আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের প্রত্যাশা জানিয়ে 'মারামারি-কাটাকাটি আর কাদা ছোড়াছুড়ি' বন্ধ করার জন্য সব পক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। তা না হলে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব 'বিপন্ন হবে' বলে হুঁশিয়ার করে তিনি বলেছেন, 'আমি আজকে বলে দিলাম, নইলে বলবেন সতর্ক করিনি।'
মঙ্গলবার 'জাতীয় শহীদ সেনা দিবস' উপলক্ষে মহাখালীর রাওয়া ক্লাবে 'পিলখানায় সংঘটিত নির্মম হত্যাকান্ডে শাহাদাতবরণকারী শহীদ অফিসারদের স্মরণে' আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে কথা বলছিলেন সেনাপ্রধান।
একটি 'সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক' নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় জানিয়ে জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, 'তার আগে যে সমস্ত সংস্কার করা প্রয়োজন অবশ্যই সরকার সেদিকে খেয়াল করবেন। আমরা যৌথবাহিনী ড. ইউনূসের সঙ্গে কথা বলেছি।'
ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টাও 'একমত' হয়েছেন দাবি করে সেনাপ্রধান বলেন, 'প্রথমেই বলেছিলাম ১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচনের কথা। আমার মনে হয়, সরকার সেদিকেই ধাবিত হচ্ছে। ড. ইউনূস যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন। দেশটাকে ইউনাইটেড রাখতে কাজ করে যাচ্ছেন। উনাকে আমাদের সাহায্য করতে হবে, উনি যেন সফল হতে পারেন। আসেন আমরা নিজেদের মধ্যে মারামারি-কাটাকাটি না করে দেশ জাতি যেন একসঙ্গে থাকতে পারি সেদিকে কাজ করি। আমাদের মধ্যে মতের বিরোধ থাকতে পারে, চিন্তাচেতনার বিরোধ থাকতে পারে, কিন্তু দিনশেষে যেন আমরা সবাই দেশ ও জাতির দিকে খেয়াল করে সবাই যেন এক থাকতে পারি।'
কেবল এক থাকলেই এ দেশ উন্নত হবে, সঠিকপথে পরিচালিত হবে মন্তব্য করে সেনাপ্রধান বলেন, 'না হলে আমরা আরও সমস্যার মধ্যে পড়তে যাব। আমরা ওইদিকে যেতে চাই না। আমি আপনাদের সতর্ক করে দিচ্ছি। পরে বলবেন, সতর্ক করিনি। আপনারা যদি নিজেদের মধ্যে ভেদাভেদ ভুলে একসাথে কাজ করতে না পারেন, নিজেরা যদি কাদা ছোড়াছুড়ি করেন। মারামারি কাটাকাটি করেন, দেশ ও জাতির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবে।'
জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, 'আমি আপনাদের সতর্ক করে দিচ্ছি। এই দেশ আমাদের সবার। আমরা সবাই সুখে শান্তিতে থাকতে চাই। সেই উদ্দেশ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।'
'আমার অন্য কোনো আকাঙ্ক্ষা নাই'
জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, 'আজকে একটু স্পষ্ট করে কথা বলতে চাই। আপনাদের সবার হয়ত ভালো লাগতে নাও পারে। কিন্তু বিশ্বাস করেন, এটা যদি গ্রহণ করেন, আপনারা লাভবান হবেন। কোনো ক্ষতি হবে না দেশের। আমার অন্য কোনো আকাঙ্ক্ষা নাই, একটাই আকাঙ্ক্ষা। দেশ এবং জাতিটাকে একটা সুন্দর জায়গায় রেখে... এনাফ ওয়াজ লাস্ট সেভেন- এইট মান্থস ইজ এনাফ। আমি চাই, দেশ এবং জাতিকে একটা সুন্দর জায়গায় রেখে আমরা সেনানিবাসে ফেরত আসব।'
দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার পেছনে 'কিছু কারণ' তুলে ধরে সেনাপ্রধান বলেন, 'প্রথম কারণটা হচ্ছে- আমরা নিজেরা হানাহানির মধ্যে ব্যস্ত। একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে বিষোদ্গারে ব্যস্ত। এটা একটা চমৎকার সুযোগ অপরাধীদের জন্য। যেহেতু আমরা একটা অরাজক পরিস্থিতির মধ্যে বিরাজ করছি, তারা খুব ভালোভাবেই জানে এ সময় যদি এই সমস্ত অপরাধ করা যায়, তাহলে এখান থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব। সে কারণে এই অপরাধগুলো হচ্ছে। আমরা যদি সংগঠিত, একত্রিত থাকি, তাহলে অবশ্যই সম্মিলিতভাবে এটা মোকাবিলা করা সম্ভব হবে।'
সেনাপ্রধান বলেন, পুলিশ,র্ যাব, বিজিবি, ডিজিএফআই, এনএসআই- সব সংস্থাই অতীতে দেশের জন্য 'অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ' কাজ করেছে। আজকে দেশের যে স্থিতিশীলতা, দেশটাকে যে এত বছর স্থিতিশীল রাখা হয়েছে, এটার কারণ হচ্ছে- এই সশস্ত্র বাহিনীর বহু সদস্য, সিভিলিয়ান সবাই মিলে এই অর্গানাইজেশনগুলোকে ইফেক্টিভ রেখেছে। সেজন্য আজকে এতদিন ধরে একটা সুন্দর পরিবেশ পেয়েছি।
তবে, অপরাধ করলে তার শাস্তিও যে হতে হবে, সে কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, 'না হলে সেই জিনিস আবার ঘটবে। আমরা সেটাকে বন্ধ করতে চাই চিরতরে। কিন্তু তার আগে মনে রাখতে হবে, আমরা এমনভাবে কাজটা করব, এই সমস্ত অর্গানাইজেশনগুলোকে যেন আন্ডারমাইন করা না হয়। আজকে পুলিশ সদস্য কাজ করছে না, একটা বিশাল বড় কারণ হচ্ছে- অনেকের বিরুদ্ধে মামলা, অনেকে জেলে।'
র্
যাব, বিজিবি, ডিজিএফআই, এনএসআইয়ের বিরুদ্ধে গুম-খুনসহ 'বিভিন্ন দোষোরোপের' তদন্ত চলছে জানিয়ে জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, 'অবশ্যই তদন্ত চলবে, দোষীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। এমনভাবে কাজটা করতে হবে, যেন এ অর্গানাইজেশনগুলো আন্ডারমাইন্ড না হয়। এই অর্গানাইজেশনগুলোকে আন্ডারমাইন করে যদি আপনারা মনে করেন যে, দেশে শান্তিশৃঙ্খলা বিরাজ করবে, সবাই শান্তিতে থাকবেন, এটা হবে না। সেটা সম্ভব না, আমি আপনাদের স্পষ্ট করে বলে দিচ্ছি।'
দেশের শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব শুধু সেনাবাহিনীর না মন্তব্য করে তিনি বলেন, 'দুই লাখ পুলিশ আছে, বিজিবি আছে,র্ যাব আছে, আনসার ভিডিপি আছে। আমার আছে ৩০ হাজার সৈন্য। আমি ৩০ হাজার সৈন্য দিয়ে আমি কীভাবে এটা পূরণ করব? ৩০ হাজার থাকে, তারা চলে যায় ক্যান্টনমেন্টে, আরও ৩০ হাজার আসে। এটা দিয়ে আমরা দিন রাত চেষ্টা করে যাচ্ছি।'
দেশের উচ্ছৃঙ্খল কাজগুলো 'আমাদের নিজস্ব তৈরি' বলেও মন্তব্য করেন সেনাপ্রধান। তিনি বলেন, 'বিপরীতমুখী কাজ করলে দেশে কখনো শান্তিশৃঙ্খলা আসবে না। জিনিসটা আপনাদের মনে রাখতে হবে।'
জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, 'আমাদের সেনাবাহিনীর ওপরে আক্রমণ কইরেন না। একটা কমন জিনিস আমি দেখতে পাচ্ছি। সেনাবাহিনী ও সেনাপ্রধানের প্রতি বিদ্বেষ কারও কারও, কী কারণ আজ পর্যন্ত এটা আমি খুঁজে পাইনি। আমরা হচ্ছি, একমাত্র ফোর্স, যেটা আপনাদের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। দাঁড়িয়ে আছি, পস্ন্যাটফর্মে। আমাদের আক্রমণ কইরেন না। আমাদের অনুপ্রাণিত করেন, আমাদের উপদেশ দেন। আমরা অবশ্যই ভালো উপদেশ গ্রহণ করব। আমরা একসাথে থাকতে চাই। দেশ ও জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই।'
'পিলখানা হত্যাকান্ড বিজিবি সদস্যদের হাতেই'
১৬ বছর আগে পিলখানায় সেনা সদস্যদের হত্যার ঘটনা তখনকার 'বিজিবি সদস্যরাই' ঘটিয়েছে বলে মন্তব্য করেন সেনাপ্রধান। নিজেকে সেই 'বর্বরতার চাক্ষুস সাক্ষী' হিসেবে তুলে ধরে তিনি বলেন, 'এই বর্বরতা কোনো সেনা সদস্য করেনি। সম্পূর্ণটাই তদানীন্তন বিজিবি সদস্য দ্বারা সংঘটিত। ফুল স্টপ, এখান কোনো ইফ এবং বাট নাই। এখানে যদি ইফ এবং বাট আনেন, এই যে বিচারিক কার্যক্রম এতদিন ধরে হয়েছে, ১৬-১৭ বছর ধরে যারা জেলে আছে, যারা সাজাপ্রাপ্ত, সেই বিচারিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে। এই জিনিসটা খুব পরিষ্কার মনে রাখা প্রয়োজন। এই বিচারিক প্রক্রিয়াকে নষ্ট করবেন না।'
২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রম্নয়ারি সীমান্তরক্ষা বাহিনীর সদর দপ্তরে একসঙ্গে ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে হত্যা করা হয়।
বিডিআরের দরবার হল থেকে সূচনা হওয়া ওই বিদ্রোহের ইতি ঘটে নানা ঘটন-অঘটনের মধ্য দিয়ে। সেই বিদ্রোহের পর সীমান্ত রক্ষা বাহিনী বিডিআরের নাম বদলে যায়, পরিবর্তন আসে পোশাকেও। এ বাহিনীর নাম এখন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বা বিজিবি।
বিদ্রোহ ও হত্যা মামলার বিচার হলেও ক্ষমতার পালাবদলের পর পুনরায় তদন্তের দাবি ওঠে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে গত ডিসেম্বরের সাত সদস্যের স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার।
মঙ্গলবারের অনুষ্ঠানে সেনাপ্রধান বলেন, 'যে সমস্ত সদস্য শাস্তি পেয়েছে, তারা শাস্তি পাওয়ার যোগ্য। এখানে কোনো রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এর মধ্যে জড়িত ছিল কিনা, বাহিরের কোনো শক্তি এর মধ্যে জড়িত ছিল কিনা সেটার জন্য কমিশন করা হয়েছে। কমিশন সেটা বের করবেন এবং আপনাদের জানাবেন। বটমলাইন হচ্ছে- আমাদের এই চৌকস সেনাসদস্যরা যারা প্রাণ হারিয়েছেন, তারা প্রাণ হারিয়েছেন তদানীন্তন বিডিআর সদস্যদের গুলিতে। আমরা এ সমস্ত জিনিস নিয়ে অনেক ভিন্নমত পোষণ করছি কেউ কেউ। এই জিনিসটাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করছি। সেটা আমাদের জন্য মঙ্গলজনক হবে না।'
তিনি বলেন, 'আমরা নিজেরা ভেদাভেদ সৃষ্টি না করি। আমরা নিজেরা ইউনাইটেড থাকি। আমাদের মধ্যে যদি কোনো সমস্যা থেকে থাকে, কোনো ব্যত্যয় থেকে থাকে সেটা আমরা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করব। এটার জন্য ডানে-বামে দৌড়ে কোনো লাভ হবে না, নিজের ক্ষতি ছাড়া কোনো লাভ হবে না। আমি আপনাদের এই জিনিসটা নিশ্চিত করে দিচ্ছি। কিছু কিছু সদস্যদের দাবি, তারা ২০০৯ সাল থেকে আজ পর্যন্ত বিভিন্ন শাস্তি পেয়েছেন। কেউ কেউ দাবি করছেন, তারা অযাচিতভাবে শাস্তি পেয়েছেন। এটার জন্য আমি একটা বোর্ড করে দিয়েছি। একজন লেফটেন্যান্ট জেনারেল সেই বোর্ডের সদস্য। প্রথম ধাপে ৫১ জন সদস্যের ব্যাপারে আমার কাছে রিকমেন্ডেশন নিয়ে এসেছে। রিকমেন্ডেশনের অধিকাংশ আমি গ্রহণ করেছি। নৌবাহিনী এবং বিমান বাহিনীও তাদের এই কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।'
সেনাপ্রধান বলেন, 'যদি কেউ অপরাধ করে থাকে, সেটার জন্য কোনো ছাড় হবে না, বিন্দুমাত্র ছাড় নাই। আমি আপনাদের স্পষ্ট করে দিচ্ছি। এটা একটা ডিসিপিস্ননড ফোর্স, ডিসিপিস্ননড ফোর্সকে ডিসিপিস্ননে থাকতে দেন। আজকে দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে সমস্ত বাহিনী সমস্ত অর্গানাইজেশন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। খালি সেনাবাহিনী টিকে আছে। বিমান বাহিনী, নৌবাহিনী টিকে আছে। কেন? বিকজ অব ডিসিপিস্নন। আমি আমার অফিসারদের আদেশ দিয়েছি, যদি সামান্যতম কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকে যে কারও বিরুদ্ধে অ্যাকশন নেওয়া হয়েছে, অপরাধী কিনা, যদি সামান্য কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকে, সেটা তাদের ফেবারে যাবে। এটা হচ্ছে আমার ঢালাও নির্দেশ।'
###