জবাবদিহিতা জরুরি

নজরদারির অভাবে ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসা সেবা

বিভিন্ন জেলা-উপজেলা পর্যায়ের বেশিরভাগ হাসপাতালে চিকিৎসক রোগীদের অস্ত্রোপচার ও প্রেসক্রিপশন লেখা ছাড়া অন্য কোনো কাজ করেন না

প্রকাশ | ১২ জুলাই ২০১৯, ০০:০০

জাহিদ হাসান
সরকারি হাসপাতাল পরিচালনায় ব্যবস্থাপকদের অদক্ষতাকে পুঁজি করে দায়িত্ব পালনে অবহেলা করছেন এক শ্রেণির চিকিৎসক। এতে চিকিৎসাসেবা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলা-উপজেলা পর্যায়ের বেশিরভাগ হাসপাতালে চিকিৎসক রোগীদের অস্ত্রোপচার ও প্রেসক্রিপশন লেখা ছাড়া অন্য কোনো কাজ করেন না। ফলে উন্নত চিকিৎসা নিতে এসেও সহায়ক জনবলের (নার্স-ওয়ার্ডবয়) উপর নির্ভর করতে হয় নিরুপায় রোগীদের। এক্ষেত্রে নার্স-ওয়ার্ডবয়দের অদক্ষতা ও অজ্ঞতায় প্রায় সময় ভুল চিকিৎসায় বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন রোগীরা। রোগীর স্বজনরা অভিযোগ করছেন জেলা-উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্স থেকে শুরু করে সব চিকিৎসাকেন্দ্রেই এমন বিড়ম্বনা চলছে। অনেক হাসপাতালে সার্জারি রোগীর দেহে অ্যানেসথেসিয়া ইনজেকশন পুশ, অস্ত্রোপচার পরবর্তী সেলাই করা, ড্রেসিং ও ব্যান্ডেজ খোলা ছাড়াও রক্তচাপ মাপা, ক্যানোলা লাগানো, অক্সিজেন মাস্ক পারনো, অস্ত্রোপচারের রোগীদের ক্যাথেটার খোলার মতো আনুষঙ্গিক কাজ করছেন নার্স-ওয়ার্ডবয়রা। বিশেষ করে রাতে ও ছুটির দিনগুলোতে দায়িত্বরত ওয়ার্ডমাস্টার বা বয়রা স্পেশাল ওয়ার্ডবয় হিসেবে রোগীর রিপোর্ট পর্যন্ত দেখে থাকেন। এতে করে অনেক সময় ভুল চিকিৎসার শিকার হলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে না। এমন ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে কয়েকটি হাসপাতালের একাধিক চিকিৎসক যায়যায়দিনকে বলেন, মূলত হাসপাতাল পরিচালনা প্রধানের নজরদারির অভাবে, চিকিৎসকদের দায়িত্ব পালনে উদাসীনতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা না থাকায় এমনটা বেশি হচ্ছে। চিকিৎসকদের রাজনৈতিক প্রভাবও এর অন্যতম কারণ। অথচ চিকিৎসাসেবার নিয়ম অনুযায়ী কোনো রোগীর অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হলে ওয়ার্ডবয়রা শুধুমাত্র স্ট্রেচারে করে রোগীকে অস্ত্রোপচার কক্ষে নিয়ে যেতে পারেন। ওটিতে সংশ্লিষ্ট সার্জন, একজন অ্যানেসথেটিস্ট, সহকারী হিসেবে প্রয়োজনীয় সংখ্যক নার্স থাকবেন। তবে নার্স ও ওয়ার্ডবয়রা অস্ত্রোপচার সংক্রান্ত কোনো কাজে (সেলাই, ড্রেসিং) সরাসরি হাত লাগাতে পারবেন না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢামেকের এক অধ্যাপক চিকিৎসক বলেন, ডাক্তাররা আগে খেয়াল-খুশি মতো হাসপাতালে আসতেন। বর্তমানে কর্পোরেট অফিসের মতো সরকারি হাসপাতালে বায়োমেট্রিক চালু হওয়ায় অনেকেই বাইরে যেতে পারছেন না। তার ডক্টরস লাউঞ্জে বসে মোবাইলে গেম খেলা বা ডাক্তারদের নির্ধারিত রুমে খোশ-গল্প মেতে থাকেন। যেখানে রোগীর স্বজন বা নার্সরা সহজে প্রবেশ করতে পারেন না। কেউ কিছু বললে মেডিকেল বিষয়ক জার্নাল নিয়ে পরস্পর গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করছেন জানিয়ে ডক্টরস ক্যান্টিনেও অলস সময় কাটান অনেকে। এতে করে সেবা বঞ্চিত হন রোগীরা। রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিকস (পঙ্গু) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এক রোগীর স্বজন অভিযোগ করেন, তার আহত ভাইকে নিয়ে হাসপাতালে আসার পর চিকিৎসকের উপস্থিতিতেই ভাইয়ের শরীরে রক্ত দেয়ার জন্য হাতে ক্যানোলা পরান এক ওয়ার্ডবয়। কিন্তু ওই ওয়ার্ডবয় কয়েক জায়গায় ছিদ্র করেও ভেইন (শিরা) খুঁজে পাচ্ছিলেন না। ফলে রক্ত দেয়া শেষে ডিউটি ডাক্তারকে বস্নাড ব্যাগ খুলে দিতে বললে তিনি অনেকটা রাগ দেখিয়ে বলেন, এটা নার্স-ওয়ার্ডবয়দের কাজ, তারা করবে। এছাড়া চিকিৎসকদের অবহেলা ও নার্স-ওয়ার্ডবয়দের অজ্ঞতায় গত মে মাসে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থীকে নার্স ভুলক্রমে অ্যানেসথেসিয়ার ইনজেকশন দেন। পরে ওই শিক্ষার্থীর শারীরিক পরিস্থিতির অবনতি হলে দ্রম্নত তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি করা হয়। বর্তমানে ঢামেক বার্ন ইউনিটে অন্তত ৭০ জন কর্মচারী আছেন যারা চিকিৎসাশাস্ত্রে সনদধারী না হয়েও চিকিৎসক, নার্সদের পরিবর্তে চুক্তি ভিত্তিতে প্রতিদিন পোড়া রোগীদের ক্ষত ড্রেসিং করছে। বিষয়টি সম্পর্কে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. আমিনুল হাসানের কাছে জানতে চাইলে তিনি যায়যায়দিনকে বলেন, রোগীদের শতভাগ সেবা নিশ্চিত করতেই হাসপাতালগুলোতে বায়োমেডিট্রক পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। ফলে উপস্থিতির বিষয়টা ঠিকমত হচ্ছে। এখন সেবার মতো মহান পেশা গ্রহণ করে দায়িত্বে অবহেলার বিষয়টি কারো কাছে কাম্য নয়। এসব বন্ধ করতে হাসপাতালের নিয়মিত মনিটরিং কার্যক্রম চলছে। তবে স্থানীয়ভাবে কিছু হাসপাতালে ম্যানেজম্যান্ট দুর্বলতার কারণে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটছে। এ জন্য প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় হাসপাতাল ম্যানেজারের দক্ষতা ও লিডারশিপ ক্যাপাসিটি বৃদ্ধিতে কাজ করা হচ্ছে। এছাড়া হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসক ঘাটতির কারণেও এমনটা হচ্ছে। আগামী দুই মাসের মধ্যে প্রান্তিক পর্যায়ের চিকিৎসাকেন্দ্রগুলোতে আরও ৪ হাজার ৭০০ চিকিৎসক নিয়োগ দেয়া হবে। মনিটরিং ব্যবস্থাও জোরদার করা হবে। তখন এমন সমস্যা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।