রাঁধুনীর ধনিয়ার গুঁড়া ও প্রাণের গুঁড়া মশলার দুটি মোড়ক
সাখাওয়াত হোসেন
শিল-নোড়ায় বাটা মসলা এবং প্যাকেটজাত মসলা দিয়ে তৈরি খাবারের স্বাদে তারতম্য হওয়ার তর্কটা বেশ পুরনো। তবে সময় ও পরিশ্রম সাশ্রয় করে দ্রম্নত রান্নার জন্য প্যাকেট মসলার বিকল্প কিছু এতদিন চিন্তা করেননি রাঁধুনিরাই। ফলশ্রম্নতিতে কয়েক বছরের ব্যবধানে ব্যাপক আকার ধারণ করেছে প্যাকেটজাত ব্র্যান্ডেড গুঁড়া মসলার বাজার। খাবারে স্বাদ ও ঘ্রাণে বৈচিত্র্য আনতে আমদানি করা গরম মসলার চাহিদাও এ সময়ে বেড়েছে দ্রম্নতগতিতে। বাংলাদেশ অ্যাগ্রো-বেইজড প্রোডাক্ট প্রডিউসারস অ্যান্ড মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরো (বিবিএস), কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই), বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য এবং বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের গবেষণা প্রতিবেদন পর্যালোচনা করা দেখা গেছে, বিগত বছরগুলোতে প্যাকেটজাত গুঁড়া মসলার ব্যবহার ১০ থেকে ১২ শতাংশ হারে বেড়ে দেশে মসলার বাজারের আকার প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকায় এসে দাঁড়িয়েছে।
তবে সম্প্রতি স্কয়ার ও প্রাণের মতো ব্রান্ডেড কোম্পানির গুঁড়া মসলায় ভেজাল এবং ক্ষতিকর উপাদান মিশ্রণের কারণে বিএসটিআই কর্তৃপক্ষ তাদের বেশ কয়েকটি পণ্য নিষিদ্ধ ঘোষণা এবং প্যাকেটজাত রিফাইন্ড বিভিন্ন খাদ্যে ক্যানসারসহ বিভিন্ন রোগব্যধিতে আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় অনেকটা হঠাৎ করেই সে চিত্র পাল্টে যেতে শুরু করেছেন। সচেতন ভোক্তারা অনেকেই এরইমধ্যে প্যাকেটজাত মসলার গুঁড়া কেনা একরকম বন্ধ করে দিয়েছেন। তাদের অনেকেই সেই পুরান আমলের শিল-নোড়া খুঁজে বের করে তাতে মসলা বেটে খাওয়া শুরু করেছেন। কেউ কেউ আবার হলুদ-মরিচ-ধনিয়া কিনে তা মিলে ভাঙিয়ে নিচ্ছেন। এতে মসলার বাজারের ঊর্ধ্বগতির ধারায় বড় ধরনের ধস নেমেছেন।
ভোক্তারা জানান, শুধু গুঁড়া মসলাই নয়, অনেকে এখন প্যাকেটজাত আটা-ময়দা-সুজি, লবণ, চিনি ও বোতলজাত ভোজ্য তেলসহ অনেক খাদ্যপণ্য কেনা কমিয়ে দিয়েছেন। এর পরিবর্তে তারা মিল থেকে লাল আটা এবং বাজার থেকে লাল চিনি ও রিফাইনিং না হওয়া লবণ কিনছেন। তারা তাদের খাদ্যাভাসে পুরান ধারা ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করছেন।
বাজার সংশ্লিষ্টরা জানান, এক সময় মানুষ আস্ত মসলা, গম, সরিষা কিনে সেগুলো মিল থেকে ভাঙিয়ে নিতেন। তবে মিলের অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ ও ভাঙানোর ঝামেলার কারণে এক পর্যায়ে মানুষ প্রক্রিয়াজাত খাদ্য-পণ্যের দিকে ঝুঁকতে শুরু করেন। ২০০১ সালে স্কয়ার ফুড অ্যান্ড বেভারিজ 'রাঁধুনী' নামে প্রক্রিয়াজাত গুঁড়া মসলা বাজারে আনে। এরও বেশ আগে প্যাকেটজাত আটা-ময়দা ও সুজি বাজারজাত শুরু হয়।
রাজধানীর বিভিন্ন বাজার এবং পাড়া-মহলস্নার দোকানিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সম্প্রতি স্বল্প সময়ের ব্যবধানে প্যাকেট ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্য-পণ্যের ক্রেতা যথেষ্ট কমেছে। এসব ভোক্তাদের একটি বড় অংশ বাজার থেকে আস্ত হলুদ, মরিচ, ধনিয়া ও জিরাসহ বিভিন্ন মসলা; তিল-সরিষা এবং গম কিনে তা মিলে ভাঙিয়ে নিচ্ছেন। তবে উচ্চবিত্তরা অনেকে বিদেশ থেকে আমদানিকৃত প্যাকেট ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্য-পণ্যের দিকে ঝুঁকেছেন। এতে দেশীয় মসলার বাণিজ্যের গতানুগতিক ধারায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে।
পাড়া মহলস্নার মিল মালিকরাও জানান, আগে তারা প্রতিদিন গড়ে ১০ থেকে ১৫ কেজি বিভিন্ন গুড়া মসলা এবং এক থেকে দেড়শ' কেজি আটা বিক্রি করলেও গত কয়েকদিনে তা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতদিন নিম্নবিত্তের মানুষ তাদের প্রধান ক্রেতা থাকলেও এখন নিম্নমধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত, এমনকি উচ্চবিত্তরা মিলে ভিড় জমাচ্ছেন বলে দাবি করেন মিলাররা।
এদিকে চিনির বাজারেও এখন একই ধরনের পরিবর্তনের ঢেউ লেগেছে বলে জানান বাজার সংশ্লিষ্টরা। তাদের ভাষ্য, লালচে ও বাদামি রঙের চিনি স্বাস্থ্যকর হওয়া সত্ত্বেও এতদিন ভুল ধারণা থেকে ভোক্তারা তা এড়িয়ে চলতেন। খুঁজে নিতেন বিট থেকে উৎপাদিত ও বিদেশ থেকে আমদানিকৃত ঝকঝকে, মিহি দানার সাদা চিনি। তবে এ প্রবণতা দ্রম্নত বদলে যেতে শুরু করেছে। সাদা চিনির পরিবর্তে কদর বাড়তে শুরু করেছে অবহেলিত সেই লালচে বা বাদামি চিনির। স্বাস্থ্য সচেতন ক্রেতারা এখন দোকানে গিয়ে আখের চিনি খোঁজ করছেন বলে জানান দোকানিরা।
বাজার সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশে এই আখের চিনি সরবরাহকারী রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান হচ্ছে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প কর্পোরেশন (বিএসএফআইসি) আওতাভুক্ত ১৬টি চিনিকল। আর বিটনির্ভর আমদানিকৃত ও পরিশোধিত চিনি সরবরাহ দিচ্ছে গুটিকয়েক বেসরকারি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। এতদিন বেসরকারি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোই ক্রেতার চাহিদার সিংহভাগ পূরণ করছে। শুধুমাত্র নিম্নবিত্তের মানুষকে লাল চিনি কিনতে দেখা গেছে। পাশাপাশি সরকারি রেশনে এ পণ্য অনেকটা জোর করে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। অথচ গত কয়েক মাসে রাতারাতির এ চিত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে।
চিনি ও খাদ্যশিল্প কর্পোরেশনের একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা বলেন, সময় বদলেছে। ক্রেতা-ভোক্তারা সচেতন হচ্ছেন। তারা ক্ষতিকর বিটনির্ভর চিনির পরিবর্তে আখের চিনিতে ঝুঁকেছেন। এতে রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলোয় উৎপাদিত চিনির ওপর চাপও বাড়ছে। তাই ক্রেতার এই বাড়তি চাপ সামাল দিতে তারা সেভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সারা দেশে নিজস্ব বিক্রয় কেন্দ্র বাড়ানো হচ্ছে। এ ছাড়া ক্রেতার বাড়তি চাহিদার দিকে নজর দিয়ে বিভিন্ন সুপারশপগুলোও এখন লাল চিনি বিক্রি করছে। বাজারে বড় বড় মুদি দোকানগুলোতেও যাতে সারা বছর এই চিনি বিক্রি হয় সেজন্য তাদের সঙ্গে বিএসএফআইসির কথাবার্তা চলছে বলে জানায় বিএসএআইসি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, আখনির্ভর লাল চিনিতে স্বাস্থ্য ঝুঁকি নেই। কিন্তু বিটনির্ভর সাদা চিনিতে স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে। কেননা শিল্প-কারখানা রিফাইনিং (পরিশোধিত) পদ্ধতিতে চিনি তৈরির সময় ভিটামিন, মিনারেল, প্রোটিন, এনজাইম এবং অন্যান্য উপকারী পুষ্টি উপাদান দূর হয়ে যায়। এ চিনি মানবদেহের জন্য খুবই ক্ষতিকর। বিদেশ থেকে আমদানিকৃত চিনি তৈরিতেও সবসময় আখ ব্যবহার করা হয় না। আখের বিকল্প উপাদান দিয়ে চিনি তৈরি হয়। এই চিনিতে মিষ্টতা আনতে বাড়তি রাসায়নিক মেশানো হয়। আর পরিশোধন প্রক্রিয়ায় চিনিতে যুক্ত হয় আরও ক্ষতিকর নানা উপাদান। পরিষ্কার বা সাদা করার জন্য ব্যবহার করা হয় ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান সালফার, হাড়ের গুঁড়া। সম্প্রতি নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণ অভিযান শুরুর পর এসব চিত্র সামনে উঠে আসায় স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ লাল চিনির দিকে ঝুঁকেছে বলে জানান তারা।
বাংলাদেশ খাদ্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ইন্সটিটিউটের পরীক্ষায় দেখা গেছে, আমদানি করা পরিশোধিত এবং দেশে উৎপাদিত পরিশোধিত চিনি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। আখ থেকে উৎপাদিত দেশি চিনিতে ক্যালসিয়ামের মাত্রা ১৬০ দশমিক ৩২, যা পরিশোধিত চিনিতে ১ দশমিক ৫৬ থেকে ২ দশমিক ৬৫ ভাগ। পটাশিয়াম দেশি চিনিতে ১৪২ দশমিক ৯ ভাগ, পরিশোধিত চিনিতে শূন্য দশমিক ৩২ থেকে শূন্য দশমিক ৩৫ ভাগ। ফসফরাস দেশি চিনিতে ২ দশমিক ৫ থেকে ১০ দশমিক ৭৯ ভাগ আর পরিশোধিত চিনিতে ২ দশমিক ৩৫ ভাগ। আয়রন দেশি চিনিতে শূন্য দশমিক ৪২ থেকে ৬ ভাগ আর পরিশোধিত চিনিতে শূন্য দশমিক ৪৭ ভাগ। ম্যাগনেশিয়াম দেশি চিনিতে শূন্য দশমিক ১৫ থেকে ৩ দশমিক ৮৬ ভাগ আর পরিশোধিত চিনিতে শূন্য দশমিক ৬৬ থেকে ১ দশমিক ২১ ভাগ। সোডিয়াম দেশি চিনিতে শূন্য দশমিক ৬ ভাগ, আর পরিশোধিত চিনিতে শূন্য দশমিক ২ ভাগ।
এদিকে গত কয়েক বছরে প্যাকেটজাত আটা-ময়দা এবং ঝকঝকে চালে ভোক্তার আগ্রহ বাড়লেও সম্প্রতি তা কমতে শুরু করেছে। স্বাস্থ্য সচেতনদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষ এখন আগের মতো অনুজ্জ্বল-সাদামাঠা চালের দিকে ঝুঁকছে। তবে বাজারে ঢেঁকিছাঁটা চাল দুঃষ্প্রাপ্য হওয়ায় অনেকে নিজের মতো করে গ্রামের আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে মিলে ভাঙানো চাল কিনতে শুরু করেছে। বিশেষ করে ডায়েবেটিক ও হৃদরোগে আক্রান্ত মানুষ এদিকে বেশি নজর দিচ্ছে। কেননা বাজারে সহজলভ্য চকচকে যে চাল পাওয়া যাচ্ছে, তা মূলত চালের উপরস্তরের লাল আবরণ (মেমব্রেন) ছেঁটে ফেলা। অথচ চালের এই লাল আবরণেই থাকে মূল্যবান খাদ্যপ্রাণ ওমেগা ৩ ও ৬। থাকে 'অ্যান্টি অক্সিডেন্ট' যা শরীরের ক্ষতিকর কোলেস্টেরলকে তাড়িয়ে উপকারি কোলেস্টরলের জন্য জায়গা করে দেয়ার পাশাপাশি হৃদপিন্ডকে সুস্থ রাখতে ভূমিকা রাখে। এটি শরীরের ওজন কমাতেও সাহায্য করে। যে কারণে ঢেঁকিছাঁটা চাল খাওয়া আগের প্রজন্মের মানুষের মধ্যে রোগ-বালাই কম ছিল বলে মনে করেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
এদিকে প্যাকেটজাত রিফাইন্ড আটা-ময়দায় থাকা ক্লোরিন গ্যাস শরীরে ক্যানসার তৈরির অন্যতম উৎস- গবেষণায় এমন তথ্য উঠে আসার পর স্বাস্থ্য সচেতন ভোক্তারা এখন সেদিক থেকে ধীরে ধীরে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। তারা বাজার থেকে লাল গম কিনে স্থানীয় মিলে ভাঙিয়ে আটা তৈরি করছেন। অথবা মিল থেকে খোলা আটা কিনছেন।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গম থেকে আটা উৎপাদন ও পরিশোধনের ফলে প্রায় ১৪ রকমের ভিটামিন, ম্যাগনেসিয়ামসহ ১০ রকমের খনিজ উপাদান ও বিদ্যমান আমিষ নষ্ট হয়ে যায়। অথচ লাল ফাইবারযুক্ত আটা খাওয়ার পর তা ধীরে ধীরে হজম হয় বিধায় রক্তে গস্নুকোজ ধীরে ধীরে বাড়ে। যার ফলে শরীরের প্যানক্রিয়া গ্রন্থি স্বাভাবিকভাবে ইনসুলিন তৈরি করে রক্তের শর্করাকে যথাযথভাবে কোষে পৌঁছাতে পারে। এতে ডায়াবেটিস ও হৃদরোগের মতো জটিল রোগ বালাইয়ের ঝুঁকি থাকে না।