রেলের কর্মবিরতি প্রত্যাহার

ঘুরল চাকা, সূচিতে গড়বড়

রেলে 'রানিং অ্যালাউন্স' বহাল রেখে প্রজ্ঞাপন একদিনে কমলাপুরে ক্ষতি সোয়া কোটি

প্রকাশ | ৩০ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
রানিং স্টাফদের কর্মবিরতি প্রত্যাহারের পর ট্রেন চলাচল শুরু হলেও সূচিতে গড়বড় থাকায় যাত্রীদের ভোগান্তি পোহাতে হয় -স্টার মেইল
রানিং স্টাফদের কর্মবিরতির পর সারা দেশে ট্রেন চলাচল শুরু হলেও সূচিতে গড়বড় দেখা দিয়েছে। ঢাকায় কোচ না থাকায় সিলেট রুটের জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস এবং বুড়িমারী রুটের বুড়িমারী এক্সপ্রেস ট্রেনের যাত্রা বাতিল করেছে কর্তৃপক্ষ। বুধবার ঢাকার কমলাপুর স্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, বেলা ১০টা পর্যন্ত জয়দেবপুর কমিউটার, রাজশাহী রুটের ধূমকেতু এক্সপ্রেস, সোনার বাংলা এক্সপ্রেস, কক্সবাজারগামী পর্যটক এক্সপ্রেস, তিস্তা এক্সপ্রেসসহ দশটি ট্রেন ছেড়ে গেছে। প্রতিটি ট্রেন ছেড়েছে নির্ধারিত সময়ের অন্তত এক ঘণ্টা পর। সবচেয়ে বেশি দেরি করেছে পারাবাত এক্সপ্রেস। সকাল সাড়ে ৬টায় পারাবাত এক্সপ্রেস ঢাকা ছাড়ার কথা, অথচ ১০টা পর্যন্ত ওই ট্রেন ছাড়েনি। ৮টা ১৫ মিনিটে মহুয়া ৮টা ১৫ মিনিটে মহুয়া কমিউটার, ৮টা ৪৫ মিনিটে চট্টগ্রাম রুটের কর্ণফুলী কমিউটার, ৯টা ১০ মিনিটে রংপুর এক্সপ্রেস ট্রেন ছাড়ার কথা ছিল। তবে বেলা ১০টা পর্যন্ত ট্রেনগুলো ছাড়েনি। সাড়ে ৭টার দেওয়ানগঞ্জগামী তিস্তা এক্সপ্রেস কমলাপুর ছেড়ে যায় বেলা ৯টা ৫০ মিনিটে। স্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, যাত্রীরা পস্ন্যাটফর্মে ট্রেনের অপেক্ষায় আছেন। তবে আগের দিন ট্রেন না চলায় ভিড় সেভাবে নেই। সিলেটের পারাবাত এক্সপ্রেসের যাত্রী রাবেয়া বেগম বলেন, 'সাড়ে ৬টায় ট্রেন ছিল। দেরি হবে জেনে সকাল ৮টায় স্টেশনে আসি। তবে এখনো ট্রেন ছাড়েনি। বলছে দশটার পরে ছাড়বে।' পারাবাত এক্সপ্রেসের যাত্রী জয়নাল আবেদীন বলেন, 'ভোরে জানতে পেরেছি কর্মবিরতি প্রত্যাহার করে নিয়েছে। আমি ভোর ৫টায় স্টেশনে এসেছি। তবে ট্রেন ছাড়েনি। সেই থেকে অপেক্ষায় আছি।' কমলাপুর স্টেশনের ম্যানেজার মো. শাহাদাত হোসেন বলেন, ট্রেনগুলো নির্ধারিত সময়ে ছাড়ার চেষ্টা করছেন তারা। তবে ট্রেনগুলো ছাড়ার আগের প্রস্তুতি নিতে কিছুটা সময় লাগছে। তিনি আরো বলেন, 'ট্রেনের ইঞ্জিন চালু করা, কোচগুলো পরিষ্কার করে রেডি করতে কিছুটা সময় লাগছে। এ কারণে ট্রেন ছাড়তে দেরি হচ্ছে। জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস এবং বুড়িমারী এক্সপ্রেস ট্রেনের রেক ঢাকায় নেই, সেগুলো ওই প্রান্তের স্টেশনে আছে।ওই রেক এলে সেগুলো ঢাকা থেকে ছাড়া হবে। এজন্য ওই দুটো ট্রেনের যাত্রা বাতিল করা হয়েছে। আশা করছি, আজ (বুধবার) দিনের মধ্যে সূচি মেনে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হয়ে আসবে।' ঢাকাগামী যাত্রী শফিকুল ইসলাম বলেন, 'ট্রেন চলাচল শুরু হলেও শিডিউল বিপর্যয় হচ্ছে। প্রত্যেকটা ট্রেন স্টেশনে আসছে ৩০-৪০ মিনিট দেরি করে। তারপরেও স্বস্তির খবর ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে, সেটা স্বাভাবিক থাকলে আমরা যাত্রীরা খুশি।' রেলে 'রানিং অ্যালাউন্স' বহাল রেখে প্রজ্ঞাপন এদিকে, রেলওয়ের রানিং স্টাফদের 'রানিং অ্যালাউন্স' সুবিধা বহাল রেখে এই বিষয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকারের অর্থ বিভাগ। অর্থ বিভাগের উপসচিব সৈয়দ আলী বিন হাসানের স্বাক্ষরে এই প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে বুধবার। তাতে বলা হয়েছে, 'রানিং স্টাফ হিসেবে চলন্ত ট্রেনে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে ভ্রমণ ভাতা বা দৈনিক ভাতার পরিবর্তে রেলওয়ে এস্টাবলিশমেন্ট কোডের বিধান অনুযায়ী রানিং অ্যালাউন্স প্রাপ্য হবেন। চলন্ত ট্রেনে দায়িত্ব পালনের জন্য রানিং অ্যালাউন্স ছাড়া অন্য কোনো ভাতা প্রাপ্য হবেন না।' মূল বেতনের সঙ্গে রানিং অ্যালাউন্স যোগ করে পেনশন এবং আনুতোষিকের দাবি পূরণ না হওয়ায় সোমবার মধ্যরাত থেকে কর্মবিরতি শুরু করেন রানিং স্টাফরা। তাতে মঙ্গলবার সারাদিন সারা দেশে ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকে। নজিরবিহীন এই পরিস্থিতিতে স্টেশনে এসে ভোগান্তিতে পড়তে হয় আগাম টিকেটের যাত্রীদের। মঙ্গলবার দিনভর আলোচনার পর বুধবার মধ্যরাতে যোগাযোগ ও রেল উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের বাসায় বৈঠকের পর চলমান কর্মবিরতি প্রত্যাহার করে ট্রেন চলাচল শুরুর ঘোষণা দেন বাংলাদেশ রেলওয়ে রানিং স্টাফ ও শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মজিবুর রহমান। একদিনে কমলাপুরে ক্ষতি সোয়া কোটি টাকা রেলের রানিং স্টাফদের কর্মবিরতিতে প্রায় ৩০ ঘণ্টা ট্রেন বন্ধ থাকায় রাজধানীর কমলাপুর স্টেশনের প্রায় সোয়া কোটি টাকার মত আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। কমলাপুর স্টেশনের ব্যবস্থাপক শাহাদাত হোসেন বুধবার সাংবাদিকদের এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেন, 'কমলাপুর স্টেশনের টিকেট বিক্রি থেকে দৈনিক ১ কোটি ১৫ লাখ থেকে ১ কোটি ২০ লাখ টাকা আয় হয়। তো কাল যেহেতু সবগুলো ট্রেন বন্ধ ছিল সে কারণে টিকেটের টাকা যাত্রীদের ফেরত দিতে হয়েছে। ফলে রেলের ওই টাকাটা ক্ষতি হয়েছে।' এদিকে, ঢাকার কমলাপুর থেকে প্রতিদিন ৪২ জোড়া আন্তঃনগর এবং ২৫ জোড়া লোকাল, মেইল, কমিউটার ট্রেন চলাচল করে। মূল বেতনের সঙ্গে রানিং অ্যালাউন্স যোগ করে পেনশন এবং আনুতোষিকের দাবি পূরণ না হওয়ায় সোমবার মধ্যরাত থেকে কর্মবিরতি শুরু করেন রানিং স্টাফরা। তাতে মঙ্গলবার সারাদিন সারা দেশে ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকে। নজিরবিহীন এই পরিস্থিতিতে স্টেশনে এসে ভোগান্তিতে পড়তে হয় আগাম টিকেটের যাত্রীদের। তখন যাত্রীদের টিকেটের টাকা ফেরত দেয় রেলওয়ে। রেলকর্মীদের বুঝিয়ে কাজে ফেরাতে মঙ্গলবার দিনভর দফায় দফায় বৈঠক করেও সমঝোতার পথ বের করতে পারেননি রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব, রেলওয়ের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালকসহ জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা। রানিং স্টাফদের নেতা মজিবুর রহমানকে খুঁজে না পাওয়ায় বিষয়টি আটকে থাকে। এই চেষ্টায় যুক্ত হন বিএনপি চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী এবং জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের সমন্বয়ক শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাসও। কিন্তু তিনিও কোনো সমাধান দিতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত গভীর রাতে রাজধানীর মিন্টো রোডে যোগাযোগ ও রেল উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের বাসায় বৈঠকের পর চলমান কর্মবিরতি প্রত্যাহার করে ট্রেন চলাচল শুরুর ঘোষণা দেন বাংলাদেশ রেলওয়ে রানিং স্টাফ ও শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মজিবুর রহমান। সোমবার সন্ধ্যার পর থেকে প্রকাশ্যে না থাকা রানিং স্টাফদের নেতা মজিবুর রাত আড়াইটায় প্রেস বিফ্রিংয়ে কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়ে বলেন, 'আমাদের সমস্যা আগামীকালের (বুধবার) মধ্যে সমাধান করবেন উপদেষ্টা মহোদয়। আমরা জনদুর্ভোগ চাই না। দুঃখ প্রকাশ করছি। এখন থেকে কর্মবিরতি প্রত্যাহার করলাম। মিডিয়ার মাধ্যমে কর্মী ভাইদের বলতে চাই আপনার কাজে ফিরুন। উপদেষ্টা বলেছেন, আগের মত আমরা যা পেয়ে আসছি তা পাব।' চট্টগ্রামেও সূচি এলোমেলো এদিকে চট্টগ্রাম বু্যরো জানায়, রেলওয়ে রানিং স্টাফদের দাবি পূরণের আশ্বাসে কর্মসূচি প্রত্যাহারের পর অবশেষে ঘুরল ট্রেনের চাকা। দীর্ঘ ৩০ ঘণ্টা বন্ধ থাকার পর বুধবার ভোর থেকে চট্টগ্রাম থেকে এলোমেলো সূচিতে প্রায় সব ট্রেনই স্টেশন ত্যাগ করেছে। ট্রেনগুলো ছাড়তে আধা ঘণ্টা থেকে দুই-তিন ঘণ্টা বিলম্ব হয়। স্টেশনের কর্মকর্তা ও যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অনেকেরই ধারণা ছিল ট্রেন চলবে না। মধ্যরাতে কর্মসূচি প্রত্যাহারের বিষয়টি অনেকে তাৎক্ষণিক জানতে পারেননি। ফলে যাত্রার প্রস্তুতিও নেননি তারা। এ কারণে যাত্রীর তেমন চাপ দেখা যায়নি। রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের তথ্য অনুযায়ী, কর্মবিরতি প্রত্যাহারের পর চট্টগ্রাম স্টেশন থেকে সকাল ৬টার ঢাকাগামী চট্টলা এক্সপ্রেস সকাল ৮টা ১০ মিনিটে ছেড়ে যায়। ঢাকামুখী সুবর্ণ এক্সপ্রেস সাড়ে ৭টার বদলে সাড়ে ৮টায় ছাড়ে। সিলেটগামী পাহাড়িকা এক্সপ্রেস সকাল ৭টা ৫০ মিনিটে চট্টগ্রাম ত্যাগের কথা ছিল। সেটি ৮টা ৫০ মিনিটে ছেড়ে যায়। সকাল ৮টার চাঁদপুরগামী সাগরিকা এক্সপ্রেস গেছে ৯টা ৩৫ মিনিটে। এছাড়া জামালপুরগামী বিজয় এক্সপ্রেস সকাল ৯টায় ছাড়ার সূচি থাকলে সেটি সাড়ে ১০টায় চট্টগ্রাম স্টেশন ত্যাগ করেছে। সকাল ৭টার কক্সবাজার স্পেশাল ট্রেন ১০টা ৫ মিনিটে ছেড়ে যায়। তবে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ঢাকাগামী মহানগর এক্সপ্রেস নির্ধারিত সূচি অনুযায়ী ছেড়ে গেছে। এর আগে, সকাল সাড়ে ৭টায় ও ৭টা ৪০ মিনিটে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়গামী দুইটি শাটল ট্রেন রেলস্টেশন ছেড়ে যায়। কর্মবিরতি প্রত্যাহারের পর চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে প্রথম ট্রেন আসে চাঁদপুর থেকে মেঘনা এক্সপ্রেস ভোর সাড়ে ৫টায়। এছাড়া চট্টগ্রাম রেলস্টেশন ছেড়ে যাওয়া লোকাল ট্রেনগুলো ছাড়তেও আধা ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা বিলম্ব হয়েছে। ট্রেনের সূচি বিপর্যয়ে ভোগান্তির কথা জানিয়ে সাদ্দাম নামে যাত্রী বলেন, ঢাকায় জরুরি কাজ আছে। আদৌ যেতে পারবেন কিনা, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি। মধ্যরাতের পর কর্মবিরতি প্রত্যাহারের খবর শুনে ভোরে তাড়াহুড়ো করে প্রস্তুতি নিয়ে স্টেশনে চলে আসি। কিন্তু এসে দেখি, ট্রেন ঠিক সময়ে ছাড়ছে না। চট্টগ্রাম স্টেশন ব্যবস্থাপক আবু বক্কর সিদ্দিক সাংবাদিকদের জানান, রাত আড়াইটার দিকে কর্মবিরতি প্রত্যাহারের বিষয়টি জানতে পারি। তবে লোকোমাস্টাররা (চালক) এসেছেন সকাল ছয়টার পর। তাই ট্রেনের সার্বিক প্রস্তুতি যথাসময়ে নেওয়া যায়নি। এজন্য সকালে সূচি মেনে ট্রেন চালানো সম্ভব হয়নি। কিন্তু কোন ট্রেনেরই যাত্রা বাতিল করা হয়নি।