উত্তরাঞ্চলে ঘন কুয়াশার দাপট
শৈত্যপ্রবাহের কাছাকাছি তিন জেলার তাপমাত্রা
প্রকাশ | ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি ডেস্ক
শীত ঋতু শুরু হতে এখনো এক সপ্তাহ বাকি। তবে এ বছর আগেভাগেই হানা দিয়েছে শীত। চলতি ডিসেম্বরের প্রথম থেকেই উত্তরের জনপদে হিমেল হাওয়া আর কুয়াশা সঙ্গী করে শীত নামতে শুরু করেছে। মাসের এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই শৈত্যপ্রবাহের কাছাকাছি পৌঁছেছে তিন জেলার তাপমাত্রা। জেলাগুলো হচ্ছে- পঞ্চগড়, দিনাজপুর ও নওগাঁ। এসব অঞ্চল কুয়াশার চাদরে মোড়ানো থাকছে দিনের বেশিরভাগ সময়। কোথাও কুয়াশা ঝরছে হালকা বৃষ্টির মতো। ঘন কুয়াশায় দৃষ্টিগ্রাহ্যসীমা কমে আসায় দিনেও যানবাহনগুলোকে আলো জ্বেলে পথ চলতে হচ্ছে। সৈয়দপুরে ব্যাহত হচ্ছে বিমান ওঠানামা। এতে বেড়ে যাচ্ছে দুর্ঘটনার ঝুঁকি। পাশাপাশি শীতের কারণে বিপাকে পড়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষ। শীতজনিত রোগের প্রকোপও শুরু হয়েছে জেলাগুলোতে। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, এবার শীত হানা দিয়েছে আগেভাগেই।
এদিকে, শনিবার দেশের তাপমাত্রা সর্বনিম্ন ৯ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড হয়েছে নওগাঁর বদলগাছীতে। আবার এরইমাঝে
বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপ সৃষ্টির আভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। শনিবার সংস্থাটি জানায়, আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরের মধ্যাঞ্চলে একটি লঘুচাপ সৃষ্টি হতে পারে।
নওগাঁ: শনিবার সকালে নওগাঁর বদলগাছী আবহাওয়া অধিদপ্তরের উচ্চ পর্যবেক্ষক মিজানুর রহমান বলেন, 'ঘন কুয়াশার সঙ্গে উত্তরের হিমেল বাতাস প্রবাহিত হওয়ায় তাপমাত্রা নিম্নমুখী হতে শুরু করেছে। তাপমাত্রার ব্যবধান কমে যাওয়ায় তীব্র শীত অনুভূত হচ্ছে এখানে। শনিবার সকালে নওগাঁয় দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৯.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যা শুক্রবার ছিল ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।'
তাপমাত্রা আরও নিচে নামতে পারে বলে জানান এই আবহাওয়া কর্মকর্তা।
গত কয়েকদিন ধরেই নওগাঁ জেলায় শীত জেঁকে বসেছে। ভোর থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত এবং সন্ধ্যা রাতেও ঘন কুয়াশায় ঢেকে থাকছে জনপদ। এ অবস্থায় দিনের বেলায়ও যানবাহনে লাইট জ্বালিয়ে যাতায়াত করতে হচ্ছে। তীব্র শীতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কষ্টে পড়েছেন জেলার খেটে খাওয়া দিনমজুর, রিকশা ও ভ্যান চালকরা। শীতের কারণে ব্যাহত হচ্ছে চলতি মৌসুমের আলু, সরিষা চাষাবাদ এবং রোপা-আমনের কাটা ও মাড়াই। হাসপাতালে বাড়ছে শীতজনিত রোগী। এদের মধ্যে শিশু ও বয়স্করাই বেশি।
দিনাজপুর :গত কয়েকদিনের শীতে কাবু এ অঞ্চলের মানুষ। শনিবার তাপমাত্রা আরও কমেছে। জেলায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১০ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যেটি শৈত্যপ্রবাহের খুব কাছাকাছি। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন খেটে খাওয়া নিম্ন আয়ের মানুষ।
দিনাজপুর আঞ্চলিক আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তোফাজ্জল হোসেন জানান, এদিন সকাল ৯টায় জেলার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১০ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস, বাতাসের আর্দ্রতা ৯৩ শতাংশ এবং গতিবেগ ঘণ্টায় এক কিলোমিটার।
তিনি আরও জানান, এদিন যে তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে তা শৈত্যপ্রবাহের কাছাকাছি। আবহাওয়ার ভাষায়, তাপমাত্রা ৮ থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে হলে সেটাকে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ, ৬ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে হলে সেটাকে মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ এবং ৪ থেকে ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে হলে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ বলে। আর যদি তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আরও নিচে নেমে যায়, তাহলে তাকে তীব্রতর শৈত্যপ্রবাহ বলা হয়।
সেই হিসাব অনুসারে, দিনাজপুরে তাপমাত্রা ১০-এর ঘরে অবস্থান করছে। আর কিছুটা কম হলেই এই জেলার ওপর দিয়ে বইবে শৈত্যপ্রবাহ। যদিও শনিবার দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে নওগাঁর বদলগাছিতে ১০ দশমিক শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াস।
এর আগে, শুক্রবার দিনাজপুর জেলায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ১১ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর ৪ ও ৫ ডিসেম্বর জেলার তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ১৪ দশমিক শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াস।
আবহাওয়া অফিসের দেয়া তথ্যমতে, ক্রমেই কমছে জেলার তাপমাত্রা। সেই সঙ্গে হিমেল হওয়ার ঝাপটা স্থানীয়দের জীবন আরও বিপর্যস্ত করে তুলেছে। খেটে খাওয়া ও নিম্নআয়ের মানুষের আয়-উপার্জনে ভাটা পড়েছে। কৃষকরাও রয়েছেন শঙ্কার মধ্যে।
শনিবার সকালে সদর উপজেলার নয়নপুর এলাকার কৃষক মাজেদুল ইসলাম জানান, শীতের মৌসুমটা কৃষকদের জন্য কষ্টকর। বোরো বীজতলার কাজ চলছে। এভাবে শীত এবং কুয়াশা হলে বীজ থেকে অঙ্কুরিতের হার কমে যায়। তা ছাড়া সকালে মাঠে এসে কাজ করাটাও কষ্টের।
দিনমজুর শরিফুল ইসলাম বলেন, 'সকালে কাজে আসতে বেশ কষ্ট হয়। রোদ না ওঠা পর্যন্ত আমরা কাজ করতে পারি না। আর বোরো বীজতলা পানি দেওয়া, টমেটো ক্ষেতে পানি দেওয়া, আলুক্ষেতে পানি দেওয়া অর্থাৎ এই সময়ে পানিতে হাত দেওয়া আরও বেশি কষ্টের।'
মির্জাপুর এলাকার ভ্যানচালক হাবিবুর রহমান বলেন, 'শীতের থেকে আরও বেশি কষ্টকর হলো হিমেল হাওয়া। যেদিন বাতাস বেশি হয় সেদিন আর কাজ করার অবস্থা থাকে না। যদি বাতাস হয়, তাহলে রোদ উঠলেও গরম লাগে না। এই শীত মৌসুমটা আসলেই আমাদের জন্য কষ্টের।'
আবহাওয়া কর্মকর্তা তোফাজ্জল হোসেন জানান, ধীরে ধীরে তাপমাত্রা কমে যাবে এবং ঘন কুয়াশার প্রাদুর্ভাব হবে। এই মাসেই শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাবে জেলার ওপর দিয়ে। এই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ কিংবা তৃতীয় সপ্তাহে শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
পঞ্চগড় :হিমালয়ের কোলঘেঁষে থাকা উত্তরের জনপদের জেলা পঞ্চগড়ে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মতো ঝরছে শিশির। কুয়াশার চাদরে মোড়ানো থাকছে চারিপাশ। ঘন কুয়াশায় শহরের সড়কগুলোতে হেডলাইট জ্বালিয়ে চলাচল করছে যানবাহন। একই চিত্র গ্রামের সড়কগুলোতেও। খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছেন অনেকেই।
তেঁতুলিয়া আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার অফিস জানায়, এদিন সকাল ৯টায় পঞ্চগড়ে তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১২ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ সময় বাতাসের আর্দ্রতা ছিল ১০০ শতাংশ। শুক্রবার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ১২ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জিতেন্দ্র নাথ বলেন, 'শুক্রবার থেকে কুয়াশার আবরণে ঢাকা পড়েছে উত্তরের এ জেলা। আজ কুয়াশাটা বেশি পড়েছে। তবে তাপমাত্রা ১২ ডিগ্রির মধ্যেই রেকর্ড হচ্ছে। সকাল ৯টায় তাপমাত্রা ১২ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড হয়েছে। গতকাল সকাল ৯টায় ১২ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছিল।'
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঘন কুয়াশার কারণে সড়কগুলোতে হেডলাইট জ্বালিয়ে গতি কমিয়ে চলাচল করছে দূরপালস্নার বাস ও মিনিবাস, সিএনজি, ইজিবাইক ও মোটর সাইকেলসহ বিভিন্ন যানবাহন। কুয়াশার সঙ্গে হিমেল বাতাসের কারণে প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হচ্ছেন না অনেকেই। তবে খেটে খাওয়া মানুষ জীবিকার তাগিদে সকালেই বেরিয়েছেন কাজে। সকালে কাজে যেতে দেরি হলে মহাজন কাজে নিতে চান না এমন অভিযোগ অনেক দিনমজুর ও পাথর শ্রমিকদের।
স্থানীয়রা বলছেন, খুবই ঠান্ডা পড়েছে। তার মধ্যে ঘন কুয়াশার কারণে অন্ধকারের মতো লাগছে। হাত-পা অবশ হয়ে আসছে ঠান্ডার কারণে। বিশেষ করে এ এলাকাটি বরফের পাহাড় হিমালয়-কাঞ্চনজঙ্ঘার কাছাকাছি হওয়ায় এখানে এ সময়ের প্রচন্ড শীতে কাঁপতে হয় আমাদের। রাতে গায়ে কাঁথা-কম্বল নিতে হচ্ছে। মনে হচ্ছে পৌষ মাসের ঠান্ডা শুরু হয়েছে।
তেঁতুলিয়ার মাগুরা গ্রামের শামসুল হক বলেন, 'আজ মনে হচ্ছে ঠান্ডাটা বেশি পড়েছে। রাতে প্রচন্ড ঠান্ডা লেগেছে। ভোরে দেখছি ঘন কুয়াশা। শিরশির করে ঝরছে শিশির।'
পাথরশ্রমিক কামাল-নাসির বলেন, 'কুয়াশার কারণে কাজে যেতে মন না চাইলেও যেতে হচ্ছে। প্রচন্ড ঠান্ডায় কাঁপলেও জীবিকার তাগিদে পরিবারের কথা চিন্তা করে কাজে বের হয়েছি। কাজ না করলে কী খাবো?'
ভ্যানচালকরা বলছেন, আজ ঠান্ডা বেশি। তার মধ্যে কুয়াশায় কিছু দেখা যাচ্ছে না। ঠান্ডার মধ্যে সহজে ভ্যানে কেউ চড়তে চান না। কিন্তু কী করবো এই ভ্যান চালিয়ে আমাদের চলতে হয়। এখন পর্যন্ত শীতের কাপড় কিনতে পারিনি। শীতের কারণে জ্বর-সর্দি, কাশিতেও ভুগছি।
স্কুলশিক্ষার্থী তরিকুল ইসলাম বলেন, 'শুক্রবারের চেয়ে আজকে কুয়াশা পড়েছে অনেক। ঠান্ডাও লাগছে বেশ। কোচিংয়ে বের হয়েছি। ঠান্ডা লাগছে।'
এদিকে, শীতের কারণে বেড়েছে শীতজনিত বিভিন্ন রোগব্যাধি। পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতাল ও অন্যান্য স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে বাড়ছে শীতজনিত রোগীদের ভিড়। শিশু ও বয়স্করা সর্দি, কাশি, নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন বলে জানা গেছে।
অন্যদিকে, আবহাওয়া অফিস বঙ্গোপসাগরের মধ্যাঞ্চলে একটি লঘুচাপ সৃষ্টি আভাস দিয়ে শনিবার সকালে জানায়, আজ (রোববার) সকাল ৯টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ সারাদেশের আবহাওয়া শুষ্ক থাকতে পারে। শেষরাত থেকে ভোর পর্যন্ত দেশের উত্তরাঞ্চলের কোথাও কোথাও মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা এবং দেশের অন্যত্র হালকা থেকে মাঝারি ধরনের কুয়াশা পড়তে পারে। সারাদেশে রাতের তাপমাত্রা সামান্য বৃদ্ধি পেতে পারে এবং দিনের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে।
সোমবার সকাল ৯টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ সারাদেশের আবহাওয়া প্রধানত শুষ্ক থাকতে পারে। শেষ রাত থেকে ভোর পর্যন্ত সারাদেশের কোথাও কোথাও হালকা থেকে মাঝারি ধরনের কুয়াশা পড়তে পারে। সারাদেশে রাতের তাপমাত্রা সামান্য বৃদ্ধি পেতে পারে এবং দিনের তাপমাত্রা সামান্য হ্রাস পেতে পারে। এছাড়া আগামী পাঁচদিনের মধ্যে রাত ও দিনের তাপমাত্রা হ্রাস পেতে পারে বলে জানায় সংস্থাটি।