তবুও যানজটের ভোগান্তি

রমজানের প্রথম দিনেই নগরবাসীর নাভিশ্বাস

প্রকাশ | ০৩ মার্চ ২০২৫, ০০:০০

সাখাওয়াত হোসেন
রমজানের প্রথম দিন রোববার অসহনীয় যানজটের কবলে পড়ে রাজধানীবাসী। এতে ভোগান্তি পোহাতে হয় কর্মস্থল থেকে ঘরে ফেরা সাধারণ মানুষের। ছবিটি রাজধানীর তেজগাঁও সাতরাস্তা এলাকা থেকে তোলা -স্টার মেইল
প্রতি বছর রমজানে রাজধানী ঢাকার ভয়াবহ যানজটের তিক্ত অভিজ্ঞতা মাথায় রেখে এবার সড়কে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক রাখার কাজে ট্রাফিক পুলিশের পাশাপাশি থানা ও রিজার্ভ পুলিশকে যুক্ত করা হয়েছে। ট্রাফিক পুলিশকে সহযোগিতার জন্য মাঠে থাকছে শিক্ষার্থীরাও। এছাড়া, সড়কে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হয়েছে একগুচ্ছ নতুন কৌশল। তবে এসব উদ্যোগের পরও যানজটের অসহনীয় ভোগান্তি নগরবাসীর পিছু ছাড়েনি। রোববার প্রথম রোজার দিনেই নগরীর ট্রাফিক ব্যবস্থা যেন পুরোপুরি ভেঙে পড়ে! দুপুরের পর থেকে ঢাকার প্রতিটি সড়কে তীব্র যানজট দেখা দেয়। যা সামলাতে ট্রাফিক ও থানা পুলিশের পাশাপাশি সহযোগী সবাইকে গলদঘর্ম প্রচেষ্টা চালিয়েও চরমভাবে ব্যর্থ হতে হয়েছে। বিশেষ করে বাণিজ্যিক এলাকা ও অফিসপাড়ায় বিকাল থেকে শত শত গাড়ি তীব্র যানজটে দীর্ঘ সময় আটকে থাকে। নগরজুড়ে অসহনীয় এই যানজটের জন্য পর্যবেক্ষকরা ট্রাফিক পুলিশ ও চালকদের বেপরোয়া মনোভাব, সড়কে গাড়ি পার্কিং, ফুটপাতের পাশাপাশি রাস্তার একাংশ দখল করে হকারদের রাজত্ব ও রাস্তা খোঁড়াখুঁড়িকে দায়ী করলেও পরিবহণ বিশেষজ্ঞরা এজন্য সড়ক নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনিক সমন্বয়হীনতা ও অব্যবস্থাপনাকেই দুষছেন। তাদের ভাষ্য, যুগের পর যুগ রমজানে যানজটের ভোগান্তিতে নগরজীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠলেও তা নিরসনে পরিকল্পিত কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। প্রতি বছর রমজানের শুরুতে এলোমেলো কিছু ছক তৈরি করে যানজট নিরসনের চেষ্টা করে জনগণকে উল্টো ভোগান্তিতে ফেলা হয়। যদিও এ সমস্যায় হাল ছাড়তে নারাজ ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগ। তারা বলছে, পবিত্র রমজানকে কেন্দ্র করে রাজধানীর ট্রাফিকব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত নানা পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। এরই মধ্যে ফুটপাত খালি করাসহ কিছু কার্যক্রম তারা শুরু করেছে। রমজানে সড়কে যাতে ব্যবসায়িক কর্মকান্ড পরিচালিত না হয়, সে জন্য ট্রাফিক বিভাগ কঠোর অবস্থানে থাকবে। নির্ধারিত বাস স্টপেজ ছাড়া গণপরিবহণগুলো যাত্রী ওঠা-নামা করে। এতে পেছনে গাড়ির দীর্ঘ সারি পড়ে। তাই রাস্তায় যাতে গাড়ি না থামে সে জন্য ট্রাফিক বিভাগকে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। ডিএমপি এলাকায় ভারী যানবাহন প্রবেশের নির্দিষ্ট সময়সীমা আছে। প্রায়ই এ সময়সীমা না মেনে চালকরা চলার চেষ্টা করে- যা যানজটের সৃষ্টি করে। নির্ধারিত সময়সীমার বিষয়টি মেনে চলতে হবে। ঢাকা শহরের বিভিন্ন সড়কে গাড়ি মেরামতের কাজ করা হয়। জনসাধারণের দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে রমজানে এ ধরনের কাজ যাতে কেউ না করতে পারে, সে বিষয়ে মাঠ পর্যায়ের ট্রাফিক পুলিশকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ট্রাফিক বিভাগ থেকে নেয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সাধারণ সময়ে রাজধানীতে দুই পালায় চার হাজারের বেশি ট্রাফিক পুলিশ দায়িত্ব পালন করেন। রমজানে যানজট নিয়ন্ত্রণে তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করবে সংশ্লিষ্ট থানার মোবাইল টিম ও রিজার্ভ ফোর্স। এছাড়াও সড়কে ট্রাফিকব্যবস্থাপনায় পুলিশকে সহযোগিতার জন্য থাকা শিক্ষার্থীদের ডিউটি দুই পালার পরিবর্তে এক পালায় আনা হয়েছে। আগে ৬০০ শিক্ষার্থী সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা এবং বিকাল ৪টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত দুই শিফটে পুলিশের সহযোগী হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। রমজানে তারা সবাই বেলা আড়াইটা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত এক শিফটে দায়িত্ব পালন করবেন। ডিএমপির মুখপাত্র উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, রমজানে দুপুরের পর রাস্তায় গাড়ির চাপ বেড়ে যায়। বাসায় ফেরার তাড়া থাকে সবার। মানুষ যাতে নিরাপদে ইফতারের আগেই ঘরে ফিরতে পারে, সে জন্য ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় নানা পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। দুপুরের পর থেকে ইফতার পর্যন্ত রাস্তায় অতিরিক্ত জনবল নিয়োজিত থাকবে। কিছু জায়গায় ডাইভারশন দেওয়া হবে। রাস্তায় কোনো হকার বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বসতে দেওয়া হবে না। গাড়ি পার্কিং করতে দেওয়া হবে না রাস্তায়। ডিএমপির রমনা ট্রাফিক বিভাগের উপকমিশনার শফিকুল ইসলাম বলেন, রমজান মাসে নিউমার্কেট-গাউছিয়া এলাকায় বিপুলসংখ্যক মানুষ কেনাকাটা করতে আসবে। সেখানে যথাযথ পার্কিংয়ের ব্যবস্থা নেই এবং সড়ক বিভাজকে নেই কোনো প্রতিবন্ধক। ফলে, মানুষ ওভারব্রিজে না উঠে হেঁটে রাস্তা পার হয়। এতে গাড়ির গতি কমে যায়। ডিএমপি সদর দপ্তর থেকে অতিরিক্ত জনবল নিয়োগ করে যান চলাচল স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করা হবে। যারা গাড়িতে কেনাকাটা করতে আসবেন, তারা যেন রাস্তায় নেমে গাড়ি ছেড়ে দেন- এমন ক্যাম্পেইন করা হবে। বিশেষ করে বিকাল থেকে যেন যানজট তীব্র না হয়, সে বিষয়ে সচেষ্ট থাকব। উত্তরা ট্রাফিক বিভাগের উপকমিশনার আনোয়ার সাঈদ বলেন, উত্তরা এলাকায় যান চলাচল স্বাভাবিক রাখতে ট্রাফিক পুলিশের পাশাপাশি থানা পুলিশের সদস্যরা সমন্বিতভাবে কাজ করবে। বিভিন্ন শপিংমলের কমিটির সঙ্গে কথা হয়েছে। কমিটির লোকজন মার্কেটের সামনে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় সহায়তা করবে। প্রতি বছর রমজান মাসে অসহনীয় যানজটের কথা উলেস্নখ করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ গত ২৩ ফেব্রম্নয়ারি জানিয়েছেন, আসন্ন রমজান মাসে ট্রাফিক পুলিশকে সহায়তা করতে শিক্ষার্থীরাও মাঠে নামবে। রোজার মাসে ঢাকার মানুষ যাতে স্বস্তিতে বাড়ি ফিরতে পারে সেজন্য ট্রাফিক পুলিশের পাশাপাশি স্কাউট এবং বিএনসিসির সদস্যরা দায়িত্ব পালন করবে। তাছাড়া, বর্তমানে ট্রাফিক সহায়তায় থাকা শিক্ষার্থীদের সংখ্যা আরো বৃদ্ধি করা হবে। যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ এবং বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, সড়কে গাড়ির চাপ সব সময়ই থাকে। কিন্তু রমজানে স্বল্প সময়ের মধ্যে সব ধরনের প্রতিষ্ঠান ছুটি হওয়ার কারণে এই চাপ অনেক বেড়ে যায়। মানুষের কাজের প্রয়োজনে রাস্তায় যেতে হয়, তাই প্রথমত আমাদের পলিসির দিকে দৃষ্টি দেওয়া উচিত। তিনি বলেন, বাংলা মাধ্যমের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকবে, পাশাপাশি ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর পাঠদান অনলাইন মাধ্যমে হলে সড়কে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে যাবে। পাশাপাশি যেসব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম অনলাইনে করার সুযোগ আছে, সেসব প্রতিষ্ঠানের উচিত কর্মচারীদের বাসায় বসে কাজের সুযোগ দেওয়া। ফুটপাত দখল করে রমজানে ইফতারসামগ্রী বিক্রি বন্ধ করতে হবে। ফুটপাত দখল হয়ে গেলে মানুষ ফুটপাতে চলাচল করতে পারবে না, সে কারণে রাস্তায় নেমে আসবে এবং যানজট বাড়বে বলে মনে করেন এই যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ। পরিবহণ সংশ্লিষ্টরা জানান, রমজানে রাজধানীতে যানজটের বড় একটি কারণ যথাযথ পার্কিং ব্যবস্থা না থাকা অপরিকল্পিত বিপণিবিতানগুলো। বিশেষ করে নিউমার্কেটের মতো বৃহৎ পরিসরের বিপণিবিতানে যথাযথ পার্কিং ব্যবস্থা না থাকায় পুরো নীলক্ষেত থেকে সায়েন্স ল্যাব পর্যন্ত যান চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়। মূলত পার্কিং সংকটকে পুঁজি করেই বিপণিবিতানটির আশপাশে নিয়ম ভাঙার এক ধরনের উৎসব চলে। তাই রমজানে রাজধানীতে যান চলাচল স্বাভাবিক রাখতে হলে অবশ্যই অফিস শুরুর ও শেষের সময়গুলোয় তা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। প্রয়োজনে মার্কেট মালিক সমিতির সহযোগিতা নিতে হবে। তাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমেই যথাযথ পার্কিংবিহীন বিপণিবিতানগুলো নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। রোববার বিকাল সাড়ে ৩টা থেকে ৫টা পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক ঘুরে এই চিত্র দেখা যায়, অফিস ছুটির পর রাজধানীর গুলিস্তান, পল্টন, মৎস্যভবন, মিন্টোরোড, কাকরাইল, বাংলামোটর, কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট, তেজগাঁও, বিজয় সরণি, রামপুরা, হাতিরঝিল, বাড্ডা, গুলশান, বনানী, নতুনবাজার এলাকায় ব্যাপক যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। মোড়ে মোড়ে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতে দেখা যায় চাকরিজীবীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষকে। রাজধানীর তেজগাঁও সাতরাস্তা মোড়ে মোটর সাইকেল চালক জাহাঙ্গীর আলম জানান, বোনের বাসায় ইফতারসামগ্রী পৌঁছে দিতে মিরপুর যাচ্ছিলেন। কিন্তু রামপুরা থেকে এ পর্যন্ত আসতেই তার দেড় ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। পথে পথে যে ধরনের যানজট তাতে মিরপুর থেকে বাসায় ফিরতে ইফতারির সময় পেরিয়ে যাবে। তাই তিনি মিরপুর যাওয়ার সিদ্ধান্ত পাল্টে বাসায় ফিরে যাচ্ছেন। একই সড়কে যানজটে আটকে থাকা সিএনজি অটোরিকশাচালক মেহেদী হাসান জানান, দুপুরের পর থেকে কোনো গন্তব্যেই যাত্রী নিয়ে সময়মতো পৌঁছতে পারছেন না। স্বাভাবিক সময়ে যেখানে আধাঘণ্টায় যাওয়া যেত, এখন সেখানে এক থেকে দেড় ঘণ্টা সময় লাগছে। এভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকলে গাড়ি ভাড়া ও গ্যাস খরচ উঠবে কিনা তা নিয়ে তিনি শঙ্কায় রয়েছেন। এদিকে, সকালে পল্টন থেকে উত্তরাগামী এবং উত্তরা থেকে পল্টনগামী রাস্তায় যান চলাচল অনেকটা স্বাভাবিক থাকলেও দুপুরের পর উভয় গন্তব্যের যানবাহনগুলোকে রামপুরা এলাকায় যানজটে পড়তে হয়েছে। উত্তরা থেকে পল্টনগামী যানবাহনগুলোকে যেমন রামপুরায় যানজটে পড়তে হয়েছে, তেমনি পল্টন থেকে উত্তরাগামী যানবাহনকেও রামপুরায় যানজটে পড়তে দেখা গেছে। এদিকে, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের তেজগাঁও অংশে তীব্র যানজটের কারণে ভোগান্তিতে পড়েছেন এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহারকারীরা। রোববার সকাল থেকেই এই পরিস্থিতি দেখা গেছে। এক্সপ্রেসওয়ে কর্তৃপক্ষ জানায়, স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতির বদলে হাতে করে টোল নেওয়ায় জন্য তীব্র যানজট সৃষ্টি হয় তেজগাঁও এলাকায়। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রকল্প পরিচালক এ এইচ এম সাখাওয়াত আখতার গণমাধ্যমকে জানান, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) পরামর্শ মতে তেজগাঁও থেকে বিমানবন্দর যাওয়ার পথের স্বয়ংক্রিয় টোল বুথ বন্ধ করা হয়েছে। যানজট কমানোর জন্য পুলিশ এমন পরামর্শ দেয়। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের তেজগাঁওয়ের অংশ ঘুরে দেখা গেছে, স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতির পরিবর্তে হাতে করে টোল নেওয়া হচ্ছে। ফলে, এক্সপ্রেসওয়েতে ওঠার জন্য যানবাহনের দীর্ঘ লাইন পড়তে যায়। ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে টোল আদায়ের কারণে অনেক সময় লাগছে। এর আগে, গত ২৬ ফেব্রম্নয়ারি এক নির্দেশনায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে উত্তরার দিকে যাতায়াতে যানজট এড়াতে মহাখালী র?্যাম্প ব্যবহারের পরামর্শ দেয় ডিএমপি। ############## \হ