বাজার অস্থির, দিশেহারা ক্রেতা

প্রকাশ | ০৪ মার্চ ২০২৫, ০০:০০

সাখাওয়াত হোসেন
বাজার অস্থির, দিশেহারা ক্রেতা
কিছুদিন আগে থেকেই বাজারে বেশিরভাগ নিত্যপণ্যের দাম আকাশছোঁয়া। রোজা শুরুর পর তা আরও এক ধাপ বাড়ায় বাজার আরও অস্থির হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে রমজান মাসের অন্যতম চাহিদাসম্পন্ন পণ্য ভোজ্যতেলের বাজারে কৃত্রিম সংকটের অস্থিরতায় ক্রেতারা দিশেহারা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাজারে ভোজ্যতেল, চিনিসহ সব ধরনের নিত্যপণ্যের সরবরাহে ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। কোম্পানিগুলো চাহিদামাফিক পণ্য সরবরাহ করছে না। এ পরিস্থিতিতে বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে। পণ্যের সরবরাহ বাড়ানো না গেলে এ অস্থিরতা আরও বাড়বে। বাজার স্থিতিশীল রাখতে পণ্যের সরবরাহ বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই বলে দাবি করেন তারা। তবে রোজা শেষ হওয়ার আগে নিত্যপণ্যের দাম কমবে- এমন সম্ভাবনা দেখছেন না বাজার পর্যবেক্ষকরা। তাদের ভাষ্য, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সাধারণত প্রতি বছর রমজান মাসকে সামনে রেখে চাল, গম, ভোজ্যতেল, চিনি, ডাল, ছোলা, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, হলুদ, শুকনো মরিচ, ডিম, খেজুরসহ নিত্যপণ্যের সরবরাহ ও মূল্য তদারকিতে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করে থাকে। এ বছরও রমজান মাসে যাতে নিত্যপণ্যের বাজারে কোনো প্রকার অস্থিরতা সৃষ্টি না হয়, সেজন্য নানামুখী উদ্যোগ নেওয়া হয়। তবে কোনো উদ্যোগই তেমন কাজে লাগেনি। বাজার সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় বরাবরের মতো এবারও রোজাতে নিত্যপণ্যের বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে বলে মনে করেন তারা। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে নিত্যপণ্যের বাজার স্থিতিশীল ও সরবরাহে সংকট না থাকার দাবি করা হচ্ছে। বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভর মৌসুমেও আলু ও পেঁয়াজের দাম বাড়তে শুরু করেছে। স্থির নেই ডিম, মাছ ও মাংসের বাজারও। গরিবের মাছ বলে খ্যাত পাঙাশ, তেলাপিয়ার দামও এখন উর্ধ্বমুখী। রোজা শুরুর পর সস্তা সবজির দামও লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে বেড়েছে চাল, আটা, ময়দা, ডাল, ছোলা, ব্রয়লার মুরগি, চিনি ও চিড়াসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দাম। বাজার ভেদে গরু ও খাসির মাংসের দাম বেড়েছে কেজিতে দুই থেকে আড়াইশ' টাকা। বিদেশি ফলের সঙ্গে পালস্না দিয়ে বেড়েছে দেশি ফলের দামও। চাহিদার চেয়ে বেশি আমদানির পরও দাম বেড়েছে ছোলার। আমদানিকৃত প্রসাধনী সামগ্রীর সঙ্গে পালস্না দিয়ে দেশি পণ্যের দামও এখন আকাশছোঁয়া। বাজারের এ অস্থিরতায় দিশেহারা নিম্নমধ্যবিত্তরা। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে জটিলতা নিরসনে এলসি খুলতে নানা সুবিধা দিলেও ব্যাংক তা কতটুকু মানছে, তার ওপর তেমন নিয়ন্ত্রণ থাকে না। এ ছাড়া রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বড় প্রতিষ্ঠানের পলাতক কর্ণধারদের বিকল্প হয়ে কারা পণ্য আনবেন, কীভাবে আনবেন এসব নিয়েও পরিকল্পনার ঘাটতি রয়েছে। এ কারণে বাজারে কমছে না অস্থিরতা। এছাড়াও বাজার ও সড়কে চাঁদাবাজি পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে। অথচ নানা উদ্যোগ নেওয়ার পরও অধিকাংশ ক্ষেত্রে চাঁদাবাজি বন্ধ হয়নি। ফলে, বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআরের দেওয়া সুবিধা সাধারণ মানুষের হাতে পৌঁছাচ্ছে না। এদিকে বিশ্ববাজারে দাম বৃদ্ধির অজুহাতে দেশে আমদানিকৃত পণ্যের দাম বাড়ানো হলেও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের এ ব্যাপারে তদারকি না থাকায় বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে বলে মনে করেন বাজার বিশ্লেষকরা। তারা জানান, দেশের ব্যবসায়ীরা আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে দফায় দফায় সয়াবিনের দাম বাড়ালেও বিশ্ববাজারে গত এক বছরে সয়াবিনের দাম কমেছে। ২০২৪ সালে বিশ্ববাজারে সয়াবিনের দাম কমেছে ২৪ দশমিক ৫০ শতাংশ। ২০২৫ সালেও স্থিতিশীল এ পণ্যের বাজার। চালের পাশাপাশি বিশ্বে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যপণ্য গম। শীর্ষ দুই সরবরাহকারী দেশ রাশিয়া ও ইউক্রেন ২০২২ সালের ফেব্রম্নয়ারিতে যুদ্ধে লিপ্ত হলে গম সরবরাহ নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। কিন্তু পরে ভারতসহ অন্য দেশগুলোর সরবরাহ বৃদ্ধি এবং রাশিয়া-ইউক্রেনের সরবরাহ বাড়লে গমের বাজার স্থিতিশীল হয়। ২০২৪ সালে গমের দাম ১২ দশমিক ৮৬ শতাংশ কমে। ২০২৪ সালে বিশ্ববাজারে চালের দাম কমেছে ২১ দশমিক ৩৭ শতাংশ। বিশ্ববাজারে সবচেয়ে নিম্নমুখী চিনির দাম। অথচ এসব প্রতিটি পণ্যের দাম দেশের বাজারে গত কয়েক মাস ধরে হুহু করে বেড়েছে। এ পরিস্থিতিতে রোজার শুরুতে দাম আরও এক ধাপ বেড়ে দেশের বাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। এদিকে রমজান মাসকে সামনে রেখে আমদানি বাড়ানো হলেও বাজার সিন্ডিকেটের কারসাজিতে এর সুফল এখনো অধরা। ব্যবসায়ীরা জানান, বিপুল পরিমাণ পণ্যবাহী কনটেইনার বন্দরে নোঙর করা থাকলেও মূল্যবৃদ্ধির ফন্দিতে তা আনলোড করা হচ্ছে না। ফলে, বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, রমজানে যাতে পণ্যের কৃত্রিম সংকট তৈরি করা সম্ভব না হয় এজন্য গত বছরের তুলনায় রমজানকেন্দ্রিক প্রয়োজনীয় ৯ পণ্যের আমদানি ২০ থেকে ৮৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। তথ্য বলছে, সরকারের এমন উদ্যোগের মধ্যেও গত বছরের তুলনায় এবার প্রায় প্রতিটি নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে ১২-১৫ শতাংশ। বিশেষ করে, ফলের দাম বেড়েছে প্রায় ২০-২৫ শতাংশ। কনজু্যমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, পণ্য গত বছরের চেয়ে বেশি আমদানি হয়েছে, এটা সত্য। কিন্তু পণ্য বেশি আমদানি হলেই তো হবে না, যদি সারাদেশে সঠিকভাবে সেটি ডিস্ট্রিবিউশন করা না যায়। রাজনৈতিক অস্থিরতা দেশব্যাপী আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণে বর্তমানে সাপস্নাই চেনে বড় ধরনের সমস্যা রয়েছে। পণ্য আমদানি করে যদি মানুষের কাছে সেটি পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা না যায় তাহলে সিন্ডিকেট তৈরি হবে এবং পণ্যের দামে নিয়ন্ত্রণ রাখা সম্ভব হবে না। অর্থাৎ মাদার জাহাজ থেকে লাইটারে আসা এরপর লাইটার থেকে পণ্য খালাস এরপর বাজারে ডিস্ট্রিবিউশন-এ বিষয়গুলো সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতে হবে। কিন্তু সিন্ডিকেট যারা করেন তারা এসব জায়গাতেই জ্যাম তৈরি করে পণ্যের সংকট তৈরি করেন। তার এ অভিযোগ যে অমূলক নয়, তা চট্টগ্রাম বন্দরের একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তারা জানান, স্বাভাবিকভাবে যে সংখ্যক কনটেইনার চট্টগ্রাম বন্দরে মজুত করা যায়, বর্তমানে তার চেয়ে আরও ৮ হাজার বেশি পণ্যবাহী কনটেইনারের স্তূপ জমেছে। এসব মজুত করা পণ্য খালাস না করে মূল্যবৃদ্ধির পাঁয়তারা চলছে। এ পরিস্থিতিতে বন্দর কর্তৃপক্ষ আগামী ৯ মার্চের মধ্যে ডেলিভারি না নিলে ৪ গুণ মাশুল আদায়ের ঘোষণা দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, গত চার মাসে চিনি আমদানি হয়েছে ৪ লাখ ৫৪ হাজার ৩৪ টন। এটি আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২০ শতাংশ বেশি। এ সময়ে সয়াবিন তেলের আমদানি ৩৪ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৯৮ হাজার ২৫২ টন। ডাল জাতীয় পণ্যের আমদানি ৪৪ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৫৭ হাজার ৮৩৭ টন। এ ছাড়াও ছোলা আমদানি হয়েছে ৯৭ হাজার ৫৫৫ টন- যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৬৪ শতাংশ বেশি। খেজুরের আমদানি ২৩ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ১৪ হাজার ৪২০ টন। আলোচ্য সময়ে সর্বোচ্চ ৮৫ শতাংশ আমদানি বেড়েছে মোটর ডালের, আমদানি হয়েছে ২ লাখ ২ হাজার ৮৪৫ টন। দেশে পর্যাপ্ত পেঁয়াজ উৎপাদন হওয়ার পরও এই চার মাসে পণ্যটির আমদানি ২ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ২ লাখ ৮০ হাজার ৬১১ টন। এ সময়ে রসুনের আমদানি ২০ শতাংশ বেড়েছে, আমদানি হয়েছে ৬১ হাজার ৩৮১ টন। আদার আমদানি ৫৬ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৫২ হাজার ৫১৫ টন। এদিকে নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতায় সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস ওঠার বিষয়টি বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের কথায় স্পষ্ট প্রকাশ পেয়েছে। মুদি দোকানি আবু জাফর জানান, মাছ-মাংস বাদ দিয়েই তার পাঁচজনের পরিবারের খাবারে নূ্যনতম ৩০০ টাকা খরচ হচ্ছে। এছাড়া, সন্ধ্যা রাতে খাবারে ২৫০ টাকা, ইফতারিতে ২০০ টাকা খরচ হচ্ছে। সবমিলিয়ে শুধু খাবার বাবদ দিনে খরচ হচ্ছে ৭৫০ টাকা। এ হিসেবে মাসে খরচ হবে সাড়ে ২২ হাজার টাকা। অথচ ছোট্ট দোকান থেকে তার মাসে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকার বেশি লাভ হয় না। এ আয়ে সন্তানদের লেখাপড়া, চিকিৎসা ও বাসাভাড়াসহ আনুষঙ্গিক খরচ চালানো অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। দিশেহারা এই মুদি দোকানি এক সন্তানের পড়াশোনা বন্ধ করে দিয়ে তাকে কোনো কাজে লাগানোর কথা ভাবছেন বলে জানান। ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের জুনিয়র অ্যাকাউন্টেট আবুল বাশার জানান, মাছ-মাংস ছাড়াই প্রতিদিন কাঁচাবাজার করতেই ৪ থেকে ৫শ' টাকা খরচ হচ্ছে। তাই এই রমজানে পরিবারের জন্য ফলমূল, দুধসহ পুষ্টিকর খাবার কেনার কথা চিন্তা করে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। বাশারের ভাষ্য, তার মতো স্বল্পআয়ের মানুষ বাজারের এ মাথা থেকে ও মাথা ঘুরেও কী কিনবেন তা বুঝে উঠতে পারছেন না।