গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিভিন্ন গার্মেন্টস কারখানায় হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও শ্রমিক অসন্তোষে দেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক শিল্পে যে চরম অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছিল তা পুরোপুরিই কেটে গেছে। ওই সময় উদ্বিগ্ন বিদেশি ক্রেতারা ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ রপ্তানি আদেশ অন্য দেশে দিয়ে দিলেও তারা এখন ফিরতে শুরু করেছেন। ফলে ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জসহ সারাদেশের গার্মেন্টস কারখানাগুলো পুরোদমে সচল হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টারস অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) এর ৮ জানুয়ারির দেওয়া তথ্যানুসারে, রাজধানীসহ সারাদেশে শতকরা ৯৯.৭১ শতাংশ গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠান খোলা রয়েছে। সারাদেশের সর্বমোট ২ হাজার ৯৭টি সক্রিয় কারখানার মধ্যে ২ হাজার ৯১টি কার্যক্রম চলছে। কারখানা খোলা রাখার পর কাজ বন্ধ, স্ব-বেতনে ছুটি বা শ্রমিকরা চলে গেছে মাত্র ৬টির।
বিজিএমইএ সূত্র জানায়, নভেম্বর মাসে ২ হাজার ৯১টি গার্মেন্টস বেতন (৯৯ দশমিক ৭১ শতাংশ) পরিশোধ করেছে। নভেম্বর মাসের বেতন দেয়নি ৬টি গার্মেন্টস (দশমিক ২৯ শতাংশ)। এরমধ্যে ঢাকার ৫টি এবং চট্টগ্রামের একটি গার্মেন্টস রয়েছে। তবে দেশের কোনো গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠানের অক্টোবর মাসের বেতন বকেয়া নেই।
গাজীপুর এবং ময়মনসিংহ এলাকায় ৮৩৪টি কারখানা খোলা এবং ৫টি কারখানা বন্ধ রয়েছে। এ হিসেবে খোলা গার্মেন্টেসের হার ৯৯.৪০ শতাংশ এবং বন্ধের হার দশমিক ৬০ শতাংশ। সাভার-আশুলিয়া এবং জিরানী এলাকার মোট ৪২৪টি গার্মেন্টেসের মধ্যে বন্ধ রয়েছে একটি কারখানা। এছাড়া নারায়ণগঞ্জ এলাকার ১৮৮টি, ডিএমপি এলাকার ৩২০টি এবং চট্টগ্রাম এলাকার ৩২২টি গার্মেন্টেসের সবগুলোই চালু রয়েছে।
রাজধানীসহ সারাদেশের ২ হাজার ৯৩টি কারখানার মধ্যে গাজীপুর ও ময়মনসিংহ এলাকায় ৮৭০টি সাভার আশুলিয়া ও জিরানিয়া এলাকায় ৪০১টি নারায়ণগঞ্জ এলাকায় ১৮৯টি ডিএমপি এলাকায় ৩০০টি এবং চট্টগ্রাম এলাকায় ৩২৯টি গার্মেন্টসের সবগুলো খোলা রয়েছে।
এদিকে বেক্সিমকো গ্রম্নপের গার্মেন্টস ডিভিশন লে-অফ ঘোষণা করা হয়েছে। রেডিয়াল ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড ও কেএসি নীট কম্পোজিট লিমিটেডের শ্রমিক স্ব-বেতনে ছুটি এবং উত্তরা নীটওয়্যার লিমিটেড বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে কাজ বন্ধ করে বসে আছে। এছাড়া কোনাপাড়া এলাকার কমফিট কম্পোজিট নীটওয়্যার (ইউ-৩) অর্জিত ছুটির পুরো বছরের টাকা, নাইট বিল, টিফিন বিল বৃদ্ধির দাবিতে শ্রমিকরা কাজ না করে যার যার মতো চলে গেছে।
শিল্প মালিক এবং খাত সংশ্লিষ্ট বলছেন, ৫ আগস্টের পর গত কয়েক মাস পোশাক শিল্পে যে অস্থিরতা সৃষ্টি করা হয়েছিল তার জন্য মজুরি বা শ্রমিক সংক্রান্ত ইসু্য ছিল কম। তবে একটি পক্ষের ইন্ধনেই শ্রমিকদের উসকে দেওয়ার পাশাপাশি নানা অপকৌশলে দেশের পোশাক শিল্প খাতকে অস্থির করে রাখা হয়েছিল। এর মধ্যে পতিত সরকারের দোসরদের ইন্ধন বেশি ছিল।
বিজিএমইএর সাবেক এক সভাপতি নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ প্রতিবেদককে বলেন, 'পোশাক শিল্প নিয়ে অতীতে অনেক সময় অনেক ধরনের ষড়যন্ত্র হয়েছে। দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাতটি যাতে অন্য দেশে চলে যায় সে চেষ্টাও হয়েছে অনেকবার। কারণ ষড়যন্ত্রকারীরা ভালোভাবেই জানেন গার্মেন্টস খাতকে ধংস করতে পারলেই বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ধসিয়ে দেওয়া যাবে। একইরকমভাবে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরও পোশাক খাত নিয়ে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল। গত কয়েক মাস গার্মেন্টস শিল্পমালিকরা চরম উদ্বেগের মধ্যে দিন কাটিয়েছেন। তবে অন্তর্বর্তী সরকার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিশেষ করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শক্ত ও কৌশলী পদক্ষেপে পোশাক শিল্পের অস্থিরতা দ্রম্নত দূর হয়েছে। তবে ষড়যন্ত্রকারীরা এখনও ওঁত পেতে আছেন, যে কোনো সময় তারা আবারও মাথাচাড়া দিতে পারেন। তাই প্রশাসনসহ সবাইকে এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকা জরুরি বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।'
বিজিএমইএর প্রশাসক ও ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান মো. আনোয়ার হোসেন এ বিষয়ে বলেন, 'গত ৫ আগস্টের পর থেকে দেশের তৈরি পোশাক শিল্পে যে অস্থিরতা চলে আসছিল, তা এখন একেবারেই কমে এসেছে। অস্থিরতা নেই বললেই চলে। মাঝে-মধ্যে একটি দুটি কারখানায় বেতন সংক্রান্ত ইসু্যতে শ্রমিকরা রাস্তায় নামছে- সেগুলোর সমাধান করা হচ্ছে দ্রম্নত সময়ের মধ্যে। এখন গার্মেন্টস শিল্পে যে স্থিতিশীলতা চলে এসেছে- তার বড় প্রমাণ হলো সব শিল্প এলাকার গার্মেন্টস কারখানা এখন খোলা, পুরোদমে কাজ চলছে। শিল্প মালিক, শ্রমিক এবং আমাদের বিদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর মাঝেও স্বস্তি ফিরে এসেছে।'
তিনি আরও বলেন, 'আসলে ওয়েজ বা লেবার ইসু্যতে খুব বেশি শ্রমিক অসন্তোষ হয়নি বিগত কয়েক মাসে। দুই-একটি কারখানায় হয়ত কিছুটা সমস্যা ছিল। সেগুলো সরকার এবং শিল্পমালিকরা সবাই মিলে সমাধান করেছে। যেমন জেনারেশন নেক্সট এবং বেক্সিমকোর মতো কারখানায় মজুরি সংক্রান্ত ইসু্য থাকলেও অন্য শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এ-সংক্রান্ত কোনো ইসু্য ছিল না। সরকার, মালিক এবং শ্রমিক প্রতিনিধির মতামতের ভিত্তিতে ১৮টি দাবি বা প্রস্তাব মেনে নেওয়া হয়েছে। এর অনেকগুলোই বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। অথচ অনেক কারখানায় এই ১৮টি পয়েন্টের বাইরে গিয়ে মিড লেবেল ম্যানেজমেন্ট থেকে লোক বাদ দেওয়াসহ নানারকম অন্যায্য দাবি তুলে শিল্পে অস্থিরতা করা হয়েছে। ওই সময় আলোচনারও কোনো সুযোগ দেওয়া হয়নি।'
যদিও পোশাক শ্রমিক সংগঠনের নেতারা অনেকেই ভিন্নমত পোষণ করেছেন। তাদের ভাষ্য, পোশাক খাতে অস্থিরতার একাধিক কারণ ছিল। এর মধ্যে ঝুট ব্যবসা নিয়ে দ্বন্দ্ব, মালিকানার সমস্যা, বকেয়া পাওনা, কিছু ক্ষেত্রে বহিরাগতদের উসকানি এবং শ্রমিকদের নতুন কিছু দাবি দাওয়া এর পেছনে কাজ করেছে।
আশুলিয়া এলাকায় শ্রমিক সংগঠনের একজন নেতা মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, 'আগের সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ কিছু ব্যবসায়ী এবং রাজনৈতিক নেতাদের ফ্যাক্টরিতে যেমন সমস্যা হয়েছে, তেমনি পাঁচই আগস্টের পর সুযোগ পেয়ে শ্রমিকরাও নানা দাবি নিয়ে মাঠে নেমেছিল। এ আন্দোলনটা শুরু হয় নারী-পুরুষ সমহারে চাকরির দাবিতে। এছাড়া আরও বেশকিছু কারখানায় ভিন্ন ইসু্যতে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়।'
বাংলাদেশ ন্যাশনাল লেবার ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মরিয়ম আক্তার মনে করেন, শ্রমিক অসন্তোষ সৃষ্টির নেপথ্যে বহিরাগত একটা প্রভাব কাজ করেছে। তার ভাষ্য, ঝুট ব্যবসা নিয়ে সমস্যা আগেও ছিল। তবে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর একটি গোষ্ঠী নানামুখী ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের জন্য সক্রিয় হয়ে ওঠায় বেশি অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। 'ওই গোষ্ঠী চায় বাংলাদেশ থেকে বিদেশি বায়ারদের অর্ডার অন্য কোনো দেশ চলে যাক'- যোগ করেন মরিয়ম আক্তার।
এদিকে পোশাক শিল্প মালিকরা জানান, এ খাতের জন্য ২০২৪ সাল সংকটপূর্ণ থাকলেও পরিস্থিতির দ্রম্নত উন্নতি হচ্ছে। বিশেষ করে ৫ আগস্টের পর জ্বালানি ও ডলার সংকট, সরবরাহ ব্যবস্থায় বাধা, শ্রমিকদের বেতন বাড়ানোর দাবি, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং ঢিলেঢালা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কারণে যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল এবং এর ফলে প্রচুর অর্ডার ভিন্ন দেশে চলে যাচ্ছিল- সে সংকট কেটে গেছে। তাই নতুন বছরে তারা আশার আলো দেখছেন।
সংশ্লিষ্টদের দাবি, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো বড় বাজারে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। জুলাই থেকে নভেম্বরে পোশাক রপ্তানি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৬ দশমিক ২৫ শতাংশ বেড়ে এক হাজার ৬১১ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে।
জানা গেছে, বিদায়ী বছরে রপ্তানি তথ্য সংশোধন করা হয়। আগে ভুল গণনার কারণে রপ্তানি আয় অতিরঞ্জিত ছিল। চূড়ান্ত হিসাব অনুসারে, ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে পোশাক খাতের আয় হয়েছে ৩৬ বিলিয়ন ডলার। রপ্তানি উন্নয়ন বু্যরো (ইপিবি) হিসাব করেছিল ৪৭ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, 'বিদায়ী বছরটি সংকটপূর্ণ ছিল। তবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার সঙ্গে কার্যাদেশ ফিরে আসায় ব্যবসা পুনরুদ্ধারের বছর এটি।'
তিনি আরও বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউতে খুচরা বিক্রি বেড়ে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো এখন কার্যাদেশ নিয়ে ফিরে আসছে।'