বিএনপি কেন ভোটের জন্য রাস্তায় নামার কথা বলছে

প্রকাশ | ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০

বিবিসি বাংলা
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সোমবার 'ভোট ও ভাতের অধিকারের জন্য পাঁচই আগস্টের মতো রাস্তায় নামতে হবে' বলে যে মন্তব্য করেছেন তা নিয়ে নানামুখী আলোচনা শুরু হয়েছে দলের ভেতরে ও বাইরে। বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে যে ধারণা পাওয়া গেছে তা হলো- নির্বাচন নিয়ে সুনির্দিষ্ট সময় ঘোষণার প্রতি সরকারের 'অনাগ্রহ' এবং পাশাপাশি সরকারের মধ্য থেকে সময়সীমা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের বক্তব্য আসায় দলের মধ্যে 'নির্বাচন বিলম্বিত করা হতে পারে' বলে এক ধরনের সংশয় তৈরি হয়েছে। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, মানুষ কখন ভোট দিয়ে তাদের নির্বাচিত সরকার ও সংসদ গঠন করতে পারবে- সেটি সরকার স্পষ্ট করেনি বলেই জনমনে এক ধরনের সংশয় তৈরি হয়েছে। আর বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য জহির উদ্দিন স্বপন বলছেন, 'কোনো কোনো মহল নির্বাচন বিলম্বিত করার চেষ্টা করছে বলেই বিএনপি বারবার সরকারকে সতর্ক করছে।' এদিকে, সরকারের একজন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ মঙ্গলবার সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, 'নির্বাচন নিয়ে অধৈর্য হওয়াটা সরকারের সংস্কার কার্যক্রমকে ব্যাহত করছে।' তিনি বলেন, 'সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নের পরই সরকার নির্বাচনের দিকে যাবে।' যদিও বিএনপি বারবারই নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি করে বলে আসছে যে, জরুরি সংস্কার ও নির্বাচনী প্রস্তুতি একসঙ্গেই চলতে পারে বলে দলটি মনে করে। প্রসঙ্গত, সরকারের সংস্কার কর্মসূচির জন্য সুপারিশ প্রণয়ন করতে ছয়টি কমিশন কাজ করছে। এসব কমিশন আগামী মাস অর্থাৎ জানুয়ারি নাগাদ তাদের রিপোর্ট দিতে পারে। এসব কমিশনের রিপোর্ট পাওয়ার পর প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে 'জাতীয় ঐকমত্য কমিশন' কাজ শুরু করবে এবং তারাই নির্বাচনের মতো জরুরি বিষয়গুলো নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিবে বলে প্রধান উপদেষ্টা জানিয়েছেন। বিএনপি মহাসচিব কী বলেছিলেন নিজ জেলা ঠাকুরগাঁওয়ে দলীয় এক জনসভায় সোমবার ভাষণ দেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ওই ভাষণের এক পর্যায়ে ভোট ও ভাতের অধিকারের জন্য আবার সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাস্তায় নামার আহ্বান জানান তিনি। এ সময় তিনি বলেন, 'আপনারা কি সত্যি পরিবর্তন চান নাকি আবার ওই আওয়ামী লীগের নৌকাতে ফিরে যেতে চান? তাহলে পাঁচই আগস্ট আপনারা যেমন রাস্তায় নেমেছিলেন, আবারও ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাস্তায় নামতে হবে।' সরকারের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, 'কিছু কিছু মানুষ এখন বিভিন্ন রকম কথা বলছেন। বিভিন্ন রকম কথা বলা বন্ধ করুন। বিশেষ করে দায়িত্বশীল জায়গায় থেকে ভুল কথা বা উত্তেজনামূলক কথা বলে দেশের মানুষকে আর বিভ্রান্ত করবেন না।' নির্বাচন নিয়ে সংশয় কেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া সর্বশেষ ভাষণে বলেছেন, ২০২৫ সালের শেষে বা ২০২৬ সালের শুরুতে আগামী জাতীয় নির্বাচন হতে পারে। এটিই ছিল সরকার প্রধানের দিক থেকে নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সীমা সম্পর্কে প্রথম কোনো আনুষ্ঠানিক মন্তব্য। কিন্তু, এর পরদিনই তার প্রেস সচিব এক সংবাদ সম্মেলনে ২০২৬ সালের ৩০শে জুনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে মানুষ আশা করতে পারে- এমন মন্তব্য করলে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বিএনপি। এর একদিন পরেই বিএনপি মহাসচিব নির্বাচন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ও তার প্রেস সচিবের বক্তব্যকে সাংঘর্ষিক উলেস্নখ করে উষ্মা প্রকাশ করেন। তখনি তিনি বলেছিলেন, 'নির্বাচনকেন্দ্রিক সংস্কারগুলো সম্পন্ন করে দ্রম্নত নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব। জনগণ এই বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার কাছে সুস্পষ্ট বক্তব্য প্রত্যাশা করে।' যদিও সরকার ইতোমধ্যেই নির্বাচন কমিশন গঠন করেছে এবং কমিশন ভোটার তালিকা হালনাগাদের কাজ শুরু করেছে। কিন্তু দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা মনে করেন, এর পরেও নির্বাচন নিয়ে 'রাস্তায় নামার আহ্বান' আসার মূল কারণ হলো, সরকার সংশ্লিষ্ট কিছু মহল থেকে নির্বাচন নিয়ে নানা ধরনের মন্তব্য আসা। বিশেষ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং তাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র জাতীয় নাগরিক কমিটি থেকে নির্বাচনের চেয়ে সংস্কার কার্যক্রমে জোর দেওয়া এবং বিএনপির সমালোচনা করে করা নানা ধরনের মন্তব্য থেকে দলটির অনেকে আশঙ্কা করছেন যে, এগুলো 'নির্বাচনকে বিলম্বিত করার প্রেক্ষাপট' তৈরির একটি প্রচেষ্টার অংশ হতে পারে। বিএনপি জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ বলেন, সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ না দিয়ে নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন ধরনের বক্তব্য আসছে বলেই জনমনে বিভ্রান্তি কিংবা অস্পষ্টতা তৈরি হয়েছে। তিনি আরও বলেন, 'মানুষ কখন ভোট দিয়ে তাদের পছন্দনীয় সরকার গঠন করতে পারবে সেটা স্পষ্ট করা দরকার দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার স্বার্থে। সরকার অন্য যাই বলুক, এই ভোটের সময়টা না পাওয়াতেই জনমনে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। বিএনপি সেটিই তুলে ধরছে। তাছাড়া, তিনি মনে করেন দেশের নানা সংকটের পাশাপাশি বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে দেশ-বিদেশে যেসব 'অপতৎপরতা' চলছে সেগুলোও সরকার সামাল দিতে পারছে না। তিনি আরও বলেন, 'নানা ধরনের প্রচারণা দেখছি আমরা বাংলাদেশকে নিয়ে। নির্বাচিত সরকার ছাড়া এমন পরিস্থিতি মোকাবিলা করা কঠিন। অথচ সেদিকে মনোযোগ না দিয়ে বিএনপি ও নির্বাচন নিয়ে নানা ধরনের মন্তব্য আসছে সরকার ও সরকার ঘনিষ্ঠ মহলগুলো থেকে। এজন্যই বিএনপি জনগণের ভোটের অধিকার চাইছে ও এ নিয়ে কথা বলছে। অন্যদিকে, দলটির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য জহির উদ্দিন স্বপন বলেছেন, কোনো কোনো মহল নির্বাচনকে বিলম্বিত করার চেষ্টা করছে এবং বিষয়টি নিয়ে বিএনপির দিক থেকে আগেও সতর্ক করা হয়েছে। তিনি বলেন, 'আমরা সরকারকে সহযোগিতা করছি। কিন্তু নির্বাচনের তো বিকল্প কিছু নেই। কোনো কোনো মহল হয়তো ভিন্ন চিন্তা করছে। তেমনটি হলো জনগণের ভোটের অধিকার আদায়ের জন্য তো রাজনৈতিক কর্মসূচিই দিতে হবে। আমাদের মহাসচিব দলের পক্ষে সেই বার্তাই দিয়েছেন।' অর্থাৎ দলটির নেতাদের কথায় এটি অনেকটাই পরিষ্কার যে, 'ভোট ও ভাতের অধিকারের জন্য রাস্তায় নামার' কথা বলে মূলত বিএনপি মহাসচিব সরকারকে এমন বার্তাই দিতে চেয়েছেন যে, নির্বাচন বিলম্বিত করার চেষ্টা হলে সেটি বিএনপি গ্রহণ করবে না। নির্বাচন নিয়ে অধৈর্য মঙ্গলবার সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, নির্বাচনের সময়টা নির্ভর করবে সংস্কার কার্যক্রমের ওপর। 'সংস্কার কমিশনগুলো দ্রম্নত রিপোর্ট দেওয়ার পর দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সরকার সংস্কার বাস্তবায়নের দিকে যাবে। সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নের পর আমরা নির্বাচনের দিকে যাব। নির্বাচন কমিশন তা নিয়ে কাজ করছে। উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বলেন, নির্বাচন নিয়ে অধৈর্য হয়ে যাওয়ায় সংস্কার কার্যক্রম কিছুটা ব্যাহত করছে। সেখানে এক ধরনের বাধার সৃষ্টি করছে। আশা করব, দলগুলো সংস্কার কার্যক্রমে তাদের মতামত দিয়ে সহযোগিতা করুক। তাদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতেই সংস্কার সম্পন্ন হবে। বিএনপির শঙ্কা কি যৌক্তিক? রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন বলেন, নির্বাচন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা মোটামুটি একটি সময়ের কথা বললেও 'সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণায় যে সরকারের প্রবল অনীহা- তা কিন্তু দৃশ্যমান'। তিনি বলেন, 'প্রধান উপদেষ্টা একদিকে একটি সময় বলেছেন, আবার অন্যদিকে বলেছেন তার নেতৃত্বে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এসব বিষয় চূড়ান্ত করবে। আবার উপদেষ্টারা কেউ কেউ বলছেন, সংস্কারের পর নির্বাচন। ফলে নির্বাচনের তারিখ বলার ক্ষেত্রে একটি অনিশ্চয়তা তো জনমনে আছে। সে কারণেই বিএনপির মধ্যেও শঙ্কা তৈরি হয়েছে এবং এ পরিস্থিতিতে সেটাই স্বাভাবিক।' অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীনের মতে, অনেক দিন ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি বিশ্বাস করে, যত দ্রম্নত নির্বাচন হবে তত তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার পথ তৈরি হবে। তিনি বলেন, 'কিন্তু বিলম্বিত হলে আবার রাজনৈতিক সংকট তৈরি হতে পারে। কোন সংস্কার কত দিনে হবে কিংবা কতটা হবে তারও তো নিশ্চয়তা নেই। এসব কারণেই দলটির মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।'