গুলিতে ইউপিডিএফের ৩ কর্মী নিহত

পাহাড় আবারও অশান্ত

আজ সকাল-সন্ধ্যা সড়ক অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে সংগঠনটি

প্রকাশ | ৩১ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০

এম মহাসিন মিয়া, দীঘিনালা (খাগড়াছড়ি)
আবারও রক্তাক্ত হলো পাহাড়ি জনপদ। পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির ২৭ বছরেও পাহাড়ে শান্তি ফেরেনি। এখনো চলছে অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি। এতে অশান্তই রয়ে গেছে পাহাড়। পড়ছে একের পর এক লাশ। আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্বে ঝরছে রক্ত। গতকাল বুধবারও খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ির লতিবান ইউপির শান্তি রঞ্জন পাড়ায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হয়েছেন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) ৩ কর্মী। আর এ হামলার প্রতিবাদে ও দায়ীদের গ্রেপ্তার দাবিতে আজ বৃহস্পতিবার জেলায় সকাল-সন্ধ্যা সড়ক অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে সংগঠনটি। তথ্য অনুযায়ী পাহাড়ে বারবার রক্ত ঝরার নেপথ্যে রয়েছে ৭ সশস্ত্র সংগঠনের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব ও আধিপত্য বিস্তারের লড়াই। চাঁদাবাজি, অপহরণ ও হত্যাসহ নানা অপরাধে লিপ্ত এসব সংগঠনের কর্মীরা। সর্বশেষ সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হলেন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) খাগড়াছড়ির তিন কর্মী। তারা হলেন- সিজন চাকমা (৫০), শাসন ত্রিপুরা (৩৫) ও জয়েন চাকমা (২২)। স্থানীয়রা জানান, বুধবার সকালে জেলার পানছড়ি উপজেলার লতিবান ইউপির শান্তি রঞ্জন ইউপিডিএফ নিয়ন্ত্রিত এলাকায় ইউপিডিএফ কর্মীদের ওপর হামলা চালায় একদল সশস্ত্র গোষ্ঠী। তিনজন নিহত হন। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এ হত্যাকান্ড ঘটতে পারে বলে ধারণা স্থানীয়দের। ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) এই হত্যাকান্ডের জন্য ইউপিডিএফকে (গণতান্ত্রিক) দায়ী করেছে। দলটিকে নব্য মুখোশধারী বাহিনী হিসেবে আখ্যা ইউপিডিএফ জেলা সংগঠক অংগ্য মারমা বলেন, নব্য মুখোশধারী বাহিনী (ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিক) এই হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে। তবে ইউপিডিএফের (গণতান্ত্রিক) সভাপতি শ্যামল কান্তি চাকমা এ হত্যাকান্ডের ঘটনায় জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, 'এটি ইউপিডিএফের অভ্যন্তরীণ দলীয় কোন্দলের কারণে ঘটেছে।' পানছড়ি থানার ওসি বুধবার দুপুরে জানান, 'হত্যাকান্ডের খবর আমরা শুনেছি। কিন্তু ঘটনাস্থল দুর্গম হওয়ায় এখনো লাশ উদ্ধারে যেতে পারিনি। সেখানে এখনো উত্তেজনা বিরাজ করছে।' এদিকে এক বিবৃতিতে, ৩ কর্মীকে হত্যার প্রতিবাদে এবং খুনিদের গ্রেপ্তার-শাস্তির দাবিতে আজ বৃহস্পতিবার খাগড়াছড়ি জেলায় সকাল-সন্ধ্যা সড়ক অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে ইউপিডিএফ। সংশ্লিষ্টরা জানান, ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সরকার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) মধ্যে ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হয়। চুক্তির শর্ত মোতাবেক জেএসএস সভাপতি সন্তু লারমাসহ ১৭শ' জন সদস্য সরকারের কাছে অস্ত্র জমা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফেরেন। এতে পাহাড়ে শুরু হয় শান্তির বাতাবরণ। কিন্তু কিছুদিন যেতে-না যেতেই আবারও সংঘাত শুরু হতে থাকে। বর্তমানে পাহাড়ে অন্তত ৭টি সশস্ত্র সংগঠনের কার্যক্রম রয়েছে। সংগঠনগুলো হলো- জেএসএস (সন্তু লারমা), জেএসএস (সন্তু লারমা) বিরোধী সংস্কারপন্থি জেএসএস (এমএন লারমা), ইউনাইটেড পিপল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ), তাদের বিরোধীয় গ্রম্নপ ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক), কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ), মগ লিবারেশন পার্টি (এমএলপি) ও ম্রো ন্যাশনাল পার্টি (এমএনপি)। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এসব সশস্ত্র সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত আছে আরেক জঙ্গি সংগঠন 'জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া'। কেএনএফের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তারা বান্দরবানের গহিন অরণ্যে অবস্থান নিয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে কেএনএফ ও শারক্বীয়ার অর্ধশতাধিক সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রেপ্তারও হয়েছে। পাহাড়ের এসব সন্ত্রাসী সংগঠন ব্যাপক চাঁদাবাজিতে লিপ্ত। সরকারি বিভিন্ন উন্নয়ন কাজ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও গণপরিবহণ থেকে দেদার চাঁদাবাজি করে তারা। চাঁদাবাজির টাকায় সংগ্রহ করে আগ্নেয়াস্ত্র। চাঁদাবাজি ও বিভিন্ন এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করেই মূলত এসব সশস্ত্র সংগঠনের সন্ত্রাসীরা সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপরও মাঝেমধ্যে হামলা চালায় তারা। তথ্য অনুযায়ী, শান্তিচুক্তির পর গত ২৭ বছরে প্রায় ৯শ' জন পাহাড়ি, প্রায় ৪শ' বাঙালিসহ সামরিক-আধাসামরিক বাহিনীর ২৬ জনসহ ১ হাজার ৩শ' জনের বেশি নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া আহত হয়েছেন প্রায় ২ হাজারের কাছাকাছি। এ ছাড়া চুক্তি-পরবর্তী সময়ে পাহাড়ে অপহরণের শিকার হয়েছেন অন্তত ২ হাজার ২শ' জন। কিন্তু কোনো ঘটনারই দৃষ্টান্তমূলক বিচার হয়নি। স্থানীয়রা বলছেন, পার্বত্য তিন জেলায় সশস্ত্র সংগঠনের মধ্যে সবচেয়ে বেপরোয়া কুকিচিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ)। এ ছাড়া রয়েছে-মগ লিবারেশন পার্টি (এমএলপি), পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস), জেএসএস সংস্কার, ইউনাইটেড পিপলস ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ), ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক, ম্রো ন্যাশনাল পার্টি (এমএনপি) সশস্ত্র কর্মীরা। বর্তমানে পাহাড়ে কেএনএ, মগ বাহিনী, ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক এবং জেএসএস'র তৎপরতা সবচেয়ে বেশি। সশস্ত্র বাহিনীগুলো পাহাড়ে চাঁদাবাজি, অপহরণ, খুন এবং চোরাচালান ও মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছে। যৌথবাহিনীর অভিযানে এসব সশস্ত্র সংগঠনের কর্মীরা গ্রেপ্তারও হচ্ছেন, এরপরও কমছে না তাদের তৎপরতা। এই তিন জেলায় সন্ত্রাস প্রতিরোধ কমিটিও গঠন করা হয়েছে। তারা বলছেন, গোষ্ঠীভিত্তিক দ্বন্দ্ব, অরক্ষিত সীমান্ত, অপ্রতুল সেনা ক্যাম্প ও অস্ত্রের অবাধ সরবরাহের কারণে পাহাড়ে বারবার অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। নড়াইলে ৩ জনকে পিটিয়ে হত্যা এদিকে, গরু চোর সন্দেহে নড়াইলের তুলারামপুর এলাকায় তিনজনকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। বুধবার ভোরে এ ঘটনা ঘটে। পুলিশ জানিয়েছে, নিহত তিনজনের মধ্যে দুইজনের পরিচয় প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। এলাকাবাসী জানান, নড়াইল-ঢাকা-বেনাপোল মহাসড়কের তুলারামপুর এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে গরু চুরির ঘটনা ঘটছে। এরই ধারাবাহিকতায় বুধবার ভোরে তুলারামপুর এলাকার তরফদার বখতিয়ার হোসেন হান্নানের বাড়িতে তিনজন গরু চুরি করতে যায়। এ সময় কুকুরের ডাকে বাড়ির মালিক বিষয়টি টের পেয়ে চিৎকার করেন। পরে তাদের চিৎকারে গ্রামবাসী চোরদের ধাওয়া করে গণপিটুনি দিলে তিনজন নিহত হয়। তাদের সঙ্গে থাকা মোবাইল ফোনে কথা বলে গ্রামের লোকজন জানতে পারেন- এদের মধ্যে দুইজনের বাড়ি বগুড়া জেলার শিবগঞ্জে। নড়াইল সদর থানার ওসি সাজেদুল ইসলাম বলেন, 'মরদেহ উদ্ধার করে আইনগত প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। তাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চলছে। তিনজনের মধ্যে প্রাথমিকভাবে দুইজনের পরিচয় পাওয়া গেছে।'