মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে ডিএমপি কমিশনার

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিহতের ঘটনায় মামলা নিয়ে বাণিজ্য হচ্ছে

প্রকাশ | ১০ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
শেখ মো. সাজ্জাত আলী
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেছেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিহতের ঘটনায় মামলা নিয়ে বাণিজ্য হচ্ছে। রোববার বিকালে এমন ঘটনায় জড়িত অভিযোগে মোহাম্মদপুর অঞ্চলের এক পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সোমবার রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে ডিএমপি কমিশনার এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, ওইসব মামলায় আসামি হলেই গ্রেপ্তার কিংবা বাসায় বাসায় গিয়ে হয়রানি করা যাবে না। তদন্তে ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলেই কেবল আইনের আওতায় আনা যাবে। রাজধানীর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাকে 'অত্যন্ত বিশৃঙ্খল' মন্তব্য করে আইন না মানার প্রবণতা এবং রাস্তা ও ফুটপাত দখলকে এর কারণ হিসেবে উলেস্নখ করেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী। তিনি বলেন, ব্যাটারিচালিত রিকশার সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা না হলে সড়কে স্বাভাবিকভাবে নগরবাসীর চলাচলের সুযোগ 'অচিরেই কমে যাবে'। এ ছাড়া জুলাই-আগস্টের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে 'পেশাদারিত্বের বাইরে' গিয়ে পুলিশের ভূমিকার জন্য ক্ষমাও চেয়েছেন তিনি। ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে কমিশনার সাজ্জাত আলী বলেন, 'অত্যন্ত বিশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা। যারা রাস্তা ব্যবহার করেন, তারা ট্রাফিক আইন মানতে চান না। হকাররা ফুটপাত দখল করে রেখেছে, এখন বাইরে রাস্তাও দখল করে ব্যবহার করছে। এরূপ অবস্থায় ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত জটিল হয়ে পড়েছে।' ডিএমপির অনেক সমস্যার মধ্যে প্রধান সমস্যা ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাকে চিহ্নিত করা হয়েছে বলে জানান পুলিশ কমিশনার। নিয়ন্ত্রণহীন ব্যাটারিচালিত রিকশার সংখ্যা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, 'আদর্শ শহরে রাস্তা থাকা উচিৎ ২৫ ভাগ, সেখানে আমাদের রয়েছে সাত ভাগ। রাস্তায় মোটরাইজড ভেইকেলের পাশাপাশি, ম্যানুয়ালি অপেরেটেড রিকশা রয়েছে। ইদানীং ব্যাপকহারে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলছে। গত সরকারের সময় এই রিকশাকে অনুমতি দেওয়ার কারণে প্রতিদিন হু হু করে সেই সংখ্যা বাড়ছে। ব্যাটারিচালিত রিকশাকে রোধ করা না গেলে অচিরেই এরূপ একটি শহর হবে, যেখানে বাসা থেকে বের হলেই আর মুভমেন্টের সুযোগ থাকবে না। সড়কের সীমিত স্পেস অটোরিকশা দখল করে নিবে, মানুষের মুভমেন্ট একদম বন্ধ হয়ে যাবে। আমি এ বিষয়ে সরকারের সঙ্গে আলাপ করেছি, একটি ব্যবস্থাপনায় আনার জন্য অনুরোধ করেছি।' সাজ্জাত আলীর ভাষ্য, ডিএমপি ট্রাফিক সমস্যা সমাধানের যথেষ্ট মনোনিবেশ করেছে। এ জন্য আগে যে হারে ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনের জন্য মামলা করা হতো, এখন সেই 'দ্বিগুণ গতিতে হচ্ছে' বলে জানিয়েছেন তিনি। সবাইকে ট্রাফিক আইন মেনে চলার পাশপাশি, শহরের ভাড়াটিয়া নাগরিকদের তাদের সন্তানের স্কুল বা নিজেদের কর্মস্থলের কাছাকাছি বাসা নেওয়ার অনুরোধ করেছেন সাজ্জাত আলী। এক প্রশ্নে ঢাকার পুলিশপ্রধান বলেন, 'ট্রাফিকের বিষয়টি সামনে আনার কারণ হলো আপনারা নিত্যদিন এর শিকার হচ্ছেন। একজন মানুষের উত্তরা থেকে মতিঝিল যেতে তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা সময় লাগে, ফেরত যেতে আবার একই সময়। তাহলে তিনি কাজটা করবেন কখন, উনি'তো রাস্তাতেই থাকছেন। ট্রাফিক ঠিক হয়ে গেলে ৩৬ হাজার কোটি টাকা জিডিপিতে যোগ হতো। কী পরিমাণ অপচয় হচ্ছে আমাদের! বিদেশ থেকে মেহমান এসে কী দৃশ্য দেখছেন? তিনি কেন এখানে বিনিয়োগ করবেন? ট্রাফিক আমাদের ফোকাল পয়েন্টে, কারণ এটাই মিরর অব দ্য সিটি।' প্রায় দুই কোটি জনবসতির এই শহরে ঢাকায় 'সীমিত রিসোর্স' নিয়ে ডিএমপি সেবা দিয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে সাজ্জাত হোসেন। সরকার পতনের পরবর্তী পরস্থিতি তুলে ধরে তিনি বলেন, '৫ আগস্টের পর যখন পুলিশ অনেকটাই ইনএকটিভ হয়ে পড়ে তখন ঢাকায় সমানে ডাকাতি খুন, ছিনতাই, লুটপাট শুরু হয়ে যায়। রাতে বিভিন্ন মহলস্নায় অনেক মহিলাকেও লাঠি নিয়ে পাহারা দিতে দেখেছি, ৮০ বছরের বৃদ্ধকেও পাহারা দিতে দেখেছি। ঢাকা মহানগর পুলিশ সম্পূর্ণ ট্রমার মধ্যে পড়ে যায়। সবার অক্লান্ত পরাশ্রমে আমরা ওই অবস্থা থেকে উত্তরণ করতে পেরেছি।' ঢাকায় অহরহ ছিনতাইয়ের 'ঘটনা ঘটছে' স্বীকার করে তিনি বলেন, 'ছিনতাই প্রতিরোধ করতে ডিবি ও থানা পুলিশকে সক্রিয় করেছি, যাতে এটি রোধ করা সম্ভব হয়।' কাউকে চাঁদা না দেওয়ার অনুরোধ রেখে ডিএমপি কমিশনার বলেন, 'আপনারা চাঁদা দিবেন না, যারা চাঁদা নিতে আসে, তারা কী কওে, আমরা দেখতে চাই। আমরা সক্রিয় আছি, চাঁদাবাজির জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। শিগগিরই এ ক্ষেত্রে অনেকটা উন্নতি হয়ে গেছে। ডিবির বাইরে ক্রাইম নিয়ে কাজ করে আরও আটটি ইউনিট। তাদের অ্যাকটিভ করার জন্য বলেছি। ৫ আগস্টের পরের পরিস্থিতি'তো নেই। পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে।' ঢাকাবাসীর অভিযোগ জানতে আগামীতে 'কমপেস্নইন বক্স' স্থাপন এবং 'ওপেন ডে' আলোচনা শুরু হবে বলে জানান সাজ্জাত আলী। তিনি বলেন, 'আমি রেভিনিউ, ভ্যাট বা ট্যাক্স কালেক্টর নই। আমি সেবক, আমার কাজ ঢাকাবাসীকে সেবা দেওয়া। তেজগাঁও থানায় ৫০০ মামলা হোক, আমি জবাব দিব। জিডি হোক, ওসিদের বলেছি, কোনো ঘটনা যেন হাইড করা না হয়।' মামলা নিয়ে কালক্ষেপণ কমাতে নতুন একটি উদ্যোগ নিয়ে ডিএমপি কমিশনার বলেন, 'আরেকটি বিষয় আমি ১০-১৫ দিনের মধ্যে কার্যকর করতে চাই। জিডির ৪৮-৭২ ঘণ্টার পর পুলিশ সদস্যরা রেসপন্স করেন। আমি চাই, তারা যেন ১ থেকে ২ ঘণ্টার মধ্যেই যান। গিয়ে যদি মামলার মতো ঘটনা হয়, তাহলে ভুক্তভোগীকে থানায় নিয়ে এসে মামলা নিবে। এটার উদ্দেশ্য থানায় গিয়ে যে জিডি করলেন, সেটার রেসপন্স টাইম কমিয়ে আনতে চাই।' তিনি বলেছেন, এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে পুলিশের কিছু সদস্যকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। পুলিশের ছত্রছায়ায় মাদক বাণিজ্যের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, 'ওসির সঙ্গে ড্রাগ ডিলারের লিঁয়াজো রয়েছে- এমন একটা প্রমাণ নিয়ে আসেন। এরপর ওসির ভাগ্যে কী ঘটে, দেখেন না। আমি'তো আপনাদের সহযোগিতা চাই। মাদক নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নটা মাদক ডিপার্টমেন্টে করেন। এটা আমাদের মূল কাজ না, তাও আমরা করছি।' ক্ষমা চাইলেন ডিএমপি কমিশনার জুলাই-আগস্টের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে 'পেশাদারিত্বের বাইরে' গিয়ে পুলিশের ভূমিকার জন্য ক্ষমা চেয়েছেন সাজ্জাত আলী। তিনি বলেন, 'সে কাজের জন্য অত্যন্ত দুঃখিত। ঢাকা তথা দেশবাসীর কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।' এর আগে গত বৃহস্পতিবার ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যারা প্রাণ হারিয়েছেন, তাদের পরিবারের কাছে পুলিশের তরফ থেকে দুঃখ প্রকাশ করে ক্ষমা চেয়েছেন আইজিপি বাহারুল আলম। পুলিশ নতুনভাবে কাজ শুরু করেছে জানিয়ে সাজ্জাত আলী বলেন, 'ডিএমপির ওই সময়ের যেসব কর্মকর্তা অপেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ করেছে, অনেককে বদলি করা হয়েছে, অনেকের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আমরা নতুনভাবে কাজ শুরু করেছি, এ জন্য ঢাকাবাসীর সহযোগিতা একান্ত কাম্য।' ডিএমপি কমিশনার বলেন, 'গত ১৫ বছরে যে রিক্রুটমেন্ট হয়েছে, নানাভাবে তাদের ছেঁকে নেওয়া হয়েছে। সে কোন দলের লোক, তার বাবা কোন রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, তার দাদা বা পূর্বপুরুষের খবর নেওয়া হয়েছে। মোট প্রায় দুই লাখ পুলিশ হলে ৮০-৯০ হাজার এমনভাবে রিক্রুট হয়েছে। এখন তাদের'তো বলতে পারি না গো হোম।' আসন্ন বিজয় দিবস ও থার্টিফার্স্ট নাইটের নিরাপত্তার বিষয়ে জানতে চাইলে কমিশনার বলেন, 'আমরা সবগুলো নিয়েই কাজ করছি। ছোটখাট থ্রেট থাকলে'তো আর আমাদের উৎসব থামিয়ে দেওয়া যাবে না।' উৎসব উদ্‌যাপনে ডিএমপি পুলিশ যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন বলে জানিয়েছেন এই কমিশনার।