ইয়াঙ্গুনে বিমান দুর্ঘটনা

অভ্র এখন কী করবেন?

ফারজানা গাজী অভ্র আর কখনোই হয়তো ফ্লাইট স্টুয়ার্ডসের কাজ করতে পারবেন না। কারণ তার পক্ষে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব নাও হতে পারে

প্রকাশ | ১৬ মে ২০১৯, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
রাজধানীর অ্যাপোলো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইট স্টুয়ার্ডেস ফারজানা গাজী অভ্র
ইয়াঙ্গুন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ৮ মে সন্ধ্যায় রানওয়ে থেকে বিমানের ড্যাশ-৮ উড়োজাহাজটি ছিটকে গেলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যান আরোহীরা। তাদের মধ্যে সবাই আতঙ্কে, ভয়ে চিৎকার-চেঁচামেচি করছিলেন। তখন বিমানের কেবিনে চলাচলের জায়গায় পড়ে ছিলেন ফ্লাইট স্টুয়ার্ডেস ফারজানা গাজী অভ্র। সেখান থেকে ওঠার চেষ্টা করলেও দাঁড়াতে পারছিলেন না তিনি। অভ্র তখন ধরেই নিয়েছিলেন, বিমানটি কিছুক্ষণ পরই আগুন ধরে বিধ্বস্ত হয়ে যাবে। নিজের যখন বাঁচার আশা নেই, তাই অন্যদের প্রাণরক্ষার চেষ্টা করেন ২৬ বছর বয়সী এই মেয়েটি। বিমানটির বেশ কয়েকজন যাত্রীর কাছ থেকে এসব কথা জানা গেছে। তারা জানান, বিমানের কেবিনে শুয়ে থেকে চিৎকার করে অভ্র বলতে থাকেন, 'আপনারা আগে বের হওয়ার চেষ্টা করুন। বিমানের দরজা খুলুন। বাঁ ও ডান দিকে দুটি দরজা রয়েছে।' বাঁ পাশের দরজা না খোলায় উড়োজাহাজের ডান দিকের দরজা খোলার পদ্ধতি যাত্রীদের বলে দেন অভ্র। দরজা খোলার পর যাত্রীদের উদ্ধার করা হয়। আর হাঁটাচলার ক্ষমতা না থাকায় স্ট্রেচারে শুইয়ে অভ্রকে বিমানবন্দরে নেয়া হয়। ইয়াঙ্গুনের হাসপাতালে দু'দিন চিকিৎসার পর গত শুক্রবার রাতে অভ্রসহ দুর্ঘটনাকবলিত বিমানটির পাইলট, কেবিন ক্রু, গ্রাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার, চার যাত্রীসহ মোট ১০ আরোহীকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। সবাই সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে হাঁটাচলা করতে পারছেন বলে জানায় বিমান কর্তৃপক্ষ। তবে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে স্ট্রেচারে শুইয়েই অ্যাম্বুলেন্সে করে অভ্রকে রাজধানীর অ্যাপোলো হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ১২ মে অভ্রর অস্ত্রোপচার করা হয়। অ্যাপোলো হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, মেরুদন্ডের হাড় ভেঙে যাওয়ায় তার অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। এখন শারীরিক অবস্থা ভালো। মঙ্গলবার থেকে তাকে ফিজিওথেরাপি দেয়া হচ্ছে। এই রোগীকে তিন-চার দিন পর হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেয়া হতে পারে। অভ্রর পরিবারের সদস্যদের দাবি, তিনি আর কখনোই ফ্লাইট স্টুয়ার্ডেসের কাজ করতে পারবেন না। হাঁটাচলা করতে পারলেও এ পেশার জন্য দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, যা অভ্রর পক্ষে করা একেবারেই অসম্ভব। এ কথা অ্যাপোলো হাসপাতালের চিকিৎসকরা অভ্র ও তার পরিবারকে জানিয়ে দিয়েছেন বলে তারা জানান। অভ্রর বরাত দিয়ে তার ভাই নাহিদ হোসেন বলেন, বিমানটি ছিটকে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে অভ্র পড়ে যান। তখনই তার মেরুদন্ডের হাড়ে চির ধরে যায়। একটি হাড় ভেঙে যায়। চির ধরা হাড়ে রক্তক্ষরণও হয়েছিল। সে কারণে অ্যাপোলো হাসপাতালে অভ্রর অস্ত্রোপচার করাতে হয়েছে। চেতনানাশক ইনজেকশনের কার্যক্ষমতা কেটে যাওয়ার পর ওর মেরুদন্ডে প্রচন্ড ব্যথা হয়েছিল। ব্যান্ডেজ খুলে ড্রেসিং করানো হয়েছে। মঙ্গলবার থেকে ফিজিওথেরাপি দেয়া হচ্ছে অভ্রকে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, ফ্লাইট স্টুয়ার্ডেসের কাজ করা তার পক্ষে কখনোই সম্ভব হবে না। নতুন জীবন ফিরে পাওয়াটাই বড় পাওয়া বলে মনে করছেন অভ্র। নাহিদ হোসেন জানান, তাদের পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে অভ্র সবার বড়। ২০১৫ সালের পড়াশোনা শেষ করে বিমানে ফ্লাইট স্টুয়ার্ডেস হিসেবে যোগ দেন অভ্র। কিন্তু চার বছর পেরিয়ে গেলেও অভ্রর মতো ১৪৫ কেবিন ক্রুর চাকরি স্থায়ী করেননি বিমান কর্তৃপক্ষ। ৮৯ দিনের ভিত্তিতে (প্রতি ৮৯ দিন পরপর মেয়াদ বাড়ানো হয়) অস্থায়ী কেবিন ক্রু হিসেবেই চাকরি করে যাচ্ছেন তারা। চার বছরের চাকরিতে তাদের মূল বেতন ২১ হাজার টাকাই রয়েছে। অভ্রর সহকর্মীরা জানান, স্থায়ী কেবিন ক্রুরা ৬৫ ঘণ্টা টানা ফ্লাইটে থাকলেই খাবারের বিল পান ১ হাজার ২০০ মার্কিন ডলার। অতিরিক্ত সময় হলে প্রতি ঘণ্টার জন্য আরও ১৮ ডলার সম্মানী তারা পান। সপরিবারে ফ্রি বিমান টিকিট, সাপ্তাহিক ছুটি, বার্ষিক ছুটি, উৎসব ভাতা, চিকিৎসা ভাতাসহ সব সুবিধাই পাচ্ছেন স্থায়ী কেবিন ক্রুরা। ডিউটি রোস্টারে অস্থায়ী কেবিন ক্রুদের সাপ্তাহিক ছুটির দিন লেখা থাকলেও তাদের স্ট্যান্ডবাই হিসেবে রাখা হয়। প্রয়োজনে তাদের ফ্লাইটে হাজির থাকতে হয়। এর জন্য ভাতা দেয়া হয় না। শ্রম আইন অনুযায়ী কোনো সুযোগ-সুবিধা পান না অস্থায়ী কেবিন ক্রুরা। তাদের ক্ষেত্রে নৈমিত্তিক, বার্ষিক, অসুস্থতাজনিত ও মাতৃত্বকালীন ছুটিও নেই। অস্থায়ী কেবিন ক্রুদের ৮৯ দিন পরপর তাদের চাকরি নবায়ন করা হয়। কিন্তু পরিচয়পত্রে কার্ডের মেয়াদ তিন বছর উলেস্নখ করে থাকে বিমান। অস্থায়ী কেবিন ক্রুরা নিয়মিত অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক আকাশপথে দায়িত্ব পালন করছেন। নিয়মানুবর্তিতা, কর্মদক্ষতা ও অভিজ্ঞতার কারণে ভিভিআইপি ফ্লাইটগুলোতেও রাখা হচ্ছে অনেক অস্থায়ী কেবিন ক্রুকে। অভ্রর সহকর্মীরা জানান, বিমানের রোস্টার অনুযায়ী ৮ মে অভ্রর অভ্যন্তরীণ রুটে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম ও সৈয়দপুরের ফ্লাইট ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে তাকে সকালে সিডিউল পরিবর্তন করে ইয়াঙ্গুনের ফ্লাইটে পাঠানো হয়। অভ্রর পরিবারের সদস্যরা জানান, যত দিন চিকিৎসা চলবে, তত দিন একটি টাকাও অভ্র পাবেন না। অস্থায়ী চাকরির কারণে স্থায়ী কর্মীদের আনুষঙ্গিক কোনো সুযোগ-সুবিধা পাবেন না। চাকরি করতে না পারলে খালি হাতেই বিমান ছাড়তে হবে তাকে। অভ্রর চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে জানান বিমানের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও ক্যাপ্টেন ফারহাত জামিল। তিনি বলেন, অভ্রর শারীরিক অবস্থা আগের মতো ফিরে আসতে পারবে কিনা, সে ব্যাপারে চিকিৎসকরাই ভালো বলতে পারবেন। তার উন্নত চিকিৎসার জন্য সব ব্যবস্থাই নেয়া হয়েছে। মিয়ানমারের আহত এক যাত্রীকে ইয়াঙ্গুন থেকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে সিঙ্গাপুর পাঠিয়েছে বিমান। অভ্র আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা পাবেন কি-না, তা জানতে চাইলে ক্যাপ্টেন ফারহাত জামিল বলেন, 'কত নিয়মকানুনই তো আছে। তবে সেগুলো এ মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না।'