নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারে কী থাকছে?

প্রতিবেদনে সংসদে আসন বাড়ানো, নূ্যনতম ভোটার ছাড়া নির্বাচন বাতিল, জাতীয় পরিচয়পত্রের সেবা ইসির অধীনে রাখাসহ বেশ কিছু সুপারিশ থাকার আভাস

প্রকাশ | ১৪ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
তিন দিনের মধ্যেই প্রতিবেদন জমা দিতে যাচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, যেখানে সংসদে আসন বাড়ানো, নূ্যনতম ভোটার ছাড়া নির্বাচন বাতিল, জাতীয় পরিচয়পত্রের সেবা ইসির অধীনে রাখা, দুই কক্ষের পার্লামেন্ট ও সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা প্রণয়নসহ বেশ কিছু সুপারিশ থাকার আভাস মিলেছে। কমিটির সদস্যরা বলেছেন, তাদের এসব সুপারিশ স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদে বাস্তবায়নের কথা বলা হবে। আর বেশিরভাগ সুপারিশই অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না বলে পর্যবেক্ষকদের ধারণা। অবশ্য নির্বাহী আদেশে কিছু সুপারিশ বাস্তবায়ন সম্ভব। আর সংস্কারের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর 'উদারতা' জরুরি বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। দায়িত্ব নেওয়ার পর রাষ্ট্র সংস্কারে একের পর এক কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারে কমিশন হয় গত ৩ অক্টোবর। 'সুশাসনের জন্য নাগরিক'-এর (সুজন) সাধারণ সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার এ কমিশনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। কমিটি সরকারের কাছে প্রতিবেদন দেওয়ার প্রস্তুতি গুছিয়ে এনেছে। বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, ১৫ জানুয়ারি তারা প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন দেবেন। যেমন সুপারিশ থাকতে পারে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য আব্দুল আলীম বলেন, কমিশনের সদস্যরা মিলে বৈঠক করেছেন অর্ধশতাধিক। অংশীজনদের সঙ্গে অন্তত ২৫টি এবং চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, রংপুর ও সিলেটে বিভাগীয় মতবিনিময় সভা হয়েছে। ওয়েবসাইট, সোশাল মিডিয়া, সরাসরি ও মেইলে মতামত এসেছে। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারে জনমত জরিপও হয়েছে। তিনি আরও বলেন, 'প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর বিষয়টি সরকার দেখবে। আমাদের কাজ সুপারিশ করা।' আব্দুল আলীম বলেন, আইনের পাশাপাশি নির্বাচনী আচরণবিধিতেও স্পষ্ট পরিবর্তন এনে কঠোর তদারকির সুপারিশ থাকার সম্ভাবনা রয়েছে প্রতিবেদনে। এতে অধ্যায় থাকবে অন্তত এক ডজন। তিনি আরও বলেন, 'আদালতের রায়ে গণভোট ও তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ফেরার পথ তো খুলছে। বিদ্যমান নির্বাচন পদ্ধতির পাশাপাশি সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি সুপারিশের কথাও ভাবছি আমরা। দুই কক্ষের পার্লামেন্টের কথাও বিবেচনায় রয়েছে।' একাধিক দিনে সংসদ নির্বাচনের সুপারিশ থাকছে না জানিয়ে তিনি বলেন, 'বিষয়টি আমরা রাখিনি। কারণ দেশের বাস্তবতায় ব্যালট বাক্সগুলো কোথায় রাখব? বিশ্বাসে ঘাটতির একটা ব্যাপারও রয়েছে।' নির্বাচনী ব্যবস্থার সার্বিক সংস্কারে সংবিধান ও নির্বাচনী আইনের সংশোধনেরও দরকার পড়বে। এ বিষয়ে আব্দুল আলীম বলেন, 'আমরা তাদের সঙ্গে (সংবিধান সংস্কার কমিশন) কথা বলেছি। ফরমাল আলোচনা করেছি, সংবিধান সংশোধনের বিষয়গুলো তুলে ধরেছি। সংবিধানের ৪৮ (৩) অনুচ্ছেদ, ইসি নিয়োগে রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নেওয়া- নির্বাচন কমিশন গঠনের ক্ষেত্রে আমরা এগুলো বাদ দিতে বলেছি।' তিনি বলেন, 'ইসির পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ থাকবে নির্বাচনী প্রশাসনের ওপর। ফলে নির্বাচনটা প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তির ওপর দাঁড়াবে।' সিইসি ও ইসি নিয়োগের বিষয়ে আইনের একটা খসড়াও দেবে এ কমিশন। আব্দুল আলীম বলেন, 'আমরা একটা খসড়া আইন করেছি। যেমন- রাজনৈতিক সমঝোতা প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশগ্রহণ থাকতে হবে। যোগ্য লোক যেন আসতে পারে, তার সুযোগ থাকতে হবে। বর্তমান আইনে তো তা নেই; এজন্য সব কিছু অ্যাড্রেস করে খসড়া করছি।' কমিশনের এই সদস্য বলেন, 'সংসদে আসন সংখ্যা বাড়ানো ও নারীদের সরাসরি নির্বাচনের বিষয়ে সুপারিশের ভাবনা রয়েছে আমাদের। প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোটাধিকার কীভাবে ও কতটা বাস্তবায়ন করা যায়, সে বিষয়েও সুপারিশ থাকবে প্রতিবেদনে।' সংসদ নির্বাচনে ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় একক প্রার্থীদের জয়ী হওয়ার নজির রয়েছে। স্থানীয় সরকারের অনেক নির্বাচনেও এমনটা ঘটেছে। সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনে ৮৭ শতাংশ ভোট পড়ার রেকর্ড রয়েছে। আবার ২৫ থেকে ৪২ শতাংশ ভোটার উপস্থিতিও রয়েছে তিনটি নির্বাচনে (ষষ্ঠ, দশম ও দ্বাদশ)। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ভোটের প্রবণতা রোধে ভোটার উপস্থিতির একটা সীমারেখা টেনে দিতে চায় নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন। আব্দুল আলীম বলেন, 'আমরা একটা নির্দিষ্ট শতাংশে রাখছি; যেটা ছাড়া ভোট (কোনো নির্বাচনী আসনের) বাতিলের সুপারিশ থাকবে আমাদের।' নূ্যনতম কত শতাংশ রাখা হবে, তা জানাননি কমিশনের এই সদস্য। তিনি বলেন, '৫০ শতাংশের নিচে একটা কিছু হবে।' রাজনৈতিক দল নিবন্ধন পেলেও পাঁচ বছর পর 'রিভিউ' করার সুপারিশ থাকবে বলে জানান আব্দুল আলীম। তিনি বলেন, 'প্রত্যেক দলের নেতাকর্মীর তথ্য নিয়ে ডেটাবেইজ থাকতে হবে; এটা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে। তিন বছর দলের সঙ্গে না থাকলে তাকে দলীয় নমিনেশন না দেওয়ার সুপারিশও রাখা হতে পারে।' বর্তমান ইসির জন্য অগ্রাধিকারভিত্তিতে দ্রম্নত ভোটার তালিকা প্রণয়ন ও এনআইডি সেবা ইসির অধীনে আনার সুপারিশ করবে সংস্কার কমিশন। 'বাস্তবায়নই চ্যালেঞ্জ' অধিকার ও উন্নয়নকর্মী খুশী কবির বলেন, 'অন্তর্বর্তী সরকারের সংবিধান পরিবর্তনের সুযোগ না থাকায় তারা সংস্কারের সুপারিশগুলো নির্বাচিত সরকারের জন্য রেখে যাবে। তবে আইন করতে না পারলেও কিছু সুপারিশ নির্বাহী আদেশে বাস্তবায়ন সম্ভব।' খুশী কবিরের পর্যবেক্ষণ হলো, 'বর্তমান সরকারের সঙ্গে যেসব রাজনৈতিক দল আছে, তাদের অনেকে সুপারিশগুলো গ্রহণ নাও করতে পারে। কারণ দলগুলো নানা দাবি করছে এবং বলছে, 'এটা হচ্ছে না কেন, সেটা হচ্ছে না কেন'।' নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ হলে এবং সরকারের 'পছন্দের' কেউ কমিশনে না থাকলে ভালো নির্বাচন হতে পারে মন্তব্য করে খুশী কবির বলেন, 'যারা ক্ষমতায় আছেন, তাদের দ্বারা কমিশন প্রভাবিত হবে কিনা, দেখার বিষয়। কারণ অতীতের সব নির্বাচনে কমিশনের নিয়োগদাতাদের মাধ্যমে ভোট প্রভাবিত হয়েছে।' তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হওয়া নির্বাচনগুলোতেও কেন্দ্র দখল কিংবা প্রতিপক্ষের পোলিং এজেন্টকে বের করে দেওয়ার মত ঘটনার কথাও তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, 'এগুলো সরকার করায়নি, কিন্তু যার এলাকায় ক্ষমতা আছে, সে অর্থ ও পেশিশক্তি প্রয়োগ করেছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের ওই ইচ্ছা বা শক্তি ছিল না। কেননা তারা তো নির্ভর করছিল মাঠ পর্যায়ের নির্বাচনী কর্মকর্তাদের ওপর।' সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন, নির্বাচন কমিশন থেকে প্রত্যেক দলকে নূ্যনতম ৩৩ শতাংশ নারী প্রার্থী রাখতে বাধ্য করা, সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী থেকে প্রার্থী রাখার বিধান থাকলে নির্বাচনব্যবস্থা আরও ভালো হবে বলে মনে করেন তিনি। খুশী কবির বলেন, 'সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন হলে ভুয়া ভোট দেওয়ার বিষয়টা কমে যায়। সরাসরি ভোট হলে আগের মতই চলব আমরা। বর্তমানে তো একই অবস্থা দেখছি। আমরা কোনো সমালোচনা-প্রতিবাদ করতে পারব না, তাদের মতের সঙ্গে অমিল থাকলে ভয় থাকবে, বের করে দেওয়ার কথা বলা হবে। জবাবদিহিতা না থাকলে উন্নয়ন হবে না, অংশীদারত্বও থাকবে না।' অন্তর্বর্তী সরকারের পাঁচ মাসেও দেশের পরিস্থিতি 'স্বাভাবিক' হয়নি মন্তব্য করে খুশী কবির বলেন, 'যে যা পারছে, তারা কিন্তু অনেক জায়গায় অনেক ধরনের বেআইনি কাজ করছে। মারামারি চলছে; স্কুল-কলেজে সারাক্ষণ আন্দোলন চলছে : এই দাবি, সেই দাবি। এগুলো সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না; নির্বাচন ব্যবস্থাপনা কীভাবে করবে?' 'দলগুলো উদার না হলে বাস্তবায়ন কঠিন' সাবেক সচিব একেএম আবদুল আউয়াল মনে করেন, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারের সুপারিশ বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলোর মনোভাব গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, 'তাদের মানসিকতার যদি পরিবর্তন না হয়, তারা যদি উদার না হয়, তাহলে সেগুলো বাস্তবায়ন কঠিন। এই সরকার সংবিধানের রূপরেখা দিয়ে যেতে পারে, কিন্তু তারা তো কাজ করে যেতে পারবে না। কারণ সংসদ ছাড়া সেটা হবে না। পরবর্তী সরকার এগুলো বাস্তবায়ন করবে কি না, সেটা এখন বলা যাচ্ছে না।'