এরশাদ শাসনের ভিত কাঁপিয়ে দেয় সেই চিত্রকর্ম

প্রকাশ | ১৫ জুলাই ২০১৯, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
সেই চিত্রকর্ম
পুলিশের গুলিতে ঢাকার রাজপথে নূর হোসেনের আত্মাহুতিতে এরশাদবিরোধী আন্দোলন হয়েছিল বেগবান, তারপর পেন্সিলে আঁকা একটি স্কেচ তাতে দিয়েছিল নতুন মাত্রা। বাংলাদেশের ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই করে নেয়া পটুয়া কামরুল হাসানের আঁকা 'দেশ আজ বিশ্ব বেহায়ার খপ্পরে' শিরোনামের সেই স্কেচটি তখন আন্দোলনকারীদের হৃদস্পন্দন বাড়িয়ে দিয়েছিল বিদু্যতের মতো। গত শতকের নব্বইয়ের দশকে গণআন্দোলনে ক্ষমতাচু্যত এইচ এম এরশাদের মৃতু্যর পর সাড়া জাগানো সেই চিত্রকর্মের কথা আসছে অনেকের স্মরণে। তিন যুগ আগে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এরশাদের পক্ষে-বিপক্ষে বিভক্ত ছিল দেশের কবিরাও। এরশাদের কবিতা কেন্দ্র ১৯৮৭ সালের ৩১ জানুয়ারি থেকে ২ ফেব্রম্নয়ারি পর্যন্ত এশীয় কবিতা উৎসবের আয়োজন করেছিল ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে। মূলত রাষ্ট্রপতি এরশাদের কবিতা কেন্দ্র ও এশীয় কবিতা উৎসবের আয়োজনকে প্রতিহত করতেই ওই সময় জন্ম হয় জাতীয় কবিতা পরিষদের। সে সময় দৈনিক বাংলা থেকে পদত্যাগ করে কবি শামসুর রাহমান যোগ দেন জাতীয় কবিতা পরিষদে, পাশাপাশি নেতৃত্ব দেন জাতীয় কবিতা উৎসবের। দিনটি ছিল ১৯৮৮ সালের ২ ফেব্রম্নয়ারি, সকাল ১০টা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সামনে জাতীয় কবিতা উৎসবের দ্বিতীয় আসর বসেছে। বিশাল প্যান্ডেল টানানো হয়েছে। রোদ ঝলমলে সেদিনের অনুষ্ঠানে শিল্পী পটুয়া কামরুল হাসান এসেছিলেন একটু সকালেই। কারণ উৎসবের সভাপতিত্ব করার দায়িত্ব পড়েছিল তার ওপর। কবি শামসুর রাহমান, ফয়েজ আহমেদ, সৈয়দ শামসুল হক, রফিক আজাদ, সাঈদ আহমেদ, সাইয়িদ আতিকুলস্নাহ থেকে শুরু করে দেশের নেতৃস্থানীয় কবিরা অংশ নেন কবিতা উৎসবে। দেশবরেণ্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ছিলেন সেই উৎসবে। সেদিন যারা সেখানে ছিলেন, তারা বলেন, অনুষ্ঠান চলার সময় মঞ্চে কবি রবীন্দ্র গোপের কবিতার ডায়েরিটি নিয়ে সবুজ পেন্সিল দিয়ে কিছু একটা আঁকছিলেন কামরুল হাসান। পেন্সিলের প্রতিটি টানে কী যেন এক আবিষ্কারের চিন্তায় মগ্ন তখন শিল্পী। পেন্সিলের শেষ টানটি শেষ হতেই দেখা গেল স্বৈরশাসক এরশাদের অবয়ব। কিছুক্ষণ পরই স্কেচটি উদ্ভাসিত হলো 'দেশ আজ বিশ্ববেহায়ার খপ্পরে' শিরোনামে। সেই স্কেচ পরদিন পোস্টার করে ছাপিয়ে সারাদেশে ছড়িয়ে দেন কবি মোহন রায়হান। স্কেচটি আঁকার পরপরই শিল্পী কামরুল হাসান হঠাৎ বুকে ব্যথা অনুভব করলে আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর গাড়িতে করে দ্রম্নত তাকে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসকরা জানান, শিল্পী কামরুল হাসান আর নেই। পটুয়ার পথ ধরে এরপর প্রয়াত হয়েছেন কবি শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হকসহ সেই আন্দোলনের অনেকেই। যারা আছেন তাদের কাছে এখনও তরতাজা সেদিনের স্মৃতি। কবি মোহন রায়হানের দৃষ্টিতে 'দেশ আজ বিশ্ব বেহায়ার খপ্পরে' শিল্পী কামরুল হাসানের এমন একটি সৃষ্টিকর্ম, যা তাদের আন্দোলনের গতি বাড়িয়ে দিয়েছিল। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় জাতীয় কবিতা পরিষদের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালনকারী মোহন রায়হান স্মৃতি হাতড়ে বলেন, "কবিতা উৎসবের অনুষ্ঠানে কামরুল হাসান ভাই মারা গেলেন। পরে আমরা শুনলাম, (সরকার) শিল্পীর লাশ নিয়ে যাবে। তখন আমরা তাড়াহুড়ো করে মেডিকেল কলেজ থেকে শিল্পীর মরদেহ আর্ট কলেজে নিয়ে আসলাম। হলে হলে খবর দিলাম। সেই সময়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ছিল, তাদেরও খবর দিলাম। সারারাত আমরা শিল্পীর মরদেহ পাহারা দিলাম যেন এরশাদ লাশ নিয়ে যেতে না পারে।" "ওই রাতে আমরা ক'জন এটি (স্কেচ) ছাপানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। পুরান ঢাকার আলু বাজারে হাজী ওসমান গনি রোডে আমার নিজের বিকল্প প্রিন্টিং প্রেস থেকে এটি ছাপানো হয়েছিল। প্রথমে ১০ হাজার কপি ছাপা হয়, ছড়িয়ে দেয়া হয় সারাদেশে। এরপর আরও ছাপানো হয়েছিল। অনেক কথা আছে, ইতিহাস আছে। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ওই স্কেচটি একটি মোমেন্টাম, এটি মুদ্রণ কর্মযজ্ঞের পেছনেও রয়েছে অনেক অজানা ইতিহাস।"