ধানের দাম: সংকট অনুমানে ব্যর্থ হয়েছে সরকার!

প্রকাশ | ২৪ মে ২০১৯, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
শেরপুরের নালিতাবাড়ীতে ধান কাটায় ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষক -পিবিএ
বিভিন্ন হিসাব-নিকাশ আর পূর্বাভাস অনেকটা আগে থেকেই ধারণা দিচ্ছিল যে, এবার বাংলাদেশে বোরো ধানের উৎপাদন বেশ ভালো হবে। শেষ পর্যন্ত সেটাই হয়েছে- এবার ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক কোটি ৪০ লাখ টন; কিন্তু উৎপাদন বেশি হয়েছে এর চেয়ে ১৩ লাখ টন। ধানের উৎপাদন বৃদ্ধি স্বাভাবিকভাবেই বেশ খুশির খবর; কিন্তু এবার এটি উল্টো ফল বয়ে এনেছে বেশিরভাগ কৃষকের জন্য। ধানের দাম এতটাই কমে গেছে যে, তীব্র ক্ষোভে ফসলের মাঠে আগুন ধরিয়ে দিয়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছেন টাঙ্গাইলের এক কৃষক। বিভিন্ন জায়গায় কৃষকরা নানা উপায়ে প্রতিবাদ করেছেন। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে, পরিস্থিতি যে এ রকম হবে সেটি সরকার আগে থেকে আঁচ করতে পারেনি কেন? ধানের উৎপাদন কত হবে এবং বাজার পরিস্থিতি কেমন হবে, সে তথ্য কি সরকারের কাছে ছিল না? বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ বা সিপিডির গবেষক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, গত বছর যেহেতু ধানের দাম মোটামুটি পাওয়া গিয়েছিল, সেজন্য এবার কৃষকরা বেশি পরিমাণে উৎপাদনে যাবেন তা আগেই অনুমান করা যাচ্ছিল। তিনি বলেন, সরকারের ফুড পস্ন্যানিং অ্যান্ড মনিটরিং ইউনিট নিয়মিতভাবে দেশের খাদ্য পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে। এবার বোরো মৌসুমে উৎপাদন কেমন হতে পারে এবং সরকারের কাছে ধান-চালের মজুত কতটা রয়েছে, সে সংক্রান্ত তথ্য তাদের কাছে রয়েছে। সরকারের এ সংক্রান্ত একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটিও আছে, যাতে পরিস্থিতির বিবেচনা করে খাদ্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আগাম সিদ্ধান্ত নেয়া যায়। খন্দকার মোয়াজ্জেম বলেন, 'তাদের পক্ষে আগাম অনুমান করার সুযোগ ছিল যে, বাজারে কী পরিমাণ সরবরাহ রয়েছে এবং আগামীতে কী পরিমাণ উদ্বৃত্ত হতে পারে। কৃষক পর্যায়ে এর প্রতিক্রিয়া কেমন হতে পারে, সেটি অনুমান করারও সুযোগ ছিল।' বাজার পরিস্থিতি কেমন হতে পারে, সরকার সে ব্যাপারে অনুমান করতে পারেনি বলে মনে করেন অনেক অর্থনীতিবিদ। বিশ্লেষকদের মতে, সরকার যদি সে অনুমান করতে পারত, তাহলে এখন ধানের দাম নিয়ে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তা এড়ানো যেত। ধানের দাম নিয়ে কৃষক পর্যায়ে হতাশা যখন চরমে, তখন সরকার বেশ তড়িঘড়ি করে বিদেশ থেকে চাল কেনা নিরুৎসাহিত করার জন্য আমদানিতে শুল্ক বাড়িয়েছে; কিন্তু তাতেও পরিস্থিতি কোনো উন্নত হবে কি-না, তা নিয়ে সংশয় আছে। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, সংকট যদি সরকার অনুমান করতে পারত, তাহলে আরও আগেই চাল আমদানি নিরুৎসাহিত করতে পারত; কিন্তু তা হয়নি। চাল আমদানি নিরুৎসাহিত করতে এখন যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, তা এই মৌসুমের জন্য কোনো কাজে লাগবে না বলে মনে করেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের অর্থনীতিবিদ নাজনীন আহমেদ। তার মতে, এরই মধ্যে আমদানি হয়ে অনেক চাল দেশের ভেতরে আছে। তাই ওই মজুদ না কমা পর্যন্ত কৃষকদের কোনো লাভ হবে না। তিনি বলেন, 'কৃষকরা সংকটে আছেন এ মুহূর্তে। তারা ইতোমধ্যে কম দামে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকের পক্ষে বেশি দিন ধান রেখে দেয়া সম্ভব নয়।' বোরো মৌসুমে ধান উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রাকে ছাড়িয়ে গেছে বলে জানান বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ক্রপস উইংয়ের পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম। তিনি জানান, প্রতি মৌসুমে সরকারের নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। দেশে ধান-চালের মজুত কতটা রয়েছে এবং কী পরিমাণ প্রয়োজন হতে পারে, সেটির ওপর ভিত্তি করেই ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এই যখন পরিস্থিতি, তখন কৃষকদের কথা চিন্তা করে ধানের বাজার স্থিতিশীল রাখার জন্য সরকার আগে থেকে ব্যবস্থা নেয়নি কেন- এ প্রশ্নের সরাসরি উত্তর মিলছে না দায়িত্বশীলদের কাছ থেকে। তবে কয়েকদিন আগে বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, এবার কৃষকদের কিছুটা ক্ষতি হবেই। তিনি উলেস্নখ করেন, সরকার যতটা সম্ভব চেষ্টা করছে ধান ক্রয়ের মাধ্যমে কৃষকদের ক্ষতি পুষিয়ে দেয়ার। ক্ষুদ্র এবং মাঝারি কৃষকদের ক্ষতি পুষিয়ে দেয়ার জন্য এখন সরকারের হাতে একটি মাত্র রাস্তা রয়েছে, আর সেটি হলো- সরকারিভাবে যেসব ধান-চাল ক্রয় করা হচ্ছে, সেখানে ক্ষুদ্র এবং মাঝারি কৃষকদের বাড়তি সুবিধা দেয়া। অন্তত এমনটাই মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।