না। তবে কীটনাশক দেয়া হয়। তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, 'এখনকার অধিকাংশ পশুখাদ্যে, গো-খাদ্যে, পোলট্রি ফিডে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ানো হচ্ছে। আর এইসব প্রাণীর দেহে এভাবে অ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতি থাকা অবস্থায় সেসব প্রাণীর মাংস আবার মানুষ খাচ্ছে।' 'এসব খাদ্যে উচ্চমাত্রার মার্কারি এবং ক্রোমিয়ামও থাকে। এভাবে তা মানবদেহে চলে যাচ্ছে। এমনকি মায়ের বুকের দুধের মাধ্যমে তা বাচ্চার দেহেও যাচ্ছে।' কতটা উদ্বেগের? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কয়েক বছর আগে থেকেই জানাচ্ছে বিশ্বে যে পরিমাণ অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি হয় তার অর্ধেকই ব্যবহৃত হয় পশু উৎপাদনে। আর মানুষের জন্য তা বয়ে আনছে ব্যাপক স্বাস্থ্যঝুঁকি। পশু খাবার উৎপাদনকারীরা বলছে, এতে গবাদিপশু সুস্থ থাকবে। আর খামারিরা বিষয়টি না বুঝেই সেই খাবার কিনে খাওয়াচ্ছে। অনেক বিশেষজ্ঞ একে 'নীরব মহামারী' হিসেবে মনে করছেন। কারণ এর প্রধান ঝুঁকি হলো, কোনো সংক্রমণ ছাড়া এত বেশি অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ালে পশুর শরীরে যে জীবাণু তা ধীরে ধীরে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ করার ক্ষমতা তৈরি করে ফেলে। ফলে মানুষ যখন এভাবে উৎপাদিত গরু, মুরগি বা মাছ খায়, তখন খাবারের মাধ্যমে মানবদেহে এসব অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জীবাণু প্রবেশ করে। এরপর মানুষ যখন তার নিজের অসুখ হলে সেসব এন্টিবায়োটিক খায়, তখন সেই ওষুধে আর কাজ হয় না। কীভাবে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব? বিএসএমএমইউর অধ্যাপক সায়েদুর রহমান অ্যান্টিবায়োটিক মুরগি, গরু-ছাগল, দুধে থাকতে পারে, মাছেও থাকতে পারে বলে উলেস্নখ করেন। তিনি বলেন, 'খাবার উৎপাদনের প্রক্রিয়াতে অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া হচ্ছে। যেদিন মুরগি খাওয়া হবে তার ১৫ দিন আগে তার অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার বন্ধ করতে পারলে সেটি মানুষের শরীরে পৌঁছতে পারবে না। কিন্তু সেটি করা হচ্ছে না। এজন্য দরকার নজরদারি।' তিনি মনে করেন, যেভাবে ফরমালিন ফ্রি খাবার হয়েছে সেভাবে উদ্যোগ নিলে এই অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োগ বন্ধ করা যাবে। 'উৎপাদন প্রক্রিয়াতে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার রোধ করতে হবে। সাধারণ মানুষের সচেতনতার ওপর গুরুত্ব দিলেও মূল কাজটি করতে হবে রাষ্ট্রকে।' 'রাষ্ট্রের উদ্যোগী হতে হবে। খাবারের মান ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে যেন বাজারে বিক্রি করা খাদ্যদ্রব্যে অ্যান্টিবায়োটিক না থাকে।' ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মিস্টার কবির বলেন, 'পরিস্থিতি আতঙ্ক তৈরির মতো নয় আবার হেলাফেলা করাও যাবে না। তবে সচেতন হতে হবে।' তিনি বলেন, একটা সময় সরকারি পর্যায়ে ফরমালিন নিয়ে ব্যাপক উদ্যোগ নেয়া হয় এবং সেটি বন্ধ হয়েছে। 'ফরমালিনের আমদানি নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে আমরা জোর দিয়েছিলাম। এখন ফরমালিন নেই বললেই চলে কারণ সেটি আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। খোলাবাজারে ফরমালিন বিক্রি করা বন্ধ করা গেছে।' এভাবে পশু-প্রাণীর খাদ্যে সরকার চাইলে বন্ধ করতে পারে। যেসব স্থান থেকে অ্যান্টিবায়োটিক সংগ্রহ করা হয় সেসব স্থান নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর চাইলে এটা মনিটরিং করতে পারে। আর সচেতনতা তৈরি করতে হবে ব্যবসায়ীদের মধ্যেও, যারা তাদের পালিত পশু-প্রাণীকে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়াচ্ছে- এমনটাই জানালেন মিস্টার কবির। বিবিসি বাংলা