ইফতার-সেহেরির বাজেটে কাঁচি

প্রকাশ | ০১ মার্চ ২০২৫, ০০:০০

সাখাওয়াত হোসেন
টানা তিন বছর ধরে দেশের মানুষের প্রকৃত আয় কমছে। তার বিপরীতে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। ফলে, এক বছরের বেশি সময় ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে দিশেহারা মানুষ। তবে তাদের আয় সেভাবে বাড়েনি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের জানুয়ারির পর থেকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত কোনো মাসেই মূল্যস্ফীতির সঙ্গে তাল মিলাতে পারেনি মজুরি বৃদ্ধির হার। প্রতি মাসে গড়ে যত মজুরি বেড়েছে, মূল্যস্ফীতি ছিল তার চেয়ে বেশি। ফলে, সাধারণ ও সীমিত আয়ের মানুষের বাজার থেকে নিত্যপণ্য ও সেবা কেনার সামর্থ্য কমেছে। এরই মধ্যে রোজা শুরুর আগেই বরাবরের মতো নিত্যপণ্যের দাম আরও এক ধাপ বাড়ায় নিম্ন-মধ্যবিত্তরা মহাবিপাকে পড়েছে। সবদিক সামাল দিতে গিয়ে তারা ইফতার ও সেহেরির বাজেটে কাঁচি চালাতে বাধ্য হচ্ছে। স্বল্প আয়ের বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে কথা বলে ও রাজধানীর একাধিক বাজার ঘুরে দেখা গেছে, রমজানে অতিরিক্ত ব্যবহার্য প্রায় প্রতিটি পণ্যের দাম গড়ে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ বেড়েছে। তাই ইফতার ও সেহেরির খাদ্য তালিকা থেকে অন্তত ২৫ শতাংশ পণ্য বাদ দিতে হচ্ছে। অনেকে দীর্ঘদিনের রেওয়াজ ভেঙে ভিন্ন খাবার দিয়ে ইফতার ও সেহেরি করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। অতিদরিদ্ররা ইফতারির পর্ব পুরোটাই বাদ দিয়ে একবারে রাতের খাবার খাওয়ার কথা ভাবছেন। আর সেহেরিতে নিয়মিত খাবারের সঙ্গে 'ভাল' কিছু আইটেম যোগ করার যে প্রচলন ছিল তা এখন অনেকের কাছেই 'স্বপ্ন' হয়ে উঠেছে। রোজায় ইফতার সারতে চারজনের একটি পরিবারে প্রায় সাড়ে চার কেজি চিনি খরচ হতে পারে। এতে ব্যয় হবে ৬৩০ টাকা। ভাজাপোড়ায় অন্তত পাঁচ লিটার তেল প্রয়োজন হয়, খরচ হবে নূ্যনতম ৮০০ টাকা। এর বাইরে ছোলা, ডাল, বেসন, পেঁয়াজ, আলু, বেগুন, কাঁচামরিচ, ধনেপাতাসহ ইফতারির ভাজাপোড়ার অন্যান্য পণ্যে আরও প্রায় ৪ হাজার ৭০ টাকা ব্যয় হবে। ফল কিনতে ব্যয় হবে প্রায় ৩ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে চারজনের একটি পরিবারের ইফতার সারতে রমজান মাসে নূ্যনতম খরচ হতে পারে প্রায় ৮ হাজার ৫০০ টাকা- যা গত বছর ছিল প্রায় ৬ হাজার টাকা। বাজার পর্যবেক্ষকরা জানান, সারা বছর ফল না খেলেও নিম্ন-মধ্যবিত্তরা ইফতারির পেস্নটে এক-দুই টুকরো ফল রাখার চেষ্টা করেন। এ কারণে এ সময় দেশি-বিদেশি দু'ধরনের ফলের চাহিদা বেশখানিকটা বাড়ে। কিন্তু এবারের চিত্র পুরোটাই ভিন্ন। বিদেশি ফল আমদানি নিরুৎসাহিত করতে বসানো হয়েছে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক। আবার বাড়ানো হয়েছে অগ্রিম কর। বসানো হয়েছে অগ্রিম ভ্যাটও। বিদেশি ফলে শুল্ক করারোপের সর্বশেষ সংযোজন ফল আমদানিতে সম্পূরক শুল্ক ২০ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করা হয়েছে। ফলে, রোজার আগে আকস্মিক বিদেশি ফলের আমদানি কমার সঙ্গে পালস্না দিয়ে দাম হুহু করে বেড়েছে। যার প্রভাব দেশি ফলের ওপরও পড়েছে। সাধারণ সময় চম্পাকলা ডজন ৫০ থেকে ৬০ টাকা, সাগর কলা ৯০ থেকে একশ' টাকা এবং বড় সাইজের সবরী কলার ডজন ১০০ থেকে ১২০ টাকা থাকলেও রোজা শুরুর আগেই এর দর আকাশচুম্বি হয়ে উঠেছে। বাজারে চম্পাকলা ডজন ৯০ টাকা, সাগর কলা ১২০ থেকে ১৫০ টাকা এবং সবরী কলা ১৩০ থেকে ১৭০ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। মাঝারি সাইজের পাকা বেল ক'দিন আগেও ৫০ টাকায় বিক্রি হলেও এখন তা একশ' টাকাতেও কেনা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। সপ্তাহের ব্যবধানে লেবুর দামও বেড়ে দ্বিগুণ। এদিকে মৌসুম শুরুর আগেই বাজারে তরমুজের দেখা মিললেও নিম্ন-মধ্যবিত্তের ইফতারি পেস্নটে তার জোগান মেলানো ভার। ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত মৌসুমে যে তরমুজ অনায়াসে দেড় থেকে দুইশ' টাকায় কেনা গেছে, তা এখন নূ্যনতম তিনশ' টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দু'দিন পর রোজা শুরু হলে এর দাম আরও বাড়বে বলে পাইকারি বিক্রেতারা আশঙ্কা করছেন। বরই, পেয়ারা, পাকা পেঁপের জোগান স্বাভাবিক থাকলেও রোজা শুরুর আগেই এই তিন দেশি ফলের বাজারেও লেগেছে আগুন। রাজধানীর কারওয়ানবাজারের পাইকারি আড়তে মান ভেদে এক কেজি পেয়ারা বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ১২০ টাকায়। খুচরায় ক্রেতাদের পেয়ারা কিনতে হচ্ছে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা দরে। মিষ্টি বরই পাইকারিতে বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ১৫০ টাকায়, খুচরায় ৮০ থেকে ২০০ টাকা। পাকা পেঁপে বিক্রি হচ্ছে কেজিতে ৮০ থেকে ১০০ টাকায়। খুচরা বাজারে দর ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। ফলে, বিদেশি ফল কেনার যাদের সামর্থ্য নেই, তারা দেশি ফল কিনতে এসেও খালি হাতে ফিরছেন। যা নিয়ে ক্রেতাদের মধ্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। এদিকে, বেচাকেনা কমে আসায় ফল ব্যবসায়ীরা ক্ষতির আশঙ্কা করছেন। আমদানিকারকদের ভাষ্য, এখন ১০০ টাকার ফল আমদানি করলে ১৩৬ টাকা শুল্ক-কর দিতে হয়। ফলে আপেল, আঙুর, নাশপাতি, কমলা, মাল্টাসহ বিভিন্ন ধরনের ফল বন্দর এলাকা পার হলেই ১০০ টাকার ফলের দাম ২৩৬ টাকায় গিয়ে ঠেকছে। এর সঙ্গে বাজার পর্যন্ত আসতে এই দামের সঙ্গে পরিবহণ ভাড়াসহ অন্যান্য খরচও যোগ হচ্ছে। ফলে, প্রতি বছর রমজানে বিদেশি ফলের চাহিদা বাড়লেও আমদানিকারকরা এবার অনেক কম ফল আমদানি করেছেন। এনবিআরের হিসাবে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আপেল আমদানি আগের অর্থবছরের তুলনায় ৫১ শতাংশ, মাল্টা ৭০ শতাংশ, আঙুর ২৯ শতাংশ কমেছে। অন্যদিকে, গত জানুয়ারিতে সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর ফলে মেন্ডারিন ৫১ শতাংশ, আঙুর ২১ শতাংশ, আপেল ৩ দশমিক ৫ শতাংশ, নাশপাতি ৪৫ শতাংশ, আনার ও ড্রাগনের ৩২ শতাংশ আমদানি কমেছে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায়। বাজার সংশ্লিষ্টরা জানান, তিন দিনের ব্যবধানে আপেল, কমলা, আঙুর, বেদানা, নাসপাতির কার্টুনপ্রতি দাম বেড়েছে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। দাম বেড়ে প্রতি কেজি সাদা আঙুর বিক্রি হচ্ছে ৪৫০ টাকায়- যা কদিন আগেও ছিল ৪০০ টাকা। কেজিতে ২০০ টাকা বেড়ে প্রতি কেজি লাল আঙুর বিক্রি হচ্ছে ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকায়। কেজিতে ১০০ টাকা বেড়ে প্রতি কেজি এ গ্রেডের আনার বিক্রি হচ্ছে ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকায়। প্রতি কেজি গালা আপেল বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকায়, নাশপতি-মালটা ৩২০ থেকে ৩৩০ ও প্রতি কেজি আমদানি করা স্ট্রবেরি আপেল বিক্রি হচ্ছে ৪০০ টাকায়। এদিকে শুধু স্বল্পআয়ের মানুষই নয়, মধ্যম আয়ের অনেকেও এবার ইফতার-সেহেরির বাজেটে কাঁচি চালাতে হবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও বাজার বিশ্লেষকরা। তাদের ভাষ্য, নিত্যপণ্যের সঙ্গে রমজানে অতিরিক্ত ব্যবহার্য খাদ্যদ্রব্যের দামই শুধু বাড়েনি। একই সঙ্গে অনেকের আয়ও কমেছে। সরকারের পটপরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বস্থানীয় অনেকে তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন। কেউ কেউ নিজ শিল্পপ্রতিষ্ঠানের উৎপাদন সর্বোচ্চ কমিয়ে দিয়ে কোনোরকমে কারখানা টিকিয়ে রেখেছেন। এতে নিম্ন থেকে মধ্যম আয়ের লাখ লাখ কর্মকর্তা-কর্মচারী চাকরি হারিয়েছেন। তাদের ছোট একটি অংশ বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারলেও বাকিরা এখনো বেকার রয়েছেন। ফলে, তাদের পক্ষেও ইফতারি-সেহেরিতে বাড়তি আইটেমের জোগান অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া, নানা প্রতিকূলতায় অর্থনৈতিক মন্দার ফাঁদে পড়া বিপুলসংখ্যক মানুষ এই দুই সময়ের খাবারের বাজেট কাটছাঁট করতে বাধ্য হয়েছেন। বীমা কর্মকর্তা শওকত আলী জানান, রমজানে খেজুর ছাড়া ইফতার করতে হবে তা স্বপ্নেও কখনো ভাবেননি। কিন্তু এবার ইফতারির বাজেট থেকে এ আইটেম বাদ দিতে হয়েছে। এই বীমা কর্মকর্তার ভাষ্য, 'শুল্ক ছাড় ও আমদানি বেশি হওয়ায় এবার খেজুরের দাম কমেছে বলে শুনেছি। কিন্তু বাজারে গিয়ে এ কথার মিল খুঁজে পাইনি। মানসম্মত কোনো খেজুরের কেজি ৯শ' টাকার নিচে নেই। তাই খেজুর না কিনেই বাসায় ফিরেছি। শওকত আলীর দাবি, ৫ আগস্ট সরকারের পটপরিবর্তনের পর নানা কারণে মানুষ বীমা করা কমিয়েছে। ফলে, তাদের কমিশনপ্রাপ্তি কমেছে। এ পরিস্থিতিতে ৫ জনের পরিবারের ইফতারিতে বরাবরের মতো হালিম, বেগুনি, চপ, পেঁয়াজু ও ছোলা ভুনাসহ অন্য মুখরোচক খাবারের চিন্তা পুরোপুরি বাদ দিতে হয়েছে। সেহেরিতে দুধ-কলা-গুড় দিয়ে খাবার শেষে করার যে রেওয়াজ তৈরি হয়েছিল তা-ও এবার ভাঙতে হচ্ছে বলে জানান তিনি। শুধু শওকত আলীই নন, নির্ধারিত আয়ের লাখ লাখ পরিবার একইভাবে ইফতার ও সেহেরি থেকে দুই-তিন কিংবা তারও বেশি আইটেম কাটছাঁট করছেন। নিম্ন-মধ্যবিত্ত কেউ কেউ ভাত-রুটির মতো নিয়মিত খাবার দিয়ে ইফতার-সেহেরি সারার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আর অতি দরিদ্র অনেকের খাবারের রুটিন থেকে 'ইফতারি' শব্দটিই পুরোপুরি উঠে যাচ্ছে। তারা শুধু পানি মুখে দিয়ে রোজা ভেঙে হয়তো কিছু সময় পর রাতের খাবার খাবেন। রামপুরা এলাকার মুদি দোকানি শহর আলী বলেন, সামর্থ্যবান অনেকের কাছে ইফতার-সেহেরি কাটছাঁট করার এ বিষয়গুলো হয়তো অতিরঞ্জিত মনে হবে। তবে তার মতো নিম্নআয়ের মানুষের কাছে এটাই 'বাস্তবতা'। তিন-চার আইটেমের খাবার দিয়ে ইফতারি করা, তাদের কাছে এখন শ্রেফ বিলাসিতা- যোগ করেন এই দোকানি। নির্ধারিত স্বল্প বেতনের চাকরিজীবীদের অবস্থা আরও ভয়াবহ। তারা না পারছেন রাতারাতি চাকরি ছেড়ে দিয়ে ব্যবসা কিংবা অন্য কোনো পেশায় জড়াতে। না পারছেন বেতন বাড়ানোর জন্য কর্তৃপক্ষকে চাপ দিতে। তাই বাধ্য হয়ে চিকিৎসা, বস্ত্র ও শিক্ষা খাতের ব্যয়ে যতদূর সম্ভব লাগাম টানার পর বেশ আগেই খাবারের বাজেট কাটছাঁট করেছেন। এ শ্রেণির মানুষের কাছে ইফতার-সেহেরিতে নতুন করে কাঁচি চালানো দুষ্কর হয়ে পড়েছে। বাজারসংশ্লিষ্টরা জানান, শুধু ইফতারি কিংবা সেহেরির খাবারই নয়, সব ধরনের নিত্য খাদ্যপণ্যের দামই লাগামহীনভাবে বেড়েছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ভোক্তা অধিদপ্তরসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থার জোরালো তদারকি কোনো কিছুই তেমন কাজে আসেনি। বরং সংঘবদ্ধ বাজার সিন্ডিকেট সরকারি তদারকি সংস্থাগুলোকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আমদানিনির্ভর কোনো কোনো পণ্যের দাম লাগামহীনভাবে বাড়িয়েছে। যার প্রভাব দেশে উৎপাদিত পণ্যের ওপর পড়ায় বাজার আরও অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে দু-তিন বছর ধরে মানুষের প্রকৃত আয় কমেছে। বাজার থেকে পণ্য কেনার সামর্থ্য কমেছে। ফলে, সংসার খরচ কাটছাঁট করতে হচ্ছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির তুলনায় মজুরির হার কম হলে দারিদ্র্যসীমার ওপরে মোট জনগোষ্ঠীর ১০ শতাংশ মানুষ অতিঝুঁকিতে থাকে। সেই হিসাবে দেড় কোটি মানুষ বছরজুড়ে এমন কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে।