অগ্নিঝরা মার্চ

২৫ মার্চ জাতীয় অধিবেশন ঘোষণা ইয়াহিয়ার

প্রকাশ | ০৬ মার্চ ২০২৫, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
একাত্তরের মার্চ মাসের এই দিনে পাকিস্তানি শাসকের নির্মমতার শিকার সংক্ষুব্ধ বাঙালি জাতি আর এক দিন পরেই ৭ মার্চ (রোববার) রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার পূর্ণাঙ্গ কর্মসূচির রূপরেখা শোনার জন্য প্রহর গুনছিলেন। এদিন দুপুরে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক বেতার ভাষণে পূর্ব বাংলার আন্দোলনরত জনগণকে 'দুষ্কৃতকারী' আখ্যা দিয়ে ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন। ইয়াহিয়া খানের বেতার ভাষণের পরপরই ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে কয়েকটি প্রতিবাদ মিছিল বের হয়। অন্যদিকে, রাওয়ালপিন্ডিতে পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ভাষণকে স্বাগত জানান। একাত্তরের এই দিনের আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি নিয়ে লেখক রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী তার 'একাত্তরের দশ মাস' বইয়ে উলেস্নখ করেছেন- হরতাল পালনে ষষ্ঠ দিনের মতো সর্বস্তরের জনতা নেমে আসে ঢাকার রাস্তায়। শান্তিপূর্ণ হরতাল পালন শেষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে বেলা আড়াইটা থেকে বিকাল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংক এবং যেসব বেসরকারি অফিসে আগে বেতন দেওয়া হয়নি, সেসব অফিস খোলা রাখা হয়। তিনি লিখেছেন, এদিন বেলা ১১টায় ঢাকা সেন্ট্রাল জেল গেট ভেঙে ৩৪১ জন কারাবন্দি পলায়ন করে। এ সময় পুলিশের গুলিতে ৭ জন নিহত এবং ৩০ জন আহত হন। রাজশাহীতে মিছিলকারীদের ওপর গুলি চলে, সেখানে অন্তত ১ জন নিহত হন। খুলনায় সংঘর্ষ আর গুলিতে ১৮ জন নিহত, ৮৬ জন আহত হন। একাত্তরের এ দিন লাহোরে কাউন্সিল মুসলিম লীগ নেতা এয়ার মার্শাল নূর খান এক সাক্ষাৎকারে বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের দেশ শাসনের বৈধ অধিকার রয়েছে। ক্ষমতা হস্তান্তরের সব বাধা অবিলম্বে দূর করতে হবে। প্রেসিডেন্টের বেতার ভাষণে পরিস্থিতি অবনতির জন্য শেখ মুজিবকে দোষারোপ করায় তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন। এদিন প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিযুক্ত করেন। এদিকে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম জানান, ভারতের ওপর দিয়ে পাকিস্তানের বিমান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা অব্যাহত থাকবে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের বেতার ভাষণের পর বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক শাখার ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য জরুরি বৈঠকে মিলিত হন। কয়েক ঘণ্টার সেই রুদ্ধদ্বার বৈঠকে প্রেসিডেন্টের বেতার ভাষণের আলোকে দেশের সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। অন্যদিকে, প্রায় চার লাখ লোকের বিশাল এক গণবাহিনী যশোরে পাক বাহিনীর ওপর আক্রমণ করে। এই অভূতপূর্ব আক্রমণে ভীতসন্তস্ত্র পাকিস্তানি বাহিনী পালিয়ে ক্যান্টনমেন্টের ভেতর ঢুকে পড়ে। এদিন বহু পাকিস্তানি সেনা এবং বিহারির লুটতরাজ জনতার হাতে ধরা পড়ে নিহত হন বলে রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী তার 'একাত্তরের দশ মাস' বইয়ে উলেস্নখ করেছেন। এ বইয়ে তিনি আরও লিখেছেন, এদিন ছাত্রলীগ ও ডাকসু নেতারা এক বিবৃতিতে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দান থেকে সরাসরি বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বাংলাদেশের সব বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারের দাবি জানান। এদিন অলি আহাদের সভাপতিত্বে পল্টন ময়দানে জনসভা এবং মোজাফফর আহমেদের সভাপতিত্বে গণসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া, সাংবাদিক ইউনিয়ন, শিক্ষক সমিতি, মহিলা পরিষদ, ছাত্র ইউনিয়ন, শ্রমিক ইউনিয়ন, শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল, প্রতিবাদ সভা ও বিক্ষোভ মিছিল করে। সন্ধ্যায় ছাত্রলীগ শহরে বিশাল মিছিল করে। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম তার 'একাত্তরের দিনগুলি' গ্রন্থে ১৯৭১ সালের ৬ মার্চ নিয়ে লিখেছেন, 'আগামীকাল রেসকোর্সে গণজমায়েতে শেখ সাহেব কী বলবেন, তা নিয়েও লোকজনের জল্পনা-কল্পনার অবধি নেই। ১ তারিখে হোটেল পূর্বাণীতে তিনি বলেছিলেন, বাংলার মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার অর্জনের কর্মসূচির ঘোষণা তিনি ৭ তারিখে দেবেন। কিন্তু এ ক'দিনে ঘটনা তো অন্য খাতে বইছে। এত মিছিল, মিটিং, প্রতিবাদ, কারফিউ ভঙ্গ, গুলিতে শত শত লোক নিহতের পরিপ্রেক্ষিতে শেখ সাহেব আগামীকাল কী ঘোষণা দেবেন? কেউ বলছে, উনি আগামীকাল স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন। কেউ বলছে, দূর, তা কী করে হবে? উনি নির্বাচনে জিতে গণপ্রতিনিধি, মেজরিটি পার্টির লিডার। উনি দাবির জোরে সরকার গঠন করবেন, স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করবেন। এখন স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে সেটা তো রাষ্ট্রদ্রোহিতার পর্যায়ে পড়বে। কেউ বলছে, আগামীকাল মিটিংয়ের ব্যাপারে ভয় পেয়ে ইয়াহিয়া আজ ভাষণ দিচ্ছে।' শেখ মুজিবের পূর্ব ঘোষিত ৬ তারিখের আন্দোলন শেষে আগামীকাল রেসকোর্স ময়দানে তিনি কী ঘোষণা দেবেন, তা জানতে বাংলার মুক্তিকামী জনতা অধীর আগ্রহে ছিলেন। তথ্যসূত্র : একাত্তরের দশ মাস, রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী, গতিধারা ১৯৯৭, ঢাকা; বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র: দ্বিতীয় খন্ড, পৃ. ৬৬৬-৬৮।