ডেঙ্গুতে নারীর মৃতু্যহার ক্রমেই ঊর্ধ্বমুখী

নিয়ন্ত্রণে নেই উদ্যোগ

প্রকাশ | ১০ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০

বিশেষ প্রতিনিধি
জ্বরে আক্রান্ত নারীদের দীর্ঘ লাইন। ছবিটি শনিবার কামরাঙ্গীরচর ৩১ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল থেকে তোলা -ফোকাস বাংলা
ঢাকাসহ সারাদেশে ডেঙ্গুতে পুরুষরা বেশি আক্রান্ত হলেও তাদের তুলনায় নারীর মৃতু্যর হার অনেক বেশি। শুধু চলতি বছরেই নয়, দেশে ২০১৯ সালের এপ্রিলে এ রোগের প্রাদুর্ভাব শুরুর পর থেকেই এ ধারা অব্যাহত রয়েছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বেশ কয়েক বছর আগেই এর নেপথ্যের কারণ চিহ্নিত করলে তা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ফলে ডেঙ্গুতে নারীর মৃতু্যর হারে আধিক্য ক্রমেই ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের পহেলা জানুয়ারি থেকে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৬৮ হাজার ২৪৭ জন। এর মধ্যে ৪৩ হাজার ১০৫ জন পুরুষ এবং ২৫ হাজার ১৪২ জন নারী। অথচ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া রোগীর মধ্যে নারী ১৭০ জন, পুরুষ ১৬০ জন। এ হিসাবে পুরুষের মৃতু্যর হার দশমিক ৩৭ শতাংশ। আর নারীর মৃতু্যর হার দশমিক ৬৮ শতাংশ। অর্থাৎ পুরুষের তুলনায় ডেঙ্গুতে নারীর মৃতু্যর হার প্রায় দ্বিগুণ। গত বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া ১ হাজার ৭০৫ জনের ৫৬ দশমিক ৮৯ শতাংশ নারী। আর আক্রান্ত ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জনের মধ্যে নারীর হার ছিল ৪০ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ; ৫৯ দশমিক ৯৭ শতাংশ পুরুষ। ২০২২ সালে ডেঙ্গুতে মৃতদের মধ্যে নারীর সংখ্যা পুরুষের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি ছিল। তবে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ হিসাবে বিশাল ফাঁক রয়েছে। বাস্তবে ডেঙ্গুতে নারীর মৃতু্যর হার আরও অনেক বেশি। কারণ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃতু্যর যে পরিসংখ্যান দেওয়া হচ্ছে শুধুমাত্র ঢাকার ১৮টি সরকারি হাসপাতালসহ ৭৭টি হাসপাতাল এবং ঢাকা বিভাগসহ ৮টি বিভাগের ৮০টি হাসাপাতাল, ক্লিনিক ও চিকিৎসাকেন্দ্রে ভর্তি হওয়া রোগীর। অথচ এর বাইরে বিপুলসংখ্যক স্বায়ত্তশাসিত ও ব্যক্তিমালিকাধীন হাসপাতাল-ক্লিনিকে হাজার হাজার ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হচ্ছে। তাদের একটি অংশ চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাচ্ছে। তবে এসব হাসপাতালে ভর্তি রোগী এবং তাদের মধ্যে মারা যাওয়াদের হিসাব বরাবরই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যানের বাইরে রয়ে গেছে। এ ছাড়া হাসপাতালে ভর্তি না হয়ে বাসা-বাড়িতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বা বিনা চিকিৎসায় মারা যাওয়া রোগীর কোনো হিসাব নেই কারো কাছে। চিকিৎসকদের দাবি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তালিকার বাইরে থাকা ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া রোগীর সংখ্যা পর্যালোচনা করলে সে হারে নারীরা আরও অনেক বেশি এগিয়ে। কেননা, নানা বাস্তবতায় পুরুষদের তুলনায় নারীরা অনেক কম হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। এছাড়া চিকিৎসাসেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও তারা অনেক পিছিয়ে। ডেঙ্গুতে নারীদের অধিক মৃতু্যর হার সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, জেনেটিক কারণে নারীদের জটিলতা বেশি দেখা দেয়। আর এ কারণে ডেঙ্গুতে তাদের মারা যাওয়ার হার বেশি। এছাড়া গর্ভাবস্থায় ও ঋতুস্রাবকালে কোনো নারী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে তাদের মৃতু্য ঝুঁকি বেশি থাকে। অন্যদিকে পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে নারীরা তাদের যত্ন নেন। কিন্তু নিজে অসুস্থ হলে গুরুত্ব কম দেন। অসুস্থ হলে বাসায় থেকে চিকিৎসা নেন তারা। এসব কারণে হাসপাতালেও দেরি করে আসেন। দেরি করে আসলে ঝুঁকিতে থাকেন তারা। যা নারীর অধিক হারে মৃতু্যর অন্যতম কারণ। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, একক কারণে এমনটা হচ্ছে তা বলা যাবে না। হরমোনগত দিক দিয়ে ভাবলেও দেখা যায় নারী ও পুরুষের মধ্যে পার্থক্য আছে। নারীদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক কম থাকে। শারীরিক জটিলতা নারীদের বেশি হয়। আমাদের দেশের নারীদের মধ্যে রোগ নিয়ে অবহেলা করার প্রবণতা আছে। যাচ্ছি-যাব- এমন একটা ভাব থাকে। ফলে অসুখে ভুগলেও তারা হাসপাতালমুখো হন না। মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এ বি এম আবদুলস্নাহ বলেন, বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে নারীরা সবদিক থেকেই নিজের প্রতি যত্ন কম নেয়। সবার খোঁজ নিতে গিয়ে নিজের শরীরের যত্ন নেয় না, এমনকি অসুস্থ হলেও সেদিকে তার নজর থাকে না। অনেকেই ডেঙ্গু হলে সেটাকে স্বাভাবিক সর্দি-জ্বর মনে করেন। তারা টেস্ট করেন না। নিজের দিকে খেয়াল না করে কালক্ষেপণ করেন। ফলে সিরিয়াস পর্যায়ে চলে যায়। ডেঙ্গুর ধরন বদলে যাওয়ায় নারীর এই মনোভাব যে মৃতু্য বাড়িয়ে দিয়েছে সে ইঙ্গিত দেন এই চিকিৎসক। এ বি এম আবদুলস্নাহর পর্যবেক্ষণ, খাওয়াদাওয়ার ক্ষেত্রেও নারীরা উদাসীন। শহরে নারীরা রোদের সংস্পর্শ কম পাওয়ায় অনেকের শরীরে 'ভিটামিন ডি'-এর ঘাটতি থাকছে। তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও কম থাকে। তাতে সিরিয়াস পর্যায়ে চলে গেলে ধাক্কাটা আর সামলাতে পারে না। চিকিৎসার ব্যাপারে উদাসীন থাকায় তারা সবসময় দেরি করে ডাক্তারের কাছে যায়। কিন্তু পরিস্থিতি জটিল হয়ে গেলে তখন কিছু করার থাকে না। এ কারণে আক্রান্তের দিক থেকে পুরুষের সংখ্যা বেশি হলেও নারীদের মৃতু্য বেশি। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানান, ডেঙ্গুতে পুরুষের তুলনায় নারীরা কেন বেশি মারা যাচ্ছেন সেটি নিয়ে এখনো কোনো গবেষণা করা হয়নি। গাইনি ও অবস চিকিৎসকেরা এটি নিয়ে গবেষণা করতে চাইলেও তাদের সে উদ্যোগ বাস্তবায়নে গতি পায়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের মতো পৃথিবীর কোনো দেশেই ডেঙ্গুতে এতো মৃতু্য রেকর্ড নেই। বিশেষ করে নারীদের মৃতু্যর যে অধিক হার তা বিশ্বের অন্য কোনো দেশ কল্পনাও করতে পারে না। এটি সরকারের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা বলেও মত দেন তারা। সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থা যেটা আছে সেটা বিকেন্দ্রীকরণ হয়নি। এছাড়া যারা শনাক্ত হচ্ছে কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ রোগী নয় তাদের মাঠপর্যায়ে হাসপাতালে রাখার কথা, আবার যারা জটিল রোগী তাদেরও একসঙ্গে রাখা হচ্ছে ফলে তারা যথার্থ চিকিৎসা পাচ্ছে না। সব এক জায়গায় হওয়ার কারণে ব্যবস্থাপনা করা যাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসা ব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণ জরুরি। অথচ বাস্তবে তা হচ্ছে না। এছাড়া অনেক ক্ষেত্রেই রোগীকে উপজেলা পর্যায়ে প্রাথমিক চিকিৎসা না দিয়ে জেলা কিংবা বিভাগীয় হাসপাতালে রেফার করা হয়। এতে মধ্যবর্তী সময়ে অনেক রোগী পস্নাটিলেট কমে গিয়ে মুমূর্ষু হয়ে যায়। নারীদের ক্ষেত্রে এ ঘটনাটি বেশি ঘটে। তাই অন্তিম অবস্থায় চিকিৎসা পাওয়া এসব রোগীকে সুস্থ করা কঠিন হয়ে পড়ে বলে জানান জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, একটি ডেঙ্গু রোগীকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সেই চিকিৎসা দিতে পারে। অথচ তা না করে জেলা হাসপাতালে ট্রান্সফার করে বা বিভাগীয় হাসপাতালে ট্রান্সফার করে দেয়। এতে যে সময় লাগে এতে রোগীর পস্নাজমালি কেইস হয়ে যায়, পস্নাটিলেট কাউন্ট কমে যায়। কমে গিয়ে এই রোগীটির অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। এজন্য স্বাস্থ্যসেবা খাতকে ঢেলে সাজিয়ে আরও সহজলভ্য ব্যবস্থা নিশ্চিতের তাগিদ দিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মুশতাক হোসেন। তিনি বলেন, বাড়ির কাছে যদি বিনামূল্যে টেস্ট করার ব্যবস্থা থাকত তাহলে তারা অবশ্যই যেত। তারা মনে করে একটা টেস্ট করে এত টাকা খরচ করব কেন? ওষুধের পেছনেও খরচ হবে। যেহেতু স্বাস্থ্যসেবাটা সহজলভ্য নয়, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ঘরের পাশে নাই, তাই নারী-পুরুষ উভয়েই বঞ্চিত হচ্ছে। তবে নারীদের বঞ্চিত হওয়ার হার অনেক বেশি।