ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য জনভোগান্তি চরমে

দায় এড়াচ্ছে বিআরটিএ

প্রকাশ | ১৩ জুলাই ২০১৯, ০০:০০

কিশোর সরকার
মান্নান মিয়া মোহাম্মদপুরে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাইক্রো বাস চালান। ড্রাইভিং লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়েছে জানুয়ারি মাসে। তাই নতুন করে স্মার্ট কার্ড ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য নির্ধারিত ফি জমা দিয়ে আঙুলের ছাপ, ডিজিটাল ছবি ও স্বাক্ষরসহ আনুষঙ্গিক প্রক্রিয়া শেষ করেছেন। প্রথমে তাকে গত ৩ মার্চ নতুন ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়ার তারিখ দেয় বিআরটিএ'র ড্রাইভিং লাইসেন্স সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। কিন্তু নির্ধারিত সময় গেলে তাকে কোনো কিছু না বলেই ২৭ জুন ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়ার নতুন তারিখ লিখে দেন সরবরাহকারী টাইগার আইটির প্রতিনিধিরা। কিন্তু ছুটি না পাওয়ায় ২৭ জুন না গিয়ে মান্নান গত ৯ জুলাই বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) মিরপুর সার্কেলের অফিসে গেলে ফের ২২ সেপ্টেম্বর ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়ার নতুন করে তারিখ দেয় টাইগার আইটি কর্তৃপক্ষ। সম্প্রতি মিরপুর বিআরটিএ'র সার্কেল অফিসের ১২০ নাম্বার কাউন্টারের সামনে দেখা যায়, দীর্ঘ লাইন। লাইনে দাঁড়ানো মান্নান মিয়ার সঙ্গে কথা হয়। এ সময় তিনি আক্ষেপ করে বলেন, গরিব মানুষ, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন, সব সময় চেয়েও ছুটি পান না। তারপরেও দিনের পর দিন ড্রাইভিং লাইসেন্স নবায়নের জন্য বিআরটিএ'র দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হচ্ছে। এভাবে শুধু মান্নানই নয়, গত দেড় থেকে দুই বছরে নবায়ন ও পরীক্ষায় পাস করা লাইসেন্স-প্রত্যাশীরা বিআরটিএতে ঘুরছেন। গত ৭ জুলাই পর্যন্ত সারাদেশে এর সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২১ হাজার ৯৯৬ জনে। আর এতে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়ছে বিদেশ যেতে ইচ্ছুক মানুষজন। তবে সাধারণ মানুষ না পেলেও ভিআইপির নাম দিয়ে দালালদের মাধ্যমে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স পাচ্ছেন অনেকে। আবার অনেকে দালালদের টাকা দিয়ে প্রতারিতও হচ্ছেন। সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, অতীশ দীপঙ্কর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক দিপ্তী রানী দেবনাথ আমেরিকায় যাবেন ডক্টরেট ডিগ্রি করতে। তাই বিদেশে গিয়ে নিজেই যেন নিজের গাড়ি চালাতে পারেন সে জন্য বিআরটিএর নিবন্ধিত একটি স্কুল থেকে নিয়মিত প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার জন্য লিখিত ও প্রাকটিক্যাল পরীক্ষা দিয়ে পাসও করেছেন। গত ১৯ মে তাই উত্তরায় বিআরটিএর সার্কেল অফিসে ছবি তোলা, আঙুলের ছাপ দেয়াসহ আনুষঙ্গিক প্রক্রিয়াও সম্পন্ন করেছেন। তড়িঘড়ি করে লাইসেন্স পাওয়ার জন্য দালালকে ১৫ হাজার টাকাও দিয়েছেন। কিন্তু তাকে ১৫ আগস্ট ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়ার সময় দিয়েছে বিআরটিএ'র লাইসেন্স প্রস্তুতকারী কোম্পনি টাইগার আইটি। অথচ ১৫ জুলাই তার আমেরিকা যাওয়ার ফ্লাইটের তারিখ। ২০ জুলাই আমেরিকার টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের কাছে রিপোর্ট করতে হবে তাকে। তাই নিরুপায় হয়ে গত ৭ জুলাই বিআরটিএ'র মহাখালীর প্রধান কার্যালায় বিভিন্ন কর্মকর্তার টেবিলে টেবিলে ঘুরছিলেন তিনি কিন্তু লাইসেন্স পাননি। অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, প্রতিদিন প্রায় তিন থেকে সাড়ে তিন শতাধিক লাইসেন্সপ্রত্যাশী কেবল মিরপুর বিআরটিএর সার্কেল অফিসেই নবায়ন ও নতুন লাইসেন্সের জন্য তারিখের পর তারিখ ঘুরে যাচ্ছেন। লিখিত ও প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষাসহ আনুষঙ্গিক প্রক্রিয়া শেষে নতুন হালকা যানবাহন চালানোর লাইসেন্সের জন্য দুই বার তারিখ নিয়ে ফিরে যান মোহাম্মদপুরের মো. বিরু মাদিয়া। তাকে নতুন করে ২২ অক্টোবর তারিখ দেয়া হয়েছে। একইভাবে মোকলেসুর রহমানকে তিনবার মোটরসাইকেলের ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য ফিরে যেতে হয়েছে। সর্বশেষ ৯ জুলাই তারিখ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তাকে কোনো কিছু না বলেই ২২ অক্টোবর নতুন তারিখ দেয়া হয়েছে। জানা গেছে, গত ৯ জুলাই মিরপুরের বিআরটিএর সার্কেলে নতুন লাইসেন্সপ্রত্যাশী যারা গিয়েছিলেন তাদের সকলকে ২২ অক্টোবর সরবরাহের তারিখ দেয়া হয়েছে। তবে নির্ধারিত সময় বিপুল সংখ্যক ড্রাইভিং লাইসেন্স সরবরাহ করতে না পারার বিষয় জানতে চাইলে টাইগার আইটির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবিএম মহিউদ্দিন বলেন, এ দায় তাদের নয়, বিআরটিএর। কেননা ড্রাইভিং লাইসেন্সের চাহিদা বাড়ার পরেও বিআরটিএ তাদের সঙ্গে নতুন করে চুক্তি করেনি। তাই সাধারণ মানুষের ভোগান্তির দায় বিআরটিকেই নিতে হবে। তিনি বলেন, ২০১১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বিআরটিএর সঙ্গে টাইগার আইটির ১৫ লাখ লাইসেন্স সরবরাহের চুক্তি হয়েছে। তখন চাহিদাও নির্ধারণ করে বিআরটিএ। কিন্তু পুলিশের তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকার কারণে অনেকে হয়রানির শিকার হয়েছেন। এছাড়া পাঠাও, উবারসহ বিভিন্ন অ্যাপসের মাধ্যমে, মোটরসাইকেল, প্রাইভেট কার চালানো শুরু হওয়ায় ড্রাইভিং লাইসেন্সের চাহিদা বেড়ে গেছে। তাই যেখানে ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ লাখ ড্রাইবিং লাইসেন্স দেয়ার কথা সেখানে ২০১৬-১৭ সালের মধ্যে ১৪ লাখ ড্রাইভিং লাইন্সে দেয়া হয়ে গেছে। এর মধ্যে ২০১৬ সালের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ডিজিটাল ড্রাইভিং লাইসেন্স বিতরণ হয়েছে ১১ লাখ ৩০ হাজার। পেশাদার চালকদের ক্ষেত্রে পাঁচ বছর এবং অপেশাদার চালকদের ক্ষেত্রে ১০ বছর মেয়াদে লাইসেন্স ইসু্য ও নবায়ন করা হয়। বর্তমানে এক লাখ কার্ড আছে বিশেষ প্রয়োজনে ভিআইপিদের দেয়ার জন্য। উলেস্নখ্য, ড্রাইভিং লাইসেন্সের নকল ঠেকাতে ২০১১ সালের ১৫ নভেম্বর স্মার্ট কার্ড ড্রাইভিং লাইসেন্স চালু করে বিআরটিএ। রাজধানীতে বিআরটিএ তাদের মিরপুর ও ইকুরিয়া কার্যালয় থেকে ৫০টি বুথ তৈরি করে নতুন ধরনের এই ইলেকট্রনিক ড্রাইভিং লাইসেন্স বিতরণ শুরু করে। ফ্রান্সের ওবেথার টেকনোলজিস, ইভোলিস ও বাংলাদেশের টাইগার আইটি যৌথভাবে এই লাইসেন্স তৈরির কাজ করেছিল। ২০১১ সালের ৬ এপ্রিল বিআরটিএর সঙ্গে এসব প্রতিষ্ঠানের চুক্তি হয়। আগের ড্রাইভিং লাইসেন্সের প্রতিটি স্মার্ট কার্ডের দাম ছিল ৩২৮ টাকা। তবে টাইগার আইটির সাথে স্মার্ট কার্ড সরবরাহের জন্য গুনতে হচ্ছে ৪৯৯ টাকা। দেশের সব জেলায় ড্রাইভিং লাইসেন্সের ছবি তোলা গেলেও কার্ড প্রিন্ট হয় ঢাকায়। ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার ব্যাপারে হয়রানির বিষয় জানতে চাইলে বিআরটিএর চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মশিউর রহমান যায়যায়দিনকে বলেন, হিসেবে ভুলের কারণে একটু সমস্যা হচ্ছে। এছাড়া টাইগার আইটিও ঠিকভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করছে না। তবে ভিআইপি নয়, বিদেশগামী মানুষের ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার ব্যাপারে একটি বিশেষ ফর্ম পূরণ করে দিলেই দ্রম্নত লাইসেন্স সরবরাহ করার ব্যবস্থা রযেছে। এছাড়া সব সাধারণ মানুষ তাদের কাছে ভিআইপি। আলাদা করে কোনো ভিআইপি নেই বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, মানুষ সচেতন হচ্ছে। তাই ড্রাইভিং লাইসেন্সের চাহিদাও বাড়ছে। আর চাহিদার কথা বিবেচনা করেই এ মাসের ২৯ তারিখে নতুন লাইসেন্স প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান পাওয়ার জন্য দরপত্র জমার দিন ধার্য করা হয়েছে। \হ