সচল হলো দেশের সব থানা

যানবাহন সমন্বয় করে চলছে কার্যক্রম পাবলিক ব্যক্তিগত যান রিকুইজিশন নিষিদ্ধ

প্রকাশ | ১৬ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০

গাফফার খান চৌধুরী
সরকার ক্ষমতার পালাবদলে ভেঙেপড়া পুলিশি ব্যবস্থা চালু করতে জোর তৎপরতার দশ দিন পর দেশের সব থানা সচল হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তর বৃহস্পতিবার এক বার্তায় জানিয়েছে, ৬৩৯টি থানার মধ্যে সবগুলোরই অপারেশনাল কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এর মধ্যে মেট্রোপলিটনের ১১০টি ও জেলা পুলিশের থানা রয়েছে ৫২৯টি। এছাড়া রেলওয়ে পুলিশের ২৪টি থানাও স্বাভাবিক হয়েছে। এর আগে মঙ্গলবার গাজীপুরের জয়দেবপুর, কুমিলস্নার তিতাস ও নাঙ্গলকোট এবং লক্ষ্ণীপুরের রায়পুর ও রামগঞ্জ থানা বাদে বাকি থানাগুলো চালুর কথা জানিয়েছিল পুলিশ। লজিস্টিকস, আসবাবপত্রসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি ধ্বংস হওয়ায় সর্বশেষ বন্ধ থাকা পাঁচটি থানা দুই-তিন দিনের মধ্যে চালুর কথা বলা হয়। তবে একদিন পরই সব থানার কার্যক্রম শুরুর খবর দিল পুলিশ সদর দপ্তর। ঢাকা মহানগর পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, থানাগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সমন্বয় করে যানবাহন আদান-প্রদান করা হচ্ছে। যেসব থানার যানবাহন ভাঙচুর বা অগ্নিসংযোগের কবলে পড়েনি, ওইসব থানা থেকে প্রয়োজনীয় সংখ্যক যানবাহন যেসব থানার যানবাহন পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, সেসব থানাকে দেওয়া হচ্ছে। এসব যানবাহন দিয়ে মূলত থানার কার্যক্রম সচল করা হয়েছে। পুলিশের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, পুলিশ সদস্যদের মন থেকে ভীতি দূর হয়নি। যে কারণে থানার বাইরে পুলিশ সদস্যদের টহল ডিউটি করতে তেমন আগ্রহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। এমনকি যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ বলেও মনে করা হচ্ছে। কর্মকর্তারা বলেন, এই মুহূর্তে পুলিশকে নানাভাবে নানা চোখে বিচার করছে মানুষ। তাই পুলিশ যাতে জনবান্ধব হতে পারে, এজন্য প্রত্যেক পুলিশ সদস্যকে মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে বলা হয়েছে। তারই ফলশ্রম্নতিতে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা মাঠে কাজ শুরু করেছেন। পুলিশের যানবাহনের প্রচুর অভাব দেখা দিয়েছে। যানবাহনের অভাবে নূ্যনতম স্বাভাবিক কর্মকান্ড পর্যন্ত চালানো যাচ্ছে না। তারপরেও ট্রাফিক সার্জেন্টদের সব ধরনের পাবলিক ও ব্যক্তিগত যানবাহন রিকুইজিশন করতে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। কারণ মানুষের মনে কোনোভাবেই যেন পুলিশ সর্ম্পকে আর কোনো নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি না হয়। পুলিশের কর্তা ব্যক্তিরা জানান, ঢাকা মহানগর পুলিশের থানাগুলোর ক্ষতির পরিমাণ জানার জন্য একাধিক কমিটি গঠিত হয়েছে। কারণ একটি থানায় বহু ধরনের জিনিসপত্র ও মালামাল ব্যবহৃত হয়। স্টেশনারি জিনিসপত্র থেকে শুরু করে যানবাহন, পুলিশ সদস্যদের পোশাক, অস্ত্রগোলাবারুদ, হ্যান্ডকাফসহ বহু ধরনের জিনিসপত্র থানা পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত। সবই সরবরাহ করা হয় ডিএমপি সদর দপ্তর থেকে। স্টেশনারি ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, অস্ত্রগোলাবারুদ ও যানবাহন সরবরাহ করার আলাদা আলাদা বিভাগ আছে। সব বিভাগ যার যার অধীনে থাকা জিনিসপত্রের তালিকা তৈরির কাজ করছে। এরপর একটি বিস্তারিত ফিরিস্তি জমা দেওয়া হবে পুলিশ সদর দপ্তরে। সদর দপ্তরের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম পাওয়ার পরেই শুরু করা সম্ভব হবে পুলিশের স্বাভাবিক কার্যক্রম। তবে স্বাভাবিক কার্যক্রম চালাতে যথেষ্ট সময় লেগে যেতে পারে। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ঢাকার ৫০টি থানার মধ্যে ৪৬টি থানার নথিপত্র, আসবাবপত্র ও যানবাহন ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। কিছু কিছু থানা থেকে অস্ত্রগোলাবারুদসহ অন্য মালামাল লুটপাটের ঘটনাও ঘটেছে। শুধু গুলশান, তেজগাঁও, শাহবাগ ও রমনা থানায় তেমন কোনো ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড ঘটেনি। এর মধ্যে যাত্রাবাড়ি ও মিরপুর থানা থেকে অস্ত্রগোলাবারুদ লুটের খবর পাওয়া গেছে। এছাড়া অন্য থানা থেকে বুধবার পর্যন্ত অস্ত্রগোলাবারুদ লুটপাটের কোনো তথ্য মেলেনি। যদিও কি পরিমাণ অস্ত্রগোলাবারুদ ও অন্য মালামাল লুটপাট হয়েছে তার সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। ডিএমপি সূত্রে জানা গেছে, একটি থানায় যত ধরনের জিনিসপত্র ব্যবহৃত হয় প্রতিটি জিনিসের তালিকা তৈরি করছেন প্রতিটি থানার ওসি। মূলত ওসি এবং ডিএমপি সদর দপ্তরের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটি সার্বিক বিষয় পর্যালোচনা করে ক্ষতি ও লুটপাট হওয়া মালামালের ফিরিস্তি তৈরি করছেন। ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের কবলে পড়া অধিকাংশ থানায় মামলার কোনো নথিপত্র পাওয়া যায়নি। যেটি পুলিশী কার্যক্রম চালানোর ক্ষেত্রে বড় ধরনের বিপদ ডেকে আনবে। কম্পিউটার ও হার্ডডিস্কগুলো পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় কোনোভাবেই অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আর উদ্‌ঘাটন করা সম্ভব হচ্ছে না। যা মামলা পরিচালনা, আসমি গ্রেপ্তারসহ পুলিশী কার্যক্রমে বড় ধরনের ব্যাঘাত ঘটাবে। নাশকতাকারীদের কবলে পড়া থানাগুলোর সব আসবাবপত্রই ব্যবহারের অনুপোযোগী হয়ে পড়েছে। এমনকি মামলার আলামত পর্যন্ত ধ্বংস হয়ে গেছে। ডিএমপির দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়েছে যানবাহন ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের কারণে। যে কারণে ঢাকার থানাগুলো কোনোভাবেই মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে পারছে না। প্রতিটি থানায় গড়ে পুলিশেরই ১০টি পিকআপ, পেট্রোল কার ও অন্তত ৫০টি মোটর সাইকেল থাকে। এর বাইরে থানা আসায় লোকজনের গাড়িও থাকে। এছাড়া জব্দ করা গাড়ির সংখ্যা প্রতিটি থানায় গড়ে কমপক্ষে দুই শতাধিক। যার মধ্যে অন্তত ২০ থেকে ২৫টি ব্যবহারের উপযোগী থাকে। এসব যানবাহনের অধিকাংশই ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের কারণে পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। সামান্য কিছু যানবাহন মেরামত করার মতো অবস্থায় আছে। বাকিগুলো ব্যবহারের অযোগ্য। যানবাহন আদান-প্রদানের মাধ্যমে থানার কার্যক্রম দেখতে সরেজমিনে বুধবার ঢাকার শেরেবাংলা নগর থানায় গিয়ে দেখা গেছে, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের কারণে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া কার্যালয়টি থেকে কিছুই সরানো হয়নি। সবই আছে আগের মতই। থানার সামনে সেনা সদস্যরা দায়িত্ব পালন করছেন। থানার মূল গেটের ভেতরে একজন পোশাক পরিচিত পুলিশ ও আনসার সদস্য রয়েছেন। তারা আগতদের থানায় আসার কারণ সর্ম্পকে জানতে চাইছেন। সামনে একজন সহকারী উপপরিদর্শককে (এএসআই) সেনা সদস্যদের সঙ্গে অবস্থান করতে দেখা গেছে। থানাটির তৃতীয় তলায় একজন পোশাক পরিহিত পুলিশ সদস্যকে দেখা গেছে। যিনি মূলত থানার ভেতরের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছিলেন। ডিউটি অফিসারের রুমে ৬ জন কর্মকর্তাকে জিডি, অভিযোগ ও মামলা নিতে দেখা গেছে। যদিও সেবা গ্রহীতার সংখ্যা ছিল একেবারেই হাতে গোনা। আর ওসির রুমের সামনে একজনকে দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে। যদিও ওই সময় ওসি ছিলেন না। তিনি খানিটা আগেই বেরিয়ে গেছেন বলে সেখানে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যের দাবি। দায়িত্বরত কর্মকর্তারা জানান, শুধু দাপ্তরিক কার্যক্রম চলছে। আর কোনো কার্যক্রম নেই। কারণ থানায় পর্যাপ্ত ফোর্স নেই। আর থানায় মাত্র দু'টি গাড়ি দেখা গেছে। যার মধ্যে একটি থানাটির নিজস্ব। অপরটি তেজগাঁও থানা থেকে দেওয়া। দায়িত্বরত কোনো পুলিশ সদস্যের কাছেই কোনো ধরনের অস্ত্র ছিল না। শুধু গেটে দায়িত্ব পালন করা আনসার সদস্যের হাতে অস্ত্র দেখা গেছে। কর্মকর্তারা নিজেদের নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, শুধু জিডি ও মামলা গ্রহণের রেজিস্টার খাতা আছে থানায়। মূলত আর কিছুই নেই। এমনকি তারা নিরাপত্তার কারণে সন্ধ্যার আগেই থানা ত্যাগ করবেন বলেও জানান। থানাটিতে কর্মরতদের অধিকাংশই সাদা পোশাকে এসে হাজিরা দিয়ে চলে গেছেন। থানায় সেবা নিতে আসা রেহানা বেগম নামের এক নারীর সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলছিলেন, পারিবারিক বিষয়ে তিনি থানায় অভিযোগ করতে এসেছিলেন। আগে অভিযোগ লিখে আনতে হতো। তবে আজ লিখে আনতে হয়নি। থানার অফিসাররা আমার বক্তব্য শুনে নিজেরাই লিখে আমাকে পড়িয়ে শুনিয়েছেন। এরপর আমি স্বাক্ষর করেছি। পুলিশ কর্মকর্তারা বলেছেন, থানার কার্যক্রম পুরোপুরি শুরু হলে তার অভিযোগ গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করে দেখা হবে। অভিযোগ নেওয়ার পর পুলিশ সদস্যরা আমাদের যথেষ্ট খাতির যত্নও করেছেন। ঢাকা মহানগর পুলিশের কার্যক্রমের বিষয়ে ডিএমপি কমিশনার মো. মাইনুল হাসান যায়যায়দিনকে বলেন, ঢাকার ৫০টি থানারই কার্যক্রম পর্যায়ক্রমে শুরু হবে। যদিও অধিকাংশ থানার কার্যক্রম যানবাহন না থাকাসহ নানা কারণে সীমিত আকারে চালাতে হচ্ছে। আশা করছি, প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি পাওয়ার পর দ্রম্নতই সব থানার কার্যক্রম পূরোদমে শুরু হবে। তবে বিষয়টি সময়সাপেক্ষ। প্রসঙ্গত, গত ৫ আগস্ট ব্যাপক গণআন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এ সময় ঢাকার অনেক থানায় ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে সংঘর্ষ ছাত্র-জনতা হতাহত, পুলিশকে পিটিয়ে হত্যাসহ অনেক থানা পুড়িয়ে দেওয়া হয়।