সাহরি-ইফতারের আনুষ্ঠানিকতাই রোজা নয়

প্রকাশ | ২৩ মে ২০১৯, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
অনেকেই মনে করেন, রোজা মানেই সাহরি ও ইফতারের আনুষ্ঠানিকতা। অথচ ধর্মীয় নির্দেশনা অনুযায়ী, শুধু সাহরি ও ইফতারের মধ্যেই রোজার তাৎপর্য সীমাবদ্ধ নয়। রোজার অন্যতম উদ্দেশ্য রোজাদারের জীবনকে পবিত্র, পরিশীলিত ও সংযত রাখার পাশাপাশি ধর্মীয় বিধি-নিষেধ নিয়মমাফিক পালন করা। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়সহ দৈনন্দিন ফরজ ইচ্ছাকৃতভাবে বাদ দিলে রোজা কবুল হওয়ার কোনো সুযোগ থাকে না। অন্যদিকে মহান আলস্নাহ এ মাসের প্রতিটি মুহূর্তকে নির্ধারণ করেছেন সংযম সাধনার জন্য। রমজান সংযমী হওয়ার শিক্ষা দেয়। তাই শুধু পানাহার থেকে বিরত থাকাই সিয়াম সাধনার মূল উদ্দেশ্য নয়। পানাহার থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি নিজের মুখ ও জিহ্‌বা সংযত রাখা জরুরি। মহানবী (সা.) বলেছেন, 'বহু রোজাদার এমন আছে, রোজার বিনিময়ে সে উপবাস থাকা ছাড়া আর কিছুই লাভ করতে পারে না।' সুতরাং রোজাদার ব্যক্তি মিথ্যা কথা বললে, অন্যের দোষ চর্চা করলে, হারাম মাল ভক্ষণ করলে, পাপ কাজ করলে, রোজার শক্তি ও বরকত নষ্ট হয়ে যায়। কাজেই রোজার বরকত অক্ষুণ্ন রাখতে হলে জীবনের সব ক্ষেত্রে সংযমী হতে হবে। পবিত্র ইসলামে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে, শুধুমাত্র বিশেষ অঙ্গভঙ্গি, তীর্থ ভ্রমণ কিংবা চিত্তবিনোদনমূলক কাজকর্ম ইবাদত হিসেবে গণ্য হয় না। বরং মানবজীবনের সব ক্ষেত্রেই ইসলামের বিধান ও নির্দেশনা রয়েছে। সেসব বিধান উপেক্ষা করে নির্দিষ্ট কিছু আচার-অনুষ্ঠান পালন করলেই ঈমানের দাবি পূর্ণ হয় না। মহান আলস্নাহ বলেন, 'হে ঈমানদাররা! তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ করো, আর শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রম্ন।' (সুরা বাকারা, আয়াত: ২০৮) অথচ বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় সংযমী রোজাদারের বড়ই অভাব। যা শুধুমাত্র ইফতারির আয়োজন লক্ষ্য করলেই স্পষ্ট হওয়া যায়। অফিস-আদালত, রাস্তা-ঘাট, পাড়া-মহলস্নার রেষ্টুরেন্ট ঘুরলেই দেখা যায়, ইফতার আয়োজনে যারা অংশ নিচ্ছেন এদের একটি বড় অংশ মাগরিবের নামাজ আদায় থেকে বিরত থাকছেন। এমনকি এদের অনেকেই অন্যান্য ওয়াক্তেও নামাজ পড়ছেন না। অথচ শুধুমাত্র ইফতারির জন্য তাদের অনেকেই মোটা অংকের অর্থ ব্যয় করছেন। এমনকি কেউ কেউ তাদের অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ দিয়ে বিপুল সংখ্যক রোজাদার ব্যক্তিকে ইফতারি করাচ্ছেন। অথচ কোরআন-হাদিসে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে, হালাল রুজি ছাড়া কোনো দোয়া, ইবাদত কবুল হবে না। নবী করিম (সা.) বলেছেন- 'যে দেহে হারাম খাদ্যে উৎপন্ন গোশত রয়েছে, তা জান্নাতে যাবে না।' নবী করিম (সা.) আরও বলেছেন- 'হালাল জীবিকা সন্ধান করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ফরজ।' (তাবরানি ও বায়হাকি)। কথিত আছে যে, মুসা (আ.) একজন অতিবৃদ্ধ ব্যক্তির দেখা পেলেন। যিনি দিনভর নফল রোজা রাখেন ও দীর্ঘ সময় নফল নামাজে অতিবাহিত করে আলস্নাহর কাছে হাত তুলে দোয়া-মোনাজাতে কান্নাকাটি করে সময় কাটান। তুর পাহাড়ে আলস্নাহর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ওই বৃদ্ধের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে আলস্নাহ জবাবে বললেন- ওই বৃদ্ধের কোনো দোয়া ও ইবাদত কবুল হচ্ছে না, কারণ তার দেহে হারাম খাদ্যে সৃষ্ট গোশত বিদ্যমান ও তার পরনে হারাম উপার্জনের পোশাক। আবু বকর (রা.) সারাদিন রোজা রেখে ইফতারের জন্য বসেছেন, এমন সময় তার চাকর একটু খাদ্য এনে ওনার সামনে রাখলো, তিনি এক লোকমা খেয়ে চাকরকে জিজ্ঞাসা করলেন- এ খাদ্য কোথা থেকে এনেছ? সে বলল- জাহেলি যুগে আমি গণকের কাজ করতাম, কিন্তু আমি গণনার নামে মানুষকে ফাঁকি দিতাম। ওই সময়ে একজন আমার নিকট বাকিতে ভাগ্য গণনা করেছিল। আজকে সে টাকা পরিশোধ করলে আমি তা দিয়ে খাদ্য কিনে আনলাম। আবু বকর (রা.) তৎক্ষণাৎ উঠে গিয়ে গলায় আঙ্গুল ঢুকিয়ে বমি করে ওই খাদ্য ফেলে দিলেন। অতঃপর বললেন নবী (সা.) বলেছেন- হারাম খাদ্যে সৃষ্ট গোশত জান্নাতে যাবে না। জাহান্নামই তার উত্তম ঠিকানা। তাই আমি মরে গেলেও এ অবৈধ খাদ্য বমি করে বের করতাম। নবী (স.) বলেছেন- বৈধ উপার্জনের সঙ্গে অবৈধ অল্প উপার্জনও যদি একত্র হয়, তখন পুরো উপার্জন অবৈধ বলে গণ্য হবে। যিনি যে বিভাগে কর্মরত তিনি যদি কর্মে ফাঁকি দেন, তবে তার বেতন বৈধ হবে না। এমনকি সরকারি চাকরিজীবীদের সম্মানী, উপহার ইত্যাদি গ্রহণও বৈধ নয়। এ মর্মে আলস্নাহর সুস্পষ্ট ঘোষণা, 'আমি জিন এবং মানুষকে আমার ইবাদতের জন্যই সৃষ্টি করেছি। আমি তাদের থেকে কোনো রিজিক চাই না এবং তাদের থেকে আমি খাবারও চাই না' (যারিয়াত ৫৬-৫৭)। মহান আলস্নাহ তা'আলা আরো বলেন, 'হে ঈমানদারগণ! তোমরা পবিত্র বস্তু-সামগ্রী আহার কর, যেগুলো আমি তোমাদের রুজি হিসাবে দান করেছি এবং শুকরিয়া আদায় কর আলস্নাহর, যদি তোমরা একমাত্র তারই ইবাদত করে থাক' (বাকারাহ ১৭২)। এ আয়াতে হারাম খাদ্য ভক্ষণ করতে যেমন নিষেধ করা হয়েছে, তেমনি হালাল ও পবিত্র বস্তু খেতে এবং তা খেয়ে আলস্নাহর শুকরিয়া আদায় করতে অনুপ্রাণিত করা হয়েছে। কারণ ইবাদত কবুল হওয়ার জন্য হালাল রুজি খাওয়া অত্যাবশ্যক। কেননা হারাম খাদ্য খেলে মনের মধ্যে খারাপ অভ্যাস সৃষ্টি হয়, ইবাদত-বন্দেগিতে আগ্রহ স্তিমিত হয়ে আসে এবং দোয়া কবুল হয় না। অন্যদিকে হালাল খাদ্য গ্রহণের ফলে মানব মনে এক প্রকার আলো সৃষ্টি হয়, যা অন্যায়ের প্রতি ঘৃণাবোধ সৃষ্টি করে এবং সততা ও ন্যায়-নিষ্ঠার প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি করে, ইবাদত-বন্দেগিতে মনোযোগ আসে, পাপের কাজে ভয় আসে এবং দোয়া কবুল হয়। এ জন্যই আলস্নাহ তা'আলা সমস্ত আম্বিয়ায়ে কেরামের উদ্দেশে বলেছেন, 'হে রাসূলগণ! তোমরা হালাল খাদ্য গ্রহণ কর এবং নেক আমল কর' (মুমিন ৫১)।