ধর্ষণের প্রতিবাদে উত্তাল ঢাবি

রাবি, শাবি ও কুবিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ ক্লাস পরীক্ষা বর্জন

প্রকাশ | ১০ মার্চ ২০২৫, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে সকল ধর্ষকের সর্বো”চ শাস্তির দাবিতে রোববার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা লাঠি মিছিল করে -ফোকাস বাংলা

ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি এবং নারীর প্রতি সহিংসতার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা রোববার বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি, লোকপ্রশাসন, বাংলা, প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগ এবং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক এই বিক্ষোভে অংশ নিয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে বিক্ষোভ করেছেন। এদিন দুপুর পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এসব বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। দুপুর ১২টার দিকে ধর্ষকদের প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন করে মুখে লাল কাপড় বেঁধে প্রতিবাদ করতে দেখা গেছে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রীদের। এ সময় তাঁরা 'আমার সোনার বাংলায়, ধর্ষকদের ঠাঁই নাই', 'সারা বাংলায় খবর দে, ধর্ষকদের ফাঁসি দে', 'হ্যাং দ্য রেপিস্ট, উই ওয়ান্ট জাস্টিস' স্স্নোগান দেন। সমাবেশে শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ করা না পর্যন্ত ধর্ষকদের কেন বিচার শুরু হয় না, তা জানতে চান। অন্তর্বর্তী সরকার দলীয় সরকার না হওয়া সত্ত্বেও ধর্ষকদের শাস্তির ব্যবস্থা কেন করতে পারছে না, তা জানতে চান। শিক্ষার্থীরা বলেন, 'প্রত্যেক ধর্ষিত বোনের পাশে আমরা আছি। তাদের ধর্ষণের বিচারের জন্য আমরা রাস্তায় নামব।' ঢামেকের অধ্যাপক আবদুল ওয়াহাব তার বক্তব্যে বলেন, যারা ধর্ষণ করে এবং যারা এদের মদদ দেয়, তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। এর আগে আওয়ামী লীগের ছত্রছায়ায় ধর্ষণের সেঞ্চুরি করা হয়েছে। ধর্ষকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানান তিনি। এর আগে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে অপরাজেয় বাংলায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সমাবেশ করে। সমাবেশে বক্তব্য দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরিন, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফা প্রমুখ। সংহতি জানিয়ে উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের নেতারাও। প্রতিবাদ সমাবেশে অধ্যাপক গীতি আরা নাসরিন বলেন, '২০০৫ সালে পূজার যৌনাঙ্গ বেস্নড দিয়ে কেটে তাকে যে ধর্ষণ করা হয়েছিল, যে করেছিল, সে কিন্তু এখন জেল থেকে বের হয়ে গেছে। তার মানে আমরা দেখছি, নির্যাতন শুধু ঘটতে দেওয়া হচ্ছেই না, যাদের এটা থামানোর কথা, তারা চোখ বন্ধ করে আছে।' বেলা সাড়ে ১১টা থেকেই বিক্ষোভ মিছিল করছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নেটওয়ার্কের প্রতিবাদ সমাবেশের পর দুপুর সাড়ে বারোটার দিকে তাঁরা অপরাজেয় বাংলায় বিক্ষোভ সমাবেশ করেন। সেখানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করেন। একই দাবিতে তখন বিক্ষোভ মিছিল করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থীরাও। এ ছাড়া কাছাকাছি সময়ে রাজু ভাস্কর্যের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগ। এ ছাড়া বেলা সাড়ে এগারোটার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ সারা দেশে নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে কার্জন হলের সামনে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ কর্মসূচি করেছে প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিভাগ। ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরাও বিক্ষোভ করেন। নর্থ সাউথ ও ইনডিপেনডেন্টে বিক্ষোভ এদিকে দেশে ধর্ষণ প্রতিরোধে দ্রম্নত বিচার ট্রাইবু্যনাল করে ধর্ষকদের শাস্তি নিশ্চিত করার দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি (এনএসইউ) ও ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের (আইইউবি) শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিয়ে প্রতিবাদ সমাবেশ করে। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক শর্মি হোসেন ও নোভা আহমেদ এতে নেতৃত্ব দেন। এনএসইউর আট নম্বর গেট থেকে শুরু হয়ে আইইউবির সামনে দিয়ে ঘুরে আবারও এনএসইউর সামনে এসে সমাবেশটি শেষ হয়। সমাবেশে শর্মি হোসেন নারীর প্রশ্নে বর্তমান সরকারের অবস্থান জানতে চান। পাশাপাশি ধর্ষণ প্রতিরোধে দ্রম্নত বিচার ট্রাইবু্যনাল গঠনের দাবি জানান তিনি। সমাবেশে থাকা নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী হাসিবুল হোসেন শান্ত বলেন, 'আমরা নিরাপদ বাংলাদেশ চাই। ধর্ষণের বিচার এক মাসের মধ্যে হচ্ছে, এমন দেখতে চাই।' রাবি শিক্ষার্থীদের মহাসড়ক অবরোধ রাজশাহী অফিস জানায়, দেশের বিভিন্ন স্থানে ধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। রোববার বেলা সাড়ে ১১টা থেকে ঘণ্টাব্যাপি বিক্ষোভকালে তারা বিশেষ ট্রাইবু্যনাল গঠন করে ধর্ষণের ঘটনায় সর্বোচ্চ বিচার নিশ্চিত করার দাবি জানান। একই সঙ্গে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনসহ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন তারা। এছাড়াও ক্যাম্পাসে প্রতিবাদ সমাবেশ করে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। বুদ্ধিজীবী চত্বরে এ প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করা হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রোববার বেলা ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল ও অ্যাকাডেমিক ভবন থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন শিক্ষার্থীরা। তারা মিছিল নিয়ে প্যারিস রোডে জড়ো হয়। পরে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকের সামনের মহাসড়কে যান। সাড়ে ১২টার পর্যন্ত তারা মহাসড়কের অবস্থান নয়। মহাসড়ক অবরোধকালে 'ফাঁসি ফাঁসি ফাঁসি চাই, দর্শকের ফাঁসি চাই', 'আমার সোনার বাংলায়, ধর্ষকের ঠাঁই না ', 'ইনকিলাব ইনকিলাব, জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ', 'ধর্ষকদের ঠিকানা, এই বাংলায় হবে না', 'ধর্ষকদের শাস্তি, মৃতু্য! মৃতু্য!', 'তুমি কে আমি কে, আছিয়া, আছিয়া' ইত্যাদি স্স্নোগানে মুখরিত হয় চারপাশ। আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া হিসাব বিজ্ঞান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী সাদিয়া আফরিন বলেন, 'একটার পর একটা ধর্ষণ হয়ে যাচ্ছে। কুমিলস্নার তনু থেকে শুরু করে আজকে আছিয়ার ধর্ষণ; কিন্তু আমরা কোনো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেখতে পাইনি। আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের কোনো সরকার বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ধর্ষকের পরিপূর্ণ শাস্তি কার্যকর করতে পারেনি। এটা সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চরম ব্যর্থতা। আমি এই ইন্টেরিম গভর্নমেন্টকে বলে দিতে চাই আপনারা যদি ধর্ষকের শাস্তি দিতে না পারেন তাদের জনগণের হাতে ছেড়ে দেন। আমার মা বোনেরা ধর্ষকের শাস্তি নিশ্চিত করবে।' আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া আরেকজন সালাউদ্দিন আম্মার বলেন, 'নারীদের নিরাপত্তা ও ধর্ষকদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এ দাবি যতদিন পূরণ হবে না ততদিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনসহ আন্দোলন চলমান থাকবে।' এসময় আজ সোমবার বেলা ১১টায় বিক্ষোভ কর্মসূচির ঘোষণা দেন তিনি। মধ্যরাতে উত্তাল শাবি শাবি প্রতিনিধি জানান, মাগুরায় আট বছর বয়সী আছিয়াসহ সারাদেশে সংঘঠিত ধর্ষনের ঘটনায় ধর্ষকদের ফাঁসির দাবিতে মধ্যরাতে উত্তাল হয়ে ওঠে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। রোববার প্রথম প্রহরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হল থেকে শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে গোলচত্বরে এসে সমবেত হন। এসময় শিক্ষার্থীরা 'তুমি কে? আমি কে? আছিয়া, আছিয়া'; 'একটা একটা ধর্ষক ধর, ধইরা ধইরা জবাই কর', 'জেগেছে রে জেগেছে বাঘিনীরা জেগেছে', 'ফাঁসি ফাঁসি, ফাঁসি চাই, ধর্ষকের ফাঁসি চাই', 'ধর্ষকের শাস্তি মৃতু্য মৃতু্য', 'ধর্ষকের ঠিকানা, এই বাংলাদেশে হবে না' স্স্নোগান দেন। এসময় সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বক্তারা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর পদত্যাগ দাবি করেন। ধর্ষকদের বিচারের জন্য বিশেষ ট্রাইবুনাল গঠনের দাবিও জানান বক্তারা। কুবিতে মানববন্ধন কুবি প্রতিনিধি জানান, সারাদেশে সাম্প্রতিক ধর্ষণের বিরুদ্ধে মানববন্ধন করেছে কুমিলস্না বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। রোববার বেলা একটায় বিশ্ববিদ্যালয়ের গোল চত্বরে এই মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মারুফ শেখ এবং আরাফ ভূঁইয়ার সঞ্চালনায় এ মানববন্ধনে শিক্ষকরাও সংহতি প্রকাশ করেন। বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. কামরুন নাহার শীলা, সহযোগী অধ্যাপক ড. নাহিদা বেগম, নৃবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. শামীমা নাসরিন, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান (ভারপ্রাপ্ত) সহকারী অধ্যাপক মাহমুদুল হাসানসহ অন্যান্য শিক্ষকরাও এসময় উপস্থিত ছিলেন। 'দিয়েছি তো রক্ত আরও দেব রক্ত', ধর্ষকের ঠিকানা, এই বাংলায় হবে না', 'একটা একটা ধর্ষক ধর, ধইরা ধইরা জবাই কর', 'আবু সাঈদের বাংলায় ধর্ষকের ঠাঁই নাই', 'চব্বিশের বাংলায় ধর্ষকের ঠাঁই নাই'-সহ বিভিন্ন স্স্নোগান দেন তারা। রসায়ন বিভাগের শিক্ষার্থী জুলফা আক্তার বলেন, 'আমরা সবাই আছিয়ার ধর্ষণের কাহিনি জানি। এমন অনেক ধর্ষণ হয় যার খবর আমরা জানি না। আমাদের সামনে আসে না, অনেকে ভয়ে প্রকাশ করে না। এভাবে ধর্ষণ বাড়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে ধর্ষকদের উপযুক্ত সাজা না হওয়া। ১০ হাজার ২০ হাজার টাকা দিয়ে, হুমকি-ধামকি দিয়ে তারা আবার মুক্ত আকাশের নিচে ঘুরে বেড়ায়। আমাদের দাবি, আমরা ধর্ষকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই, প্রকাশ্যে এনে যেন ফাঁসি দেওয়া হয়। যেন সামনে কোনো ধর্ষক কাউকে ধর্ষণের কথা চিন্তাও না করতে পারে। আমাদের সবাইকে একসঙ্গে মিলে ধর্ষকদের প্রতিহত করতে হবে।' বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. কামরুন নাহার শীলা বলেন, 'গভীর শোক এবং প্রতিবাদের ভাষাকে একত্র করার জন্য আজকে আমরা এখানে জড়ো হয়েছি। গত কয়েকদিন ধরে আইনশৃঙ্খলার অবনতির করাল গ্রাসের শিকার হচ্ছে নারীরা। আজকে একটা নারী-শিশুও ধর্ষকের হাত থেকে নিরাপদ না। ছোট শিশু আছিয়া জীবনকে বোঝার আগেই তার জীবনটা শেষ করে দিয়েছে ধর্ষকেরা। এছাড়া ম্যোরাল পুলিশিংয়ের নামে যে নারী হেনস্থা তা কোনোভাবেই কাম্য না। আমরা এই রহস্যের সমাপ্তি চাই। সুন্দর সহিংসতামুক্ত বাংলাদেশ চাই।' গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান (ভারপ্রাপ্ত) মাহমুদুল হাসান বলেন, 'ধর্ষণই একমাত্র অপরাধ যেখানে ভুক্তভোগীকে তার নির্দোষতা প্রমাণ করতে হয়। আমাদের নিকটজনদের মধ্যেই ধর্ষক লুকিয়ে থাকে। তাই ছোটবেলা থেকে নারীদেরকে ধর্ষকের ব্যাপারে সচেতন করতে হবে। দ্রম্নততম সময়ের মধ্যে ধর্ষকের বিচার নিশ্চিত করে বাংলাদেশকে ধর্ষকমুক্ত করতে হবে।'