জাতীয় পতাকায় আগুন :মমতার ধৃষ্টতাপূর্ণ বক্তব্য

আগরতলায় বাংলাদেশ হাইকমিশনে হামলা

প্রকাশ | ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
আগরতলায় সোমবার বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনে ভাঙচুর চালান উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা -সংগৃহীত
ইসকনপন্থী সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ভারতের আগরতলায় বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনে ভাঙচুর ও জাতীয় পতাকা অবমাননার ঘটনা ঘটেছে। সোমবার দুপুরের দিকে এই ঘটনা ঘটে। কিছু ভিডিওতে দেখা যায় উগ্র হিন্দুত্ববাদী বিক্ষোভকারীরা বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা নামিয়ে ফেলার পর তাতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে হিন্দু সংঘর্ষ সমিতি নামের একটি সংগঠনের সভা ছিল আগরতলার বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনের সামনে। সভা শেষে সংগঠনের ছয়জনের একটি প্রতিনিধি দল হাইকমিশন কার্যালয়ের ভেতরে যায় স্মারকলিপি জমা দিতে। এ সময় বাইরে থাকা উগ্রবাদীরা হঠাৎ বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশন কার্যালয়ের ভেতরে ঢুকে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা নামিয়ে ছিঁড়ে ফেলে ও তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। পরে হাইকমিশন কার্যালয়ের কিছু সাইনবোর্ড ভাঙচুর করে তারা। এই বিষয়ে হিন্দু সংঘর্ষ সমিতি কার্যকরী সদস্য বিকে রয় জানিয়েছেন, ডেপুটেশন দেওয়ার সময় বাইরে কী ঘটনা ঘটেছে তা তারা দেখেননি এবং তারা ডেপুটেশন দিয়ে আসার পরও কাউকে অফিসের ভেতরে দেখতে পাননি। ঘটনার খবর পেয়ে ত্রিপুরা পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে গিয়ে বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনের অফিসটি ঘুরে দেখেন এবং হাইকমিশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলেন। তবে এ বিষয়ে ভারতের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সেখানে উপস্থিত সাংবাদিকদের কাছে কোনো মন্তব্য করেননি। একই ঘটনায় বিক্ষোভ হয়েছে ভারতের কোচবিহারেও। সেখানে বাংলাদেশের অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কুশপুত্তলিকা পুড়িয়ে বিক্ষোভ দেখায় সনাতনী হিন্দু মঞ্চ। সংগঠনটির সদস্যরা পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া চ্যাংড়াবান্ধায় বিক্ষোভ মিছিলও করে। এই কর্মসূচি ঘিরে কড়া নিরাপত্তা ছিল সীমান্ত এলাকায়। বিক্ষোভ হয়েছে ভারতের পেট্টাপোল সীমান্তেও। সেখানে সমাবেশ হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দলের নেতা শুভেন্দু অধিকারীর নেতৃত্বে। সমাবেশ থেকে অভিযোগ করা হয়, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। এটি বন্ধ না হলে ভবিষ্যতে সীমান্তে দীর্ঘমেয়াদি অবরোধ দেওয়ার ঘোষণাও দেন তারা। ভারতের দুঃখ প্রকাশ ভারতের আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশন প্রাঙ্গণে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সোমবার এক বিবৃতিতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, আগরতলায় বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনের প্রাঙ্গণ ভাঙার ঘটনাটি খুবই দুঃখজনক। কোনো অবস্থাতেই কূটনৈতিক ও কনসু্যলার সম্পত্তি হামলার লক্ষ্যবস্তু করা উচিত নয়। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, এমন পরিস্থিতিতে নয়াদিলিস্নতে বাংলাদেশ হাইকমিশন এবং ভারতে অবস্থিত বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার জন্য সরকার ব্যবস্থা নিচ্ছে। শান্তিরক্ষী পাঠানোর প্রস্তাব মমতার এদিকে, বাংলাদেশে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী পাঠাতে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সোমবার বিধানসভার শীতকালীন অধিবেশনে যোগ দিয়ে তৃণমূল নেত্রী মমতা বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপও চেয়েছেন। এনডিটিভি লিখেছে, বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ- ইসকনের তিনজন সন্যাসী গ্রেপ্তার হওয়ার খবরের মধ্যেই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী এমন দাবি তুললেন। রাজ্যসভার অধিবেশনে মমতা বলেন, 'আমাদের প্রস্তাব, কেন্দ্র রাষ্ট্রপুঞ্জের কাছে বাংলাদেশে শান্তিসেনা পাঠানোর আর্জি জানাক।' গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে যে টানাপড়েন চলছে, তাতে নতুন মাত্রা যোগ করল মমতার এই আহ্বান। তিনি বলেন, 'আমাদের পরিবার, সম্পত্তি এবং প্রিয় মানুষেরা বাংলাদেশে আছেন। ভারত সরকার এই বিষয়ে (বাংলাদেশ) যে অবস্থান নেবে, আমরা তা গ্রহণ করব। কিন্তু বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে ধর্মীয় কারণে কেউ অত্যাচারিত হলে আমরা তার নিন্দা জানাই। আমরা এই বিষয়ে ভারত সরকার এবং প্রধানমন্ত্রীকে হস্তক্ষেপ করার আর্জি জানাচ্ছি।' কলকাতায় ইসকনের প্রধানের সঙ্গে কথা বলে সহমর্মিতা জানানোর কথা তুলে ধরে মমতা বলেন, 'যদি বাংলাদেশে ভারতীয়রা আক্রান্ত হন, তবে আমরা তা সহ্য করব না। আমরা তাদের সেখান থেকে ফিরিয়ে আনতে পারি। ভারত সরকার বিষয়টা রাষ্ট্রপুঞ্জে (জাতিসংঘ) নিতে পারে, যাতে সেখানে শান্তিসেনা পাঠানো হয়।' আনন্দবাজার লিখেছে, বিধানসভায় দেওয়া বক্তৃতায় মমতা বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে তার দল ও রাজ্য সরকারের অবস্থান আবারো স্পষ্ট করেছেন। তিনি বলেছে, এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের নেই। তাই তারা কেন্দ্র সরকারের পরামর্শ মেনে চলবেন। এর আগে, গত বৃহস্পতিবার কলকাতা বিমানবন্দরেও মমতা সাংবাদিকদের একই কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে গ্রেপ্তার নিয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার যে অবস্থান নেবে তার প্রতি তিনি সমর্থন জানাবেন। কিন্তু বাংলাদেশ নিয়ে নরেন্দ্র মোদির সরকার 'চুপ করে আছে' বলে সোমবার বিধানসভায় অভিযোগ তোলেন মমতা। তিনি বলেন, ''আমি গত ১০ দিন ধরে দেখছি কেন্দ্রীয় সরকার চুপ করে রয়েছে। অথচ তাদের দল (বিজেপি) বলছে 'সব আটকে দেব'। কিন্তু এই বিষয়ে আমাদের কোনো এখতিয়ার নেই।'' এনডিটিভি লিখেছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গত সপ্তাহে বাংলাদেশের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে বৈঠক করেন। পরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। মোদির সঙ্গে ওই বৈঠকের পর জয়শঙ্কর পার্লামেন্টেও এ বিষয়ে বিবৃতি দেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে 'সংখ্যালঘু নিপীড়নের' বিষয়টি ভারত সরকার গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে। ভারতে পালানোর তথ্য সঠিক নয় : দ্য হিন্দু \হ এছাড়া গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর থেকে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন বলে খবর প্রকাশ করছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো। ভারতীয় বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে দাবি করা হচ্ছে, নির্যাতনের শিকার হয়ে দলে দলে মানুষ পালিয়ে ভারতে চলে যাচ্ছেন। তবে ভারতের প্রসিদ্ধ সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দু জানিয়েছে, এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটছে না। হাসিনার সরকারের পতনের পর দলে দলে মানুষের ভারতে পালিয়ে যাওয়া বা ভারতে ঢোকার কোনো চেষ্টা হয়নি। রোববার (১ ডিসেম্বর) প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে পরিসংখ্যান উলেস্নখ করে এমনটাই বলা হয়েছে। দ্য হিন্দু বলছে, ৫ আগস্ট, বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর থেকে ২৭ নভেম্বর পর্যন্ত সীমান্তে ১ হাজার ৩৯৩ বাংলাদেশি আটক হয়েছেন। এর আগে জানুয়ারি থেকে ৪ আগস্ট পর্যন্ত (আ'লীগ সরকারের সময়) ১ হাজার ১৪৪ জন বাংলাদেশিকে আটক করা হয়। যার অর্থ আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর হাজার হাজার মানুষের সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার কোনো চেষ্টার ঘটনা ঘটেনি। সংবাদমাধ্যমটি জানিয়েছে, সব মিলিয়ে চলতি বছর এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ সীমান্তে মোট ৩ হাজার ৯০৭ অনথিভুক্ত ব্যক্তি আটক হয়েছেন, যার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশি, ভারতীয় এবং অন্যান্য জাতীয়তার মানুষ। ২০২৩ সালে এ সময় পর্যন্ত আটক হওয়া বাংলাদেশিদের সংখ্যা ৩ হাজার ১৩৭ যা ২০২২ সালের ৩ হাজার ৭৪ জনের কাছাকাছি। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী- বিএসএফ জানিয়েছে, গত আগস্ট মাস থেকে কঠোর নজরদারিতে রয়েছে সীমান্ত। এমএইচএ'র নির্দেশে বৈধ নথি ছাড়া কাউকে দেশে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। গত ১ জানুয়ারি থেকে ৪ আগস্ট পর্যন্ত কোনো কাগজপত্র ছাড়াই বাংলাদেশে প্রবেশকারী ৮৭৩ জন ভারতীয়কে আটক করা হয়েছে। বিএসএফের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বলেছেন, বাংলাদেশে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেপ্তারের পর সীমান্তে নজরদারি আরও বাড়ানো হয়েছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যরা তাদের নিরাপত্তার ভয়ে ভারতে প্রবেশ করতে চাইতে পারে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এমন কোনো দৃশ্য দেখা যায়নি। উত্তরবঙ্গের দিনাজপুর থেকে কয়েকটি খবর পাওয়া গেলেও এখন পর্যন্ত ভারতে আশ্রয়ের জন্য কোনো বড় ধরনের গণ-অভিবাসনের খবর পাওয়া যায়নি। বিএসএফ আর বলছে, ৫ আগস্ট থেকে ২৭ নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে পাড়ি জমাতে চেয়েছিলেন এমন ভারতীয়র সংখ্যা ৩৮৮ জন। এ বছর মিয়ানমারসহ অন্যান্য জাতিসত্তার ১০৯ জনকেও সীমান্তে আটক করা হয়েছে। ২০১৮, ২০১৯, ২০২০, ২০২১ এবং ২০২২ সালে সীমান্তে আটক বাংলাদেশির সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ২ হাজার ৯৯৫ জন, ২ হাজার ৪৮০ জন, তিন হাজার ২৯৫ জন, দুই হাজার ৪৫১ জন এবং তিন হাজার ৭৪ জন। অর্থাৎ ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সীমান্তে আটক হওয়া বাংলাদেশিদের সংখ্যা ২,৪৮০ থেকে ৩,২৯৫-এর মধ্যে ওঠানামা করেছে। এই ধারাবাহিকতা থেকেই বোঝা যায়, বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেও বড় ধরনের পরিবর্তন হয়নি। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের ৪ হাজার ৯৬ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ মেনে বৈধ নথিপত্র ছাড়া কাউকে সে দেশে প্রবেশের অনুমতি দিচ্ছে না দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ। ৫ আগস্টের পর বিএসএফ বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) কর্মকর্তাদের সঙ্গে শত শত বৈঠক করেছে।