তিতাসের বিতরণ লাইনের ৬৫ শতাংশ ঝুঁকিপূর্ণ

তবুও টনক নড়ছে না কারো

প্রকাশ | ১০ মার্চ ২০২৫, ০০:০০

সাখাওয়াত হোসেন
ঘর থেকে পথ- সবখানেই মৃতু্যফাঁদ। গ্যাসের জরাজীর্ণ লাইন, অরক্ষিত ও ঝুঁকিপূর্ণ সংযোগের কারণে ঘটছে একের পর এক গ্যাস দূর্ঘটনা। দীর্ঘ হচ্ছে মৃতু্যর মিছিল। নষ্ট হচ্ছে কোটি কোটি টাকার সম্পদ। ভয়াবহ ঝুঁকিতে শত শত কলকারখানা। অথচ অরক্ষিত ও ঝুঁকিপূর্ণ সংযোগ বিচ্ছিন্ন এবং জরাজীর্ণ লাইন পুনঃস্থাপনের উদ্যোগ নেই কোনো। রহস্যজনক কারণে এ ব্যাপারে টনকও নড়ছে না কারো। তথ্য বলছে, দেশের ৬৫ শতাংশ গ্যাস বিতরণ লাইনই ঝুঁকিপূর্ণ। স্থাপিত লাইনের অর্ধেকের মেয়াদ পেরিয়েছে বহু আগে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অবৈধ সংযোগ ও লাইন স্থাপন, যা গ্যাস নেটওয়ার্ককে করে তুলেছে অনিরাপদ। ফলে একের পর এক ঘটছে দুর্ঘটনা। সর্বশেষ রোববার ভোরে চাঁদপুরে গ্যাস বিস্ফোরণে একই পরিবারের ছয় জন দগ্ধ হন। এদের মধ্যে চারজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাদের শরীরের ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ পুড়ে গেছে। গ্যাস লাইন লিকেজ থেকে এ বিস্ফোরণ হয় বলে জানান স্থানীয়রা। এর আগে গত ৩ মার্চ নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে একটি বাসায় গ্যাসের লাইন লিকেজ থেকে বিস্ফোরণে দু'টি পরিবারের নারী ও শিশুসহ ৮ জন দগ্ধ হন। গতকাল রোববার পর্যন্ত এদের মধ্যে দু'জন মারা গেছে। গত ১১ নভেম্বর রাতে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও উপজেলায় রাস্তায় গ্যাসের মেইন লাইনের লিকেজ থেকে বিস্ফোরণে সাত শ্রমিক দগ্ধ হন। দগ্ধদের মধ্যে পাঁচজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪ সালে গ্যাস লিকেজ থেকে ১১৮টি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। এছাড়া, গ্যাস সিলিন্ডার লিকেজ থেকে ১৬টি অগ্নিকান্ড ও ৫টি সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে বলে তারা তথ্য পেয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালের ৪ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জের তলস্না জামে মসজিদে জমে থাকা গ্যাস থেকে বিস্ফোরণে দগ্ধ হয়ে প্রাণ হারান ৩৪ মুসলিস্ন। বিস্ফোরণের এমন ভয়াবহতা ও প্রাণহানির পর জেলাজুড়ে তিতাস গ্যাস পাইপ সংস্কারের তোড়জোড় শুরু হয়। নেওয়া হয় নানা পরিকল্পনা। তবে এর প্রায় কোনোটিই বাস্তবায়িত হয়নি। যদিও তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ এর দায় পুরোপুরি নিজেদের ঘাড়ে নিতে চাননি। তাদের ভাষ্য, গ্যাস লাইনের সংস্কার করতে গেলেই অবৈধ সংযোগ নেওয়া গ্রাহকরা তাতে বাধা সৃষ্টি করেন। কেননা লাইন সংস্কার হলেই অবৈধ সংযোগ চিহ্নিত হবে এবং তিতাস কর্তৃপক্ষ তা বন্ধ করে দেবে। সংশ্লিষ্টরা জানান, গত বছরের ১৫ জানুয়ারি গজারিয়ার বালুয়াকান্দি ইউনিয়নের তেতৈতলা এলাকায় গ্যাস লাইন সংস্কার করতে গিয়ে স্থানীয়দের তোপের মুখে পড়েন তিতাস কর্মকর্তারা। স্থানীয় মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে লোকজন জড়ো করা হয়, তাদের বাধার মুখে কাজ বন্ধ করতে বাধ্য হন কর্মকর্তারা। তিতাস কর্তৃপক্ষ জানায়, ওইদিন তারা মূলত চেক ভালব স্থাপন করতে গিয়েছিল। চেক ভালব মূলত একটি স্বয়ংক্রিয় সুরক্ষা ডিভাইস। এর মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট এলাকার গ্যাস সংযোগ বন্ধ করা, গ্যাসের প্রবাহ একটি নির্দিষ্ট দিকে রাখাসহ অনেক রকমের কাজ করা যায়। সমগ্র গজারিয়া উপজেলার অন্তত চারটি স্থানে এ রকম চেক ভালব স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল। এটি ছিল প্রথম। কিন্তু উত্তেজিত জনতার মারমুখী ভূমিকায় তারা এ কাজ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন। বিশেষজ্ঞরা জানান, ঢাকা ও এর আশপাশে নরসিংদী, মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, শেরপুর, জামালপুর এবং কিশোরগঞ্জে মূলত তিতাসের পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহ করা হয়। এসব পাইপলাইনের প্রায় ৬০ শতাংশেরই মেয়াদ ২০ বছর আগেই পেরিয়ে গেছে। তারপরও তিতাস বা সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই। অথচ সত্তরের দশকে বসানো পাইপলাইনগুলোর টেকনিক্যাল লাইফ ধরা হয়েছিল ৩০ থেকে ৩৫ বছর। এই সময়ের মধ্যেই পাইপগুলো পুরোপুরি বদলে ফেলার কথা। কিন্তু পাইপগুলোর বয়স এরইমধ্যে ৩০ থেকে ৫৫ বছরের পুরনো হয়ে গেলেও তা পাল্টানো হয়নি। এমনকি কোনো লাইন মেরামতও করা হচ্ছে না বলে জানান বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কেমিকৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন। তার মতে, আজও মেয়াদোত্তীর্ণ পাইপলাইন ব্যবহারের কারণে গ্যাসের সরবরাহ লাইনে, না হলে এর সংযোগস্থলে ছিদ্র হয়ে যাচ্ছে- যা থেকে গ্যাস বেরিয়ে দুর্ঘটনার ঝুঁকি তৈরি করছে। আবার লিকেজ না থাকলেও পুরনো পাইপলাইন বিস্ফোরণের আশঙ্কা ছিল বলে জানান তিনি। এই বিশেষজ্ঞের ভাষ্য, প্রতিটি পাইপলাইনে নির্দিষ্ট চাপ পর্যন্ত গ্যাস সঞ্চালনের ক্যাপাসিটি থাকে। কিন্তু সেই চাপের সীমা অতিক্রম হলে পুরো পাইপলাইন আগুন ছাড়াই বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। মাটির নিচে পুরনো পাইপলাইনে এই ঝুঁঁকি সবচেয়ে বেশি। সুতরাং লিকেজ মেরামত করা যতটা জরুরি, গ্যাসের চাপ নিয়ন্ত্রণ করাও ঠিক ততটা জরুরি। তিতাসের সবশেষ জরিপ অনুসারে তাদের মোট পাইপলাইন রয়েছে ১৩ হাজার ৩২০ কিলোমিটার জুড়ে। এরমধ্যে অর্ধেকেরও বেশি রয়েছে ঢাকা মহানগরীতে। ২০২৩-২৪ অর্থবছর ঢাকার এক হাজার ৬৮২ কিলোমিটার পাইপলাইনের মান পরীক্ষা করে ৪৫৯টি ছিদ্র পাওয়ার কথা জানায় তিতাস। পরে সেগুলো মেরামত করা হয়। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুরো পাইপলাইন নিয়ে জরিপ করা হলে আরও অনেক ছিদ্র পাওয়া যাবে। বিশেষজ্ঞরা জানান, মাটির চাপ, তাপ, ক্ষার, লবণ, ঝড়-বৃষ্টি, সেইসঙ্গে নানা ধরনের আঘাতের কারণে পাইপগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেক সময় মরিচা পড়ে লিকেজ দেখা দেয়। এছাড়া, বহু বছর আগে বসানো এই লাইনের ওপরেই রাস্তা নির্মাণের কাজ চলেছে, চলছে ভারী যান। একই পথে টানা হয়েছে বিদু্যৎ, পানি, ইন্টারনেটসহ অন্যান্য ইউটিলিটি লাইন- যা গ্যাসের সরবরাহ লাইনকে ঝুঁঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। আবার অবৈধ সংযোগ নিতে পাইপলাইনে ছিদ্র করায় সেইসঙ্গে মাটির ওপরে লাইনগুলো সুরক্ষিত না করায় সরবরাহ লাইনের অবস্থা জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। এদিকে গ্যাস সরবরাহ লাইনে বিভিন্ন কারণে তৈরি হওয়া এসব ছিদ্র খুঁজে বের করতে উন্নত দেশে বিশেষ যন্ত্র ব্যবহার করা হয়, আবার কোথাও গ্যাসের চাপ হঠাৎ কমে বা বেড়ে গেলে সেটাও স্বয়ংক্রিয়ভাবে শনাক্ত করা যায়। এতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এমন কোনো ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। এছাড়া, ঢাকা শহরে জালের মতো ছড়িয়ে থাকা গ্যাস পাইপলাইনের ও সংযোগের পরিপূর্ণ কোনো ম্যাপ বা জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সিস্টেমও সরকারের কাছে নেই। ফলে পাইপলাইনের অবস্থান জানা না থাকায় বিভিন্ন সংস্থা কাজ করতে গিয়ে প্রায়ই তিতাসের পাইপলাইনে ছিদ্র তৈরি হচ্ছে। এটি গ্যাসের নেটওয়ার্ককে ঝুঁঁকিপূর্ণ করে তুলছে। অন্যদিকে, গ্যাস বিপণন নিয়মাবলি-২০১৪ অনুযায়ী, আবাসিক খাতে মিটার ছাড়া গ্রাহকদের ক্ষেত্রে দুই বছরে একবার এবং মিটার ব্যবহারকারী গ্রাহকদের বাসায় বছরে একবার পরিদর্শনে যাওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে না। তিতাস মূলত কাজ করে অভিযোগের ভিত্তিতে। ফলে বাসাবাড়ির পাইপলাইন লিকেজে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। অথচ তিতাস কর্তৃপক্ষের আবাসিক, বাণিজ্যিক ও শিল্পকারখানার গ্যাস পাইপলাইন নিয়মিত তদারকি ও রক্ষণাবেক্ষণ করার কথা। অথচ লাইনগুলো বসানোর পর আর কোনো রুটিন মাফিক তদারকি হচ্ছে না। আবার যে হারে অবৈধ সংযোগ হয়েছে সেটার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। গ্যাস সংযোগের কোনো ডাটাবেস না থাকায় সরকার কোনো পরিকল্পনাও করতে পারছে না। তিতাস কর্তৃপক্ষ এসব অনিয়মের দায় স্বীকার না করলেও পেট্রোবাংলার সাবেক একজন চেয়ারম্যান নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তিতাসের ৭০ শতাংশ পাইপলাইনই ঝুঁঁকিপূর্ণ। এগুলোর অধিকাংশের মেয়াদ পেরিয়ে গেছে অনেক আগেই। চট্টগ্রাম ও কুমিলস্নার বিতরণ ব্যবস্থার অবস্থাও নাজুক। গ্যাস পাইপলাইনের তেমন রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় না। বিতরণ কোম্পানিগুলো তাকিয়ে থাকে প্রজেক্টের দিকে। এছাড়া, ২০১০ সাল থেকে গ্যাস সংযোগ বন্ধ থাকায় বেড়েছে অবৈধ সংযোগের পরিমাণ। সরকারও বাসাবাড়িতে গ্যাস সংযোগকে নিরুৎসাহিত করছে। এসব কারণে দীর্ঘদিন থেকে বিতরণ নেটওয়ার্কের দিকে নজর কম। ফলে ঝুঁঁকি আরও বেড়েছে। তিতাসের সাবেক একজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুসারে গ্যাস পাইপলাইনে এক ধরনের গন্ধযুক্ত রাসায়নিক মেশানো হয়, যাতে কোথাও লিকেজ হলে গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে এবং সাবধান হওয়া যায়। এখন সম্ভবত এই কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। তিনি বলেন, কোথাও লিকেজ থেকে গ্যাস বেরিয়ে এসে যদি কোনো বদ্ধ জায়গায় জমা হতে হতে তার পরিমাণ বাতাসে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ হয়, তাহলে আগুন ধরার পরিবর্তে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। এর পরিমাণ ২০ শতাংশ পেরোলে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। ওই ব্যবস্থাপনা পরিচালকের ভাষ্য, ঢাকায় চাইলেও ঝুঁঁকিপূর্ণ গ্যাসলাইন পুরোপুরি পাল্টানো খুবই দুরূহ কাজ। কারণ এত দীর্ঘদিন ধরে গড়ে উঠা সিস্টেম একবারে পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। আবার অনেক এলাকায় স্থাপিত লাইনের ওপর রাস্তা কয়েকগুণ উঁচু হয়েছে। আর এই বিপুল পরিমাণ লাইন প্রতিস্থাপন অর্থনৈতিকভাবেও লাভজনক নয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম তামিম বলেছেন, ঢাকা শহরে তিতাসের যেসব বিতরণ লাইন আছে, সেগুলো ৫০ থেকে ৬০ বছরের পুরনো। সেটা জেনেও তিতাস তাদের গ্যাস সঞ্চালন লাইন সংস্কার করে না। তাদের অবহেলা ও অদক্ষতার কারণে এসব দুর্ঘটনা ঘটেছে। ভূমিকম্পসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে গ্যাস পস্ন্যান্ট বিস্ফোরণ হয়ে সামনে যে বিপদ ঘটবে, সেটা আমাদের কল্পনার বাইরে। তিতাসের উচিত নাগরিক নিরাপত্তার কথা ভেবে সরবরাহ লাইন জরুরি ভিত্তিতে সংস্কার করা।