ফায়ার ফাইটার নয়ন নিহত চাপা দেওয়া ট্রাকচালক ও সহকারী আটক

প্রকাশ | ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
সোয়ানুর জামান নয়ন
প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে বুধবার মধ্যরাতে লাগা আগুন নেভানোর কাজে নিয়োজিত ফায়ার ফাইটার সোয়ানুর জামান নয়ন পানির লাইন দিতে রাস্তা পার হওয়ার সময় ট্রাক চাপায় গুরুতর আহত হন। পরে তাকে ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। বৃহস্পতিবার সকাল পৌনে ৭টার দিকে সচিবালয়ের সামনে ব্রিফিংয়ে এসে নয়নের মৃতু্যর খবর দেন ফায়ার সার্ভিসের ডিজি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ জাহেদ কামাল। এদিকে, সচিবালয়ের সামনে ফায়ার ফাইটার নয়নকে চাপা দেওয়া ট্রাকচালক বেলাল হোসেন সুমন ও তার সহকারী ফরহাদকে ধরে পুলিশে দিয়েছে জনতা। বুধবার গভীর রাতে দ্রম্নতগতির ট্রাকটি নয়নকে চাপা দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় গণপূর্ত অধিদপ্তর এলাকা থেকে জনতা তাদের আটক করে বলে জানিয়েছেন শাহবাগ থানার ওসি মোহাম্মদ খালিদ মনসুর। তিনি জানান, ৩৫ বছর বয়সী ট্রাকচালক সুমন ও ২০ বছর বয়সী ফরহাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা তালহা বিন জসিম জানান, সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনে আগুন লাগার খবর বুধবার রাত ১টা ৫২ মিনিটে পান তারা। দুই মিনিটের মধ্যে তাদের কর্মীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে কাজ শুরু করেন। প্রথমে আটটি ইউনিট কাজ শুরু করলেও পরে আরো ১১টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণের কাজে যোগ দেয়। ফায়ার সার্ভিসের ১৯টি ইউনিটের চেষ্টায় সকাল ৮টা ৫ মিনিটে সেই আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। আগুন নেভানোর কাজে নিয়োজিত ফায়ার ফাইটার নয়ন পানির লাইন দিতে রাস্তা পার হওয়ার সময় ট্রাক চাপায় গুরুতর আহত হন। পরে তাকে ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। বৃহস্পতিবার সকাল পৌনে ৭টার দিকে সচিবালয়ের সামনে ব্রিফিংয়ে ফায়ার সার্ভিসের ডিজি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ জাহেদ কামাল বলেন, 'আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর তার মৃতু্য হয়।' প্রত্যক্ষদর্শী জানান, নয়নকে চাপা দিয়ে ট্রাকটি দ্রম্নত গতিতে পালিয়ে কিছুদূর চলে গেলে উপস্থিত শিক্ষার্থী ও জনতা ব্যারিকেড দিয়ে ট্রাকটি আটকান। পরে চালক ও সহকারীকে আটক করে অগ্নিকান্ডের ঘটনাস্থলে উপস্থিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দিলে তাদেরকে হেফাজতে নেয় শাহবাগ থানা পুলিশ। ঢাকা মেডিকেল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক মো. ফারুক বলেন, 'রাত ৩টা ৪০ মিনিটে ফায়ার সার্ভিস কর্মী নয়নকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। ময়নাতদন্তের জন্য তার মরদেহ হাসপাতাল মর্গে রাখা হয়েছে।' নয়নকে হাসপাতালে নেওয়া তার সহকর্মী শফিকুল ইসলাম বলেন, 'সচিবালয়ে সামনের রাস্তায় গাড়ি রাখার পর পানির পাইপ কাঁধে নিয়ে রাস্তা পার হওয়ার সময় একটি ট্রাক তাকে ধাক্কা দেয়। ধাক্কায় নয়ন পড়ে গেলে ট্রাকের পেছনের চাকা তার মাথার উপর দিয়ে চলে যায়।' ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, নয়নের কর্মস্থল সিলেটের বিশ্বনাথ ফায়ার স্টেশন হলেও তিনি তেজগাঁও ফায়ার স্টেশনে দায়িত্বরত ছিলেন। ফায়ার ফাইটার সোয়ানুর জামান নয়ন ২০২২ সালে ৬১তম ব্যাচে যোগ দিয়েছিলেন অগ্নি নির্বাপক বাহিনীতে। তিনি রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার আটপনিয়া গ্রামের আক্তারুজ্জামানের ছেলে। ২৪ বছর বয়সী নয়ন ছিলেন দুই ভাইবোনের মধ্যে ছোট। চোখের জলে বীরকে বিদায় এদিকে, ফায়ার ফাইটার সোয়ানুর জামান নয়ন (২৪) ছিলেন একজন নির্ভীক ও দক্ষ কর্মী। নির্ভীক ও দক্ষ কর্মীর সুবাদে তাকে সম্প্রতি সিলেট থেকে নিয়ে আসা হয় ঢাকার তেজগাঁও ফায়ার স্টেশনে। কর্ম দক্ষতার কারণে দুই বছর চাকরি জীবনে স্থান করে নিয়েছেন ফায়ার সার্ভিস 'স্পেশাল টিমে'। সর্বশেষ বুধবার দিনগত রাতে দেশের প্রশাসনিক প্রাণ কেন্দ্র সচিবালয়ের আগুন নিয়ন্ত্রণের কাজ করতে গিয়ে ট্রাকচাপায় নিহত হন নয়ন। তার এই অকাল মৃতু্য মেনে নিতে পারছেন না তার পরিবার থেকে শুরু করে সহকর্মীরা। বৃহস্পতিবার নিহত ফায়ার ফাইটার নয়নের জানাজা অনুষ্ঠিত হয় ফায়ার সার্ভিসের সদরদপ্তর প্রাঙ্গণে। এসময় ফায়ার সার্ভিস সদরদপ্তর প্রাঙ্গণে ছিল শোকের ছায়া। দেশের পতাকায় মোড়ানো ফায়ার ফাইটার নয়নের মরদেহ যখন ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তর প্রাঙ্গণে রাখা হয় তখন নেমে আসে শোকের ছায়া। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা থেকে শুরু করে ফায়ার সার্ভিসের মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের চোখ তখন অশ্রুশিক্ত। জানাজার আগে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ফায়ার সার্ভিসে সদর দপ্তরে উপস্থিত হয়ে ফায়ার ফাইটার নয়নকে শ্রদ্ধা ও শেষ বিদায় জানান। এরপর ফায়ার সার্ভিসের সদরদপ্তরে জানাজায় অংশ নিতে আসা নয়নের চাচাতো ভাই মোহাম্মদ রাকিবুল ইসলাম বলেন, আমার ভাই এভাবে চলে গেল যে আর ফিরে আসবে না কখনো। তার সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল আমার, কিন্তু আর শেষ দেখা হলো না। তার এই অকাল মৃতু্য আমরা মেনে নিতে পারছি না। তিনি বলেন, ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা যখন কাজ করছিল তখন পুলিশ যদি রাস্তা বন্ধ করে দিত তাহলে আমার ভাইকে এভাবে মরতে হতো না। আমরা আশা করবো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পরবর্তী সময়ে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিবে যাতে করে নয়নের মতো যেন আর কারও মৃতু্য না হয়। জানাজা শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, বুধবার আমাদের ফায়ার ফাইটার নয়ন দুর্ঘটনায় মারা যান। আমরা সবাই তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। নয়নের বয়স খুবই কম ছিল। তিনি মাত্র দুই বছর ধরে ফায়ার সার্ভিসে চাকরি করছিলেন। কর্তব্যরত অবস্থায় তিনি মারা যান, তার মা-বাবার যে কি অবস্থা সেটা আমরা সবাই বুঝতে পারছি। তিনি বলেন, তিনি খুবই দক্ষ ফায়ার ফাইটার ছিলেন। তাই তাকে স্পেশাল টিমের জন্য ঢাকায় নিয়ে আসা হয়েছিল। বাবা-মায়ের একমাত্র অবলম্বন ছিলেন নয়ন এদিকে, সচিবালয়ে আগুন নেভানোর কাজে গিয়ে ট্রাকচাপায় নিহত ফায়ার ফাইটার সোহানুর জামান নয়ন ছিলেন পরিবারের একমাত্র অবলম্বন। কৃষক বাবা আক্তারুজ্জামানের সব ভরসা ছিল তাকে ঘিরেই। অনেক স্বপ্ন ছিল ছেলের চাকরি দিয়ে অনাগত দিনগুলো সুখে শান্তিতে কাটাবেন। কিন্তু সেই আশা পূরণ হওয়ার আগেই ঘাতক ট্রাক কেড়ে নিলো সব। রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার বড়বালা ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডের ছড়ান আটকুনিয়া গ্রামের আক্তারুজ্জামান ও নার্গিস দম্পতির একমাত্র ছেলে সোহানুর জামান নয়ন। এক বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে ছোট নয়ন। বড় বোনের বিয়ে হয়েছে। স্থানীয় ইউপি সদস্য জিয়াউল হক জুয়েল জানান, নয়নের পরিবার নদীভাঙনের শিকার। নিজস্ব জমিজমা বলতে তেমন কিছু নেই। অনেক কষ্টে একমাত্র ছেলেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত লেখাপড়া করিয়েছেন। ২০২২ সালে তার চাকরি হয়। ছেলের চাকরিতে পরিবারে একটু সচ্ছলতা ফিরতে শুরু করেছিল। কিন্তু সেই সুখ বেশিদিন টিকলো না। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে এখন পরিবারটি দিশাহারা। ছেলেকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ বাবা আক্তারুজ্জামান। শুধু বলেন, 'বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ অনেক ভারী। আমার অনেক স্বপ্ন ছিল তাকে ঘিরে। সবকিছু শেষ হয়ে গেলো।' ইউপি চেয়ারম্যান তারিকুল ইসলাম সরকার বলেন, নয়নের পরিবার অনেক গরিব। এভাবে অকালে তার চলে যাওয়াটা কষ্টের। সরকারিভাবে ওই পরিবারের জন্য কিছু একটা করার জন্য জোর দাবি জানাই।