উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাব
মধ্যম আয়ে নিম্নবিত্তের জীবন
মধ্যবিত্তরা দারিদ্র্যসীমায় নেমে এসেছে। বিশেষ করে বর্তমান পরিস্থিতিতে মধ্যবিত্ত শ্রেণি বেশি পেরেশানিতে পড়েছে
প্রকাশ | ১৮ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
সাখাওয়াত হোসেন
টাকার অংকে ৪০-৪৫ হাজার কম নয়। অথচ মধ্য আয়ের এ টাকাতেও সচ্ছলভাবে সংসার চালানো দুস্কর হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে যেসব পরিবারে স্কুল-কলেজগামী সন্তান রয়েছে কিংবা পরিবারের সদস্য সংখ্যা চার-পাঁচের অধিক তাদের 'নুন আনতে পান্তা' ফুরোচ্ছে। নিম্নবিত্তের সংসারের মতো সারা মাস টানাটানি লেগেই থাকছে।
উচ্চ মূল্যস্ফীতির বাজারের বাড়তি খরচ যোগাতে মধ্যম আয়ের মানুষ এখন বিকল্প আয়ের সন্ধানে মরিয়া হয়ে উঠলেও দেশে কর্মসংস্থানের সংকট থাকায় 'পার্টটাইম জব' যোগাড় করাও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ পরিস্থিতিতে মধ্যবিত্তরা এখন বাসস্থানসহ সব ধরনের মৌলিক চাহিদার বাজেট কাঁটছাঁট করে সংসার চালানোর চেষ্টা করছে।
তবে জীবনযাত্রার মান নিম্নমুখী রেখেও সামনে আর কত দিন চলা যাবে তা নিয়ে মধ্যম আয়ের মানুষের মধ্যে নতুন করে দুঃশ্চিন্তা দেখা দিয়েছে। তাদের ভাষ্য, নতুন করে শতাধিক পণ্য ও সেবায় বাড়তি ভ্যাট যুক্ত হওয়ার পর জিনিসপত্রের দাম আরও বাড়ছে। এছাড়া প্রতিবছর রমজান শুরুর এক-দুইমাস আগেই সিন্ডিকেটের কারসাজিতে নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে দেওয়ার ধারা এবারও অব্যাহত রয়েছে। ফলে বাজার ক্রমান্বয়ে আরও তেতে উঠছে। এতে মধ্য আয়ের জীবনযাত্রার মান তলানি এসে ঠেকার আশঙ্কা রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে কনজু্যমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, রমজানে পণ্যমূল্য নিয়ে আশঙ্কা রয়েছে। এরই মধ্যে অনেক পণ্যের দাম বেড়েছে। যদিও সরকার থেকে বলা হচ্ছে, ভ্যাট আরোপের ফলে দাম বাড়বে না। কিন্তু দাম ঠিকই বেড়েছে। প্রতিবছর রমজান ঘিরে পণ্যের দাম বাড়ে। এবারও সেই আশঙ্কা রয়ে গেছে। সম্পূরক শুল্ক ও ভ্যাট বৃদ্ধিতে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য না থাকলেও জনজীবনে গুরুত্বপূর্ণ পণ্য রয়েছে। এতে জনজীবনে প্রভাব পড়বে। এ ছাড়া ৫ আগস্টের পর অনেক করপোরেট গ্রম্নপ বাজারে নেই। তাদের শূন্যস্থান পূরণেও কোনো উদ্যোগ নেই। অন্যদিকে আমদানির ক্ষেত্রে অনেক টেকনিক্যাল বিষয় রয়ে গেছে। সেগুলোর ব্যাপারেও দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেই।
বিশ্লেষকরা বলছেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কবলে পড়ে ধনীদের একটি অংশ মধ্যবিত্তের কাতারে এবং মধ্যবিত্তরা দারিদ্র্যসীমায় নেমে এসেছে। বিশেষ করে বর্তমান পরিস্থিতিতে মধ্যবিত্ত শ্রেণি বেশি পেরেশানিতে পড়েছে। তাদের যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। নিম্নশ্রেণি বা দরিদ্র মানুষদের জন্য সরকার সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় (পরিমাণে পর্যাপ্ত না হলেও) বিভিন্ন সময় ভর্তুকি মূল্যে খাবার সরবরাহ করে থাকে। মধ্যবিত্ত শ্রেণি লোকলজ্জার কারণে রাস্তায় সেই লাইনেও দাঁড়াতে পারছে না। বাজারে নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্যের কারণে তাদের চাহিদায় কাঁটছাঁট করতে হচ্ছে।
দেশে চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাব সম্পর্কে অর্থনীতিবিদরা বলেন, মূল্যস্ফীতি সবসময় নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের অনুকূলে থাকা দরকার। কারণ আয়ের বিকল্প কোনো মাধ্যম বা সঞ্চয় না থাকায় নির্ধারিত আয় দিয়ে তাদের চলতে হয়। অন্যদিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়ে যাদের সম্পদ থাকে বা স্টক থাকে, তাদের সম্পদ রাতারাতি দ্বিগুণ হয়ে যায়। ফলে তারা আরও ধনী হয়ে যায়। উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়ে তারা সবসময় লাভবান হয়। দেশে এখন সেটিই চলমান। অসুবিধায় পড়ে যারা ভোক্তা বা ক্রেতা। এভাবে চলতে গেলে আয় বৈষম্য আরও অনেক বেড়ে যাবে। অনেক মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমার কাছাকাছি চলে যাবে। সুতরাং সামাজিক ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে হলে মূল্যস্ফীতি ৪ থেকে ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা জরুরি। সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, মধ্যবিত্তদের থেকে (ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে) আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে। কারণ তাদের হাতে সঞ্চয় কম। বর্তমানে তাদের জীবিকা নির্বাহ করতেই ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। কাজেই তাদের নতুন সঞ্চয় করাটা কঠিন। সেজন্য নতুন সঞ্চয় কমে যাচ্ছে। মধ্যবিত্তের সঞ্চয় এখন নিম্নবিত্তের সঞ্চয়ের পর্যায়ে এসে ঠেকেছে।
সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, যে প্রক্রিয়ায় আমাদের দেশে বর্তমানে মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে উঠেছে, সেটিই সমস্যাপূর্ণ। পাকিস্তান আমলে দেশে মূলত মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে উঠেছে গ্রামের কৃষিভিত্তিক পরিবার থেকে আসা শিক্ষিতদের মাধ্যমে। কারণ তারা জানতেন, ব্যবসা করে তারা মধ্যবিত্তে যেতে পারবেন না। ভালো করে পড়াশোনা করার মধ্য দিয়েই কেবল তা সম্ভব। যে কারণে ওই মধ্যবিত্তের মধ্যে একটা বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনা কাজ করেছে। এটি সে অর্থে একটি গুণগত বর্গ, শুধু আর্থিক বর্গ নয়। বাংলাদেশ পর্বে তা দেখা যায়নি। শিক্ষার মান কমে যাওয়া এবং জনতুষ্টিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কারণে মধ্যবিত্তের বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গাটা খর্ব হয়েছে। এছাড়া তখনকার মধ্যবিত্তরা এখনকার মতো ভঙ্গুর ছিল না। কোনো দুর্যোগ এলেই তাদের অবস্থান নিচে নেমে যেত না। এখনকার পেশাজীবী, মধ্যবিত্তের পুঁজি হলো আর্থিক, বুদ্ধিবৃত্তিক নয়। বিভিন্ন আর্থিক দুর্যোগের সঙ্গে তাদের অবস্থান পরিবর্তিত হয়। নদীতে নাক বরাবর পানিতে দাঁড়িয়ে থাকলে হালকা ঢেউয়ে যেমন তলিয়ে যেতে পারে, তেমনি উচ্চ মূল্যস্ফীতি বা এ ধরনের যে কোনো সংকটে মধ্যবিত্তের জীবনযাত্রার মান নিম্নবিত্তে নেমে যাওয়ার মতো কঠিন বাস্তবতা তৈরি হয়েছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ বলেন, 'মধ্যবিত্ত কারা- এ নিয়েও বিতর্ক আছে। মধ্যবিত্তের মধ্যে আবার ভাগ আছে- উচ্চ মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত। মধ্যবিত্তের একটা ছোট অংশ বিভিন্ন অর্থনৈতিক তৎপরতার মধ্য দিয়ে উচ্চ মধ্যবিত্তে পৌঁছে গেছে। আমরা যদি ওই অংশটাকে গোনায় ধরি, যাদের সীমিত আয় এবং পেশাজীবী- দেখা যাবে, এই অংশটার মধ্যে একটা ভাঙন এসেছে।
মূল্যস্ফীতির কারণে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের প্রকৃত আয় কমে গেছে। তাদের একটা বড় অংশ কোনো সুযোগ গ্রহণ করতে না পেরে নিম্ন মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্তে নেমে গেছে। করোনার আগেও যে তাদের আয় খুব নিশ্চিত ছিল এমন নয়। আমাদের দেশে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বেতন দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে কম, পৃথিবীর অন্যতম কম। গত ১০-১৫ বছরে চাহিদার মধ্যেও কিছু পরিবর্তন এসেছে। যেমন কম্পিউটার-ল্যাপটপ একটা সময়ে বিলাসিতা ধরা হতো, এখন তা জরুরি খরচ। এসব চাহিদার সঙ্গে আছে গণপরিবহনের খরচ বৃদ্ধি। আমাদের দেশে দুধ, ডিম, সবজির যে দাম; যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে তা আমাদের এখানে আয়ের পরিপ্রেক্ষিতে কয়েক গুণ বেশি। মধ্যবিত্তের একটা বড় অংশই থাকে ভাড়া বাড়িতে। আর এই বাড়ি ভাড়া বেড়েছে ব্যাপক পরিমাণে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দু'টি প্রধান খরচ- শিক্ষা ব্যয় ও চিকিৎসা ব্যয়। মধ্যবিত্তকে প্রতিনিয়ত অতিরিক্ত খরচ সামলাতে গিয়ে একটা বিকল্প খরচের পথ সন্ধান করতে হচ্ছে। পরিবারের একাধিক সদস্য শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে। তবে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে একাধিক সদস্যের আয়েও সচ্ছলভাবে সংসার চালানো কষ্ট হচ্ছে।
বিভিন্ন পেশার মধ্যম আয়ের মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নানা সংকটে জীবনযাত্রার মান কয়েক ধাপ নামিয়ে আনার পরও তাদের সবসময় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে থাকতে হচ্ছে। সবসময় ভবিষ্যৎ নিয়ে, সন্তানদের নিয়ে চিন্তা করাটা এখন মধ্যবিত্তের বাস্তবতা। এর ফলে মধ্যবিত্তরা এখন অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। অতিরিক্ত কাজ ও পুষ্টিহীনতার কারণে মানসিক চাপ বাড়ছে। এতে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ফুসফুস, কিডনির রোগ বা ক্যানসারে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর রামপুরা বাজারে কথা হয় রাফি এন্টারপ্রাইজ নামের একটি ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্ট ম্যানেজার শহীদুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি জানান, স্ত্রী-সন্তানসহ ৫ সদস্যের পরিবার নিয়ে থাকেন মহানগর প্রজেক্টে। পাঁচ বছর আগে যে বেতন ছিল, এখনো সেই একই বেতন পাচ্ছেন। দিন দিন খরচ বাড়লেও বাড়েনি কোনো আয়। খরচ বাড়ায় বাসার একটি রুম তিনি এখন সাবলেট দিয়েছেন। মাসে যে বেতন পান, তার অর্ধেক চলে যায় ঘরভাড়ায়। বাকি অর্ধেক গ্যাস, বিদু্যৎ বিল, বাচ্চাদের স্কুলের বেতন দিয়ে বাজার থেকে যে ভালো খাবার কিনবেন তার কোনো উপায় থাকে না। সব মিলিয়ে মাসের শেষ সপ্তাহে হতাশা বেড়ে যায়।
একই বাজারে কথা হয় ব্রয়লার মুরগি কিনতে আসা বনশ্রী এলাকার শিক্ষিকা জেসমিন আক্তারের সঙ্গে। তিনি বলেন, 'আগে স্বামীর আয় দিয়ে মোটামুটি পরিবার চালানো যেত। এখন ওই আয়ে কোনোভাবে সংসার চালানো সম্ভব হচ্ছে না। তাই একটি প্রাইভেট স্কুলে খন্ডকালীন শিক্ষকতা করছি। কিন্তু দু'জনের আয়েও এখন আগের মতো মধ্যম মানের জীবনযাপন করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এ শিক্ষক আরও বলেন, 'মাসের বাজার চাল, ডাল, মরিচ কেনার পর, সাপ্তাহিক কাঁচাবাজার করতে রামপুরা বাজারে আসি। মাছ ও গরুর মাংস দূরের কথা, এখন ব্রয়লার মুরগিও আমাদের মতো মধ্য আয়ের মানুষদের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে।'
মালিবাগ বাজারে মাংসের দোকানে কথা হয়, আতিকুর রহমান নামে এক এনজিও কর্মকর্তার সঙ্গে। তিনি জানান, হাজার চলিস্নশেক টাকা বেতন পেলেও ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খরচ ও বাড়িভাড়াসহ সংসারের অন্যান্য খরচ মেটাতে নাভিশ্বাস উঠছে। স্ত্রীকে ছেলেমেয়েদের স্কুলে আনা-নেওয়াসহ সাংসারিক বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। কোনো চাকরি করতে পারে না। তবে অনলাইনে কিছু ব্যবসা শুরু করেছে। সেখান থেকে অল্পকিছু আয় হয়। দু'জনের বেতন দিয়েই কোনোমতে নিম্নবিত্তের মতো সংসার চালাতে হচ্ছে।
এ কর্মকর্তা আরও বলেন, নিত্যপণ্যের বাজার দিন দিন যেভাবে চড়ছে, যেভাবে বাসাভাড়া ও সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ বাড়ছে তাতে আগামী দিনে সংসার চালানো আরও কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। নিম্নবিত্তের মতো জীবনযাপন করতে হলেও ঋণ করতে হবে।
সম্প্রতি ৫০ হাজার টাকা উপার্জনকারী একটি পরিবারের খরচের হিসাব দিয়ে দেখিয়েছে- বাসাভাড়া, পানি-গ্যাস-বিদু্যৎ-ইন্টারনেট ও ডিশ বিল, গৃহকর্মীর বেতন, সন্তানের পড়ালেখা, ওষুধ, অফিস যাতায়াতের পেছনে যা খরচ হয়, তার পর ৬ সদস্যের একটি পরিবারে পুরো মাসের বাজারের জন্য ১৫ হাজার টাকাও অবশিষ্ট থাকে না। কিন্তু এই টাকা দিয়ে চাল, ডাল, তেল, নুন, আটা, সবজি, মাছ, মাংস, ডিম, দুধের মতো খুব প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। অবসর বিনোদন, রেস্টুরেন্টে খাওয়া এবং কোথাও ঘুরতে যাওয়া এমনকি সামাজিকতা রক্ষা করতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়াটা এখন অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ ৫০ হাজার টাকায় একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের বেশ ভালোভাবে বেঁচে থাকার কথা। অথচ সেই উপার্জনেও এখন মানুষকে নিম্নবিত্তের জীবনযাপন করতে হচ্ছে।