অগ্নিঝরা মার্চ

টঙ্গীতে নিহতদের লাশ নিয়ে ঢাকায় মিছিল

প্রকাশ | ০৫ মার্চ ২০২৫, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
একাত্তরের উত্তাল মার্চে স্বাধীনতাকামী বাঙালির সর্বাত্মক সংগ্রামের পঞ্চম দিন দেশের বিভিন্ন স্থানে বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটে। এদিন টঙ্গী শিল্প এলাকায় সেনাবাহিনীর গুলিতে চারজন নিহত ও ২৫ জন আহত হন। এ ঘটনার প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধ শ্রমিক-জনতা টঙ্গীর কংক্রিট ব্রিজের পাশের কাঠের ব্রিজটি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেন এবং বড় বড় গাছ ফেলে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে রাস্তা বন্ধ করেন। ছাত্রলীগের উদ্যোগে টঙ্গীতে নিহত শ্রমিকদের লাশ নিয়ে ঢাকায় মিছিল করেন ছাত্র-জনতা। এদিকে জনতার ওপর গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে একাত্তরের ৫ মার্চ দেশব্যাপী সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। মুক্তিকামী বাঙালির উত্তাল ও অপ্রতিরোধ্য দুর্বার আন্দোলনে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ভিত নড়ে ওঠে। নিরীহ মানুষের ওপর গুলিবর্ষণ থেকে শুরু করে সব ধরনের অত্যাচার-নির্যাতনের মাত্রা বাড়তে থাকে। অন্যদিকে, এসব ঘটনার প্রতিবাদে দ্বিগুণ গতিতে গর্জে ওঠে বাংলার প্রতিবাদী মানুষ। এদিন জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার ঘোষণাকে অবাঞ্ছিত ও অগণতান্ত্রিক ঘোষণা করে বেলুচিস্তান ন্যাপ। একাত্তরের এইদিনে গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে বাঙালির বিদ্রোহ। জেলায় জেলায় হরতাল চলে। রাজশাহী, রংপুর, যশোরও উত্তাল। নারায়ণগঞ্জের জনসভায় শক্তি প্রয়োগ বন্ধ করার আহ্বান জানান আওয়ামী লীগ নেতা তাজউদ্দীন আহমেদ। ঢাকায় সেদিন লেখক, শিল্পী ও সাহিত্য সভা অনুষ্ঠিত হয়। জাগ্রত বাঙালির প্রার্থিত দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রামের শপথ নেন তারা। একদিকে সামরিক বাহিনীর পতাকা, অপরদিকে জনগণের সামনে স্বাধীনতার প্রত্যাশিত সূর্য। এদিনের ঘটনা নিয়ে লেখক রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী তার 'একাত্তরের দশ মাস' গ্রন্থে উলেস্নখ করেছেন চট্টগ্রামে সশস্ত্র বাহিনী ও পাক বাহিনীর গুলিবর্ষণে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৩৮ জনে। এছাড়া, হরতাল চলাকালে পাকবাহিনীর গুলিতে খুলনায় ২ জন এবং ও রাজশাহীতে একজন নিহত হন। এদিন রাওয়ালপিন্ডির প্রেসিডেন্ট হাউসে অনুষ্ঠিত ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর দীর্ঘ ৫ ঘণ্টা বৈঠক শেষে পার্টির মুখপাত্র আবদুল হাফিজ পীরজাদা মন্তব্য করেন- জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখার পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত অবাঞ্ছিত এবং আদৌ যুক্তিযুক্ত নয়। এদিন চট্টগ্রামে স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দেন ২২২ বীর বাঙালি। তাদের রক্তে ভেসে যায় বীর চট্টলার রাজপথ। টঙ্গী, যশোর ও রাজশাহীর গণহত্যার সংবাদে ঢাকাসহ সারাদেশের মানুষ প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। শেখ মুজিবের অসহযোগ আন্দোলনের ডাক এবং স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠের পর নড়েচড়ে বসে পিন্ডির শাসকগোষ্ঠী। 'বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর'- স্স্নোগানে প্রকম্পিত টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়ার রাজপথ। অন্যদিকে, লাকনায় ভুট্টোর প্রাসাদে ইয়াহিয়া-ভুট্টো ডুয়েল ষড়যন্ত্রে ২০ হাজার বাঙালির লাশ হলেই আন্দোলন থেমে যাবে- ভুট্টোর এই অভিলাষ বাস্তবায়নে মাছে নামে পাকহানাদার বাহিনী। একাত্তরের এদিন বিকালে অবসরপ্রাপ্ত এয়ার মার্শাল আসগর খান করাচি থেকে ঢাকায় পৌঁছে রাতে শেখ মুজিবের সঙ্গে ধানমন্ডির বাসভবনে সাক্ষাৎ করেন। শেখ মুজিবের স্বাধিকার আন্দোলনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিকালে কবি সাহিত্যিক ও শিক্ষকরা মিছিল নিয়ে রাজপথে নেমে আসেন। ছাত্রলীগ ও ডাকসুর উদ্যোগে বায়তুল মোকাররম থেকে মিছিল বের হয়। এগারো দফা আন্দোলনের অন্যতম নেতা তোফায়েল আহমদ ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দান থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সরাসরি রিলে করার জন্য ঢাকা বেতার কেন্দ্রের প্রতি আহ্বান জানান। এদিন ছাত্রলীগের উদ্যোগে ঢাকায় লাঠি মিছিল বের হয়। ডাকসু সহসভাপতি আ স ম আবদুর রব ও সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কুদ্দুস মাখনসহ অন্য নেতারা এতে নেতৃত্ব দেন। সন্ধ্যায় সরকারিভাবে ঘোষণা করা হয়, আজ ঢাকায় সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে। মুজিবের নির্দেশে হরতালের পর ব্যাংক খোলা থাকে। মসজিদে মসজিদে জুমার নামাজের পর শহীদদের আত্মার শান্তি কামনা করে বিশেষ মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়। লাহোরে অনুষ্ঠিত হয় দেশের পূর্বাঞ্চলে সাম্প্রতিক আন্দোলনে নিহত শহীদদের গায়েবানা জানাজা এবং সংকটময় মুহূর্তে দেশের সংহতির জন্য বিভিন্ন মসজিদে বিশেষ মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়। রাতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ এক বিবৃতিতে বলেন, 'ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, রংপুর ও সিলেটসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে মিলিটারির বুলেটে নিরীহ-নিরস্ত্র শ্রমিক, কৃষক ও ছাত্রদের হত্যা করা হচ্ছে। নির্বিচারে নিরস্ত্র মানুষকে এভাবে হত্যা করা- এটা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ছাড়া আর কিছুই নয়।' তথ্যসূত্র : একাত্তরের দশ মাস, রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী, গতিধারা ১৯৯৭, ঢাকা; বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র: দ্বিতীয় খন্ড, পৃ. ৬৬৬-৬৮।