তীব্র গ্যাস সংকট চলছে শিল্প খাতে। উৎপাদন চালিয়ে যেতে অনেক কারখানা ডিজেল ও সিএনজি কিনতে বাধ্য হচ্ছে। এতে উৎপাদন ব্যয় বেশখানিকটা বাড়ছে। বিকল্প জ্বালানি দিয়ে কোনোরকমে উৎপাদন চালু রাখলেও সময়মতো অর্ডারের পণ্য সরবরাহ করতে পারছেন না অনেক শিল্পমালিক। এরইমধ্যে শিল্পে গ্যাসের দাম নতুন করে ১৫২ শতাংশ পর্যন্ত বা আড়াই গুণ বাড়ানোর উদ্যোগ 'মড়ার উপর খাড়ার ঘা' হয়ে দেখা দিয়েছে।
তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, গ্যাসের অভাবে উৎপাদন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় অনেক কারখানার মালিক ঠিকমতো বেতন দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। ইতিমধ্যে গাজীপুর ও আশুলিয়ার কিছু কিছু কারখানায় বেতনের দাবিতে শ্রমিকেরা বিক্ষোভ করেছেন। নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ মনে করে, যেকোনো মুহূর্তে বড় ধরনের শ্রমিক অসন্তোষ দানা বাঁধা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। সম্প্রতি বিদু্যৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ে লেখা চিঠিতে সংগঠনটি বলেছে, গ্যাসের চাপ না থাকায় বাইরে থেকে গ্যাস কিনতে কারখানাভেদে দৈনিক ৩-১৫ লাখ টাকা অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে।
অন্যদিকে বিজিএমইএ-র আশঙ্কা, চলমান গ্যাস-সংকট দেশের সার্বিক রপ্তানি আয়কে সংকটে ফেলবে। এ ব্যাপারে বিজিএমইএ-র নেতাদের ভাষ্য, গ্যাস-সংকটে অধিকাংশ শিল্পকারখানা ভুগছে। এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জে সংকটের মাত্রা বেশি। গ্যাসের বেশি দাম দিয়েও শিল্পকারখানাগুলো এখন নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস পাচ্ছে না। গ্যাস-সংকট তাড়াতাড়ি সুরাহা করা না হলে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক সংকটে পড়ার শঙ্কা রয়েছে।
শিল্পমালিকরা জানান, দীর্ঘদিন ধরে শিল্প-বাণিজ্যে শনির দশা চলছে। এ খাতের পরিস্থিতি দিনে দিনে কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠছে। ডলার সংকট, আমদানি কড়াকড়ি, সুদের উচ্চহার, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, হামলা-মামলার রেশ কাটতে না কাটতেই শিল্পে নতুন করে গ্যাসের দাম বাড়ানোর ধাক্কা তারা কতটা সামাল দিয়ে উঠতে পারবে তা নিয়ে তারা সংশয়ে রয়েছে।
শিল্পোদ্যোক্তাদের শঙ্কা, গ্যাস দাম বাড়ানোর উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা হলে বাংলাদেশে আর কোনো শিল্পকারখানা গড়ে উঠবে না। গ্যাসের আড়াই গুণ মূল্যবৃদ্ধি হলে টিকবে না শিল্পখাত। এর মাধ্যমে শিল্পের ভবিষ্যৎ শেষ হয়ে যাবে। শিল্পে নতুন বিনিয়োগ আসবে না, কর্মসংস্থান হবে না। বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও নিরুৎসাহী হবেন। বড় ধরনের প্রভাব পড়বে রপ্তানিশিল্পে। এতে শিল্পের প্রসারের স্থলে বরং শিল্প সংকুচিত হবে।
জানা যায়, গ্যাসের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ভারী শিল্প। আর এসব শিল্পে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ থাকে। শিল্পটির ক্ষতি হলে, ঋণখেলাপি হওয়ার পাশাপাশি বিপুল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান ব্যাহত হবে। অনেকে চাকরি হারাবেন। এরই মধ্যে বহু শিল্প বন্ধ হয়ে গেছে। বিপুলসংখ্যক মানুষ চাকরি হারিয়েছেন। নতুন করে শিল্পের ওপর চাপ এলে, দেশের শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিদেশে ভুল বার্তা যাবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা অন্য গন্তব্যে চলে যাবেন। ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেন, এসব কর্মকান্ড রীতিমতো শিল্প ধ্বংসের লক্ষণ। এর পেছনে কোনো চক্রের ষড়যন্ত্রও থাকতে পারে। এ ধরনের কোনো অপচেষ্টা থাকলে সরকারে উচিত যেকোনো মূল্যে তা থামানো।
বিইআরসি সূত্র জানায়, এরই মধ্যে গ্যাসের নতুন দরের নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে জ্বালানি বিভাগ। প্রস্তাবটি এখন বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) রয়েছে। প্রস্তাব অনুসারে নতুন কারখানার জন্য গ্যাসের দাম হবে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) আমদানি ব্যয়ের সমান। ফলে নতুন কারখানাগুলোকে বর্তমান দরের চেয়ে আড়াই গুণ বেশি দামে গ্যাস কিনতে হবে। পুরনো শিল্পকারখানায় লোড বাড়াতে চাইলেও গুনতে হবে আড়াই গুণ মূল্য।
বর্তমানে শিল্পকারখানার গ্রাহকদের প্রতি ঘনমিটার গ্যাস কিনতে ৩০ টাকা এবং ক্যাপটিভ পাওয়ারে (শিল্পে ব্যবহৃত নিজস্ব বিদু্যৎ) ৩০ টাকা ৭৫ পয়সা দিতে হয়। সম্প্রতি বিইআরসিতে পেট্রোবাংলার পাঠানো প্রস্তাবে প্রতি ঘনমিটারে গ্যাসের দাম বাড়িয়ে ৭৫ টাকা ৭২ পয়সা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে নতুন সংযোগের ক্ষেত্রে পুরো গ্যাস বিল হবে নতুন দামে। পুরনোদের ক্ষেত্রে কিছুটা ছাড় থাকছে প্রস্তাবে।
উদ্যোক্তারা বলছেন, নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের কথা বলে দুই বছর আগে শিল্পের গ্যাসের দাম ১৫০ থেকে ১৭৮ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত শিল্পে গ্যাস সংকট কাটেনি; বরং গ্যাস সংকটে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এই সংকটের মধ্যে গ্যাসের দাম আড়াই গুণ বাড়ানো হলে শিল্পে বিনিয়োগ পুরো বন্ধ হয়ে যাবে।
বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমইএ) সভাপতি ও মুন্নু সিরামিকস ইন্ডাস্ট্রিজের ভাইস চেয়ারম্যান মইনুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে গ্যাস সংকটে শিল্পখাত অনেকটাই থমকে আছে। এই অবস্থায় গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির চিন্তা কেমনে আসে তা বোধগম্য নয়। সিরামিক খাতের প্রধান জ্বালানিই হলো গ্যাস। গ্যাসের স্বল্পচাপের কারণে সক্ষমতার অর্ধেকও উৎপাদন করা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় শিল্পখাত যাতে টিকতে না পারে, সেই চিন্তা করেই গ্যাসের মূল্য আড়াই গুণ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এটি দেশের স্বার্থের বিপক্ষের সিদ্ধান্ত হচ্ছে। যদি মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি বাস্তবায়ন করা হয়, তাহলে এই খাতের ভবিষ্যৎ শেষ হয়ে যাবে।
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী বলেন, সরকারের এসব সিদ্ধান্ত দেখে মনে হচ্ছে, উদ্যোক্তারা উৎপাদন থেকে সার্ভিস সেক্টরে চলে যাবে। ম্যানুফ্যাকচারিং খাত বাংলাদেশে থাকুক এই সরকার সেটি চাচ্ছে না। এই দেশে যেহেতু বিপুল পরিমাণ জনসংখ্যা, তাই ম্যানুফ্যাকচারিং খাত ছাড়া বিকল্প চিন্তা করাটাই দেশের অর্থনীতির জন্য ভুল সিদ্ধান্ত।
এদিকে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, গ্যাসের দাম বাড়লেও তা হয়তো পুষিয়ে নেওয়া যাবে, যদি পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়। চাহিদার তুলনায় অনেক কম গ্যাস সরবরাহ দেওয়া হচ্ছে। এতে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। বিকল্প ব্যবস্থায় শিল্পকারখানা চালু রাখতে গিয়ে উৎপাদন খরচ বেশখানিকটা বাড়ছে।
এদিকে গ্যাসের দাম বাড়ালেও এর সরবরাহ বাড়াবে এমন সম্ভাবনা দেখছেন না জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। তাই বিকল্প শক্তি ব্যবহার করে কারখানার সক্ষমতা অনুযায়ী উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে হলে আগামীতে উৎপাদন খরচ বাড়বে তা ধরেই নিতে হবে। সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন ক্রমে কমছে। এটা শিগগিরই খুব বেশি বাড়ানোর সুযোগ নেই। এলএনজি থেকে সর্বোচ্চ আমদানির সক্ষমতা ১১০০ মিলিয়ন ঘনফুট। নতুন এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ না হলে আমদানি আর বাড়ানো যাবে না। আগামী দুই বছরেও নতুন টার্মিনাল চালুর তেমন সম্ভাবনা নেই। টার্মিনাল নির্মাণে কোনো চুক্তি হয়নি। আওয়ামী লীগ আমলে হওয়া একটি চুক্তি বাতিল করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। সবমিলিয়ে সহসাই এ খাতে আশার আলো দেখার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
সিপিডির গবেষণা পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, গ্যাসের যে উচ্চমূল্য ধরা হচ্ছে, ব্যবসায়ীরা যদি এই মূল্যে টাকা দেনও, তাও জ্বালানির নিশ্চয়তা দেওয়া এই সরকারের পক্ষে সম্ভব না। কারণ ব্যবসায়ীরা বিল দেবেন টাকায়, সরকারকে জ্বালানি আমদানি করতে হবে ডলারে। সরকারের কাছে ডলারের সংকট রয়েছে।
তিনি বলেন, এই মুহূর্তে জ্বালানির ক্ষেত্রে সর্বাধিক প্রাধান্য দেওয়া উচিত। এখন যে গ্যাস সংকট পরিস্থিতি রয়েছে, অভ্যন্তরীণ গ্যাস উৎপাদনে সরকারের প্রবল উদ্যোগ না থাকলে জ্বালানি সংকট ব্যবসায়ীদের ভোগাবে। একদিকে তারা গ্যাসের উচ্চমূল্য দেবেন কিন্তু জ্বালানির সরবরাহ কম থাকবে। প্রকারান্তরে সেটা পরিস্থিতিটিকে আরো জটিল করবে।
শিল্পমালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গ্যাস সংকটের কারণে এর মধ্যে অনেক কারখানা গ্যাসের বিকল্প হিসেবে ব্যয়বহুল তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) এবং কয়লা ব্যবহার করছে। এতে তাদের উৎপাদন ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। ফলে দেশের বাজারে উৎপাদিত পণ্যের চাহিদা কিছুটা কমেছে। রপ্তানিযোগ্য পণ্য আন্তর্জাতিক বাজার প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হিমশিম খাচ্ছে।
দেশের সবচেয়ে বড় গ্যাস বিতরণকারী প্রতিষ্ঠান তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন ডিভিশন) প্রকৌশলী কাজী মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম বলেন, তিতাসের বিতরণ এলাকায় বর্তমানে গ্যাসের চাহিদা দৈনিক ২ হাজার ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে সরবরাহ করা হচ্ছে দৈনিক ১ হাজার ৫৫০ থেকে ১ হাজার ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ওয়েবসাইটে দেওয়া সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী গত ৯ জানুয়ারি জিটিসিএল থেকে ১ হাজার ৩৫০ মিলিয়ন ঘনফুট এবং নিজস্ব পাইপলাইন থেকে ১৮৪ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া গেছে। এ হিসেবে ওইদিন ১ হাজার ৫শ' ৩৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, সাভার-আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে প্রায় দেড় হাজারের মতো ছোট-বড় শিল্প-কারখানা। এসব কারখানার জেনারেটর বা বয়লার চালাতে ১৫ পিএসআই (প্রতি বর্গইঞ্চিতে গ্যাসের চাপের ইউনিট) চাপের গ্যাস প্রয়োজন, কিন্তু বর্তমানে তা অর্ধেকের নিচে। কারখানা মালিকরা বলছেন, এই চাপ সংকটের কারণে বিকল্প জ্বালানিতে চলছে কারখানাগুলোর উৎপাদন কার্যক্রম। এতে তাদের পণ্য উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে অনেক।
সাভারের পাকিজা গ্রম্নপের অ্যাডমিন ম্যানেজার মো. মোস্তাকিম বলেন, কারখানায় গ্যাস সংকটে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। পর্যাপ্ত গ্যাসের অভাবে বিকল্প হিসেবে ডিজেল ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে উৎপাদন চালু রাখা গেলেও তা ব্যয়বহুল।
বিভিন্ন শিল্প-কারখানার কর্মকর্তাদের অভিযোগ, গ্যাস সংকটে সাভার-আশুলিয়ার শিল্পাঞ্চল প্রায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। কারখানাগুলোতে আগে ঘণ্টায় যে উৎপাদন হতো, এখন তা অর্ধেকে নেমে এসেছে। ফলে সময়মতো পণ্য শিপমেন্ট করা যাচ্ছে না।