হিমশিম চিকিৎসকরা

ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে ডেঙ্গু পরিস্থিতি

চিকিৎসকরা জানান, এবার ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দুঃস্বপ্নের মতো। বিপুল সংখ্যক রোগী সামাল দিতে তাদের রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে

প্রকাশ | ১৭ জুলাই ২০১৯, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
রাজধানীতে ছড়িয়ে পড়েছে মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু। হাসপাতালগুলোতে বেড়েছে এ রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। ছবিটি মঙ্গলবার ঢাকা শিশু হাসপাতাল থেকে তোলা -ফোকাস বাংলা
যাযাদি রিপোর্ট ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে ডেঙ্গু। বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীদের উপচে পড়া ভিড় লক্ষ করা যাচ্ছে। এর মধ্যে গত মাসের (জুন) শুরুর দিকে রাজধানীর হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুরোগীর জন্য পৃথক ব্যবস্থা করা হয়। শিশু ওয়ার্ডের ভেতরেই আলাদা করে চিকিৎসার ব্যবস্থা হয়। তারা যেন অন্য রোগীদের সঙ্গে মিশে না যায় সে জন্য এই ব্যবস্থা। কিন্তু মাসের শেষ দিকে এই ব্যবস্থা আর ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। এত রোগী আসা শুরু হয় যে, ডেঙ্গু রোগীদের আর পৃথক করে চিকিৎসা দেয়া যাচ্ছিল না। আর এ চিত্র কেবল হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের নয়, রাজধানী ঢাকার প্রায় প্রতিটি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালেই একই চিত্র। এসব হাসপাতালের চিকিৎসকরা বলছেন, এবার ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দুঃস্বপ্নের মতো। বিপুল সংখ্যক রোগী সামাল দিতে তাদের রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন্স সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে জানা গেছে, ঢাকার সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে গত ২৪ ঘণ্টায় রোগী ভর্তি হয়েছেন ২১৪ জন। সরকারি হিসাবে এ পর্যন্ত তিনজনের মৃতু্যর কথা বলা হলেও প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি বলেও জানান চিকিৎসকরা। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক চিকিৎসক বলেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ। সরকারি হিসাব বলছে, চলতি বছরের শুরুতে জানুয়ারি মাসে ডেঙ্গু রোগী ছিল ৩৮, ফেব্রম্নয়ারিতে ১৮, মার্চে ১৭, এপ্রিলে ৫৮, মেতে ১৯৩, জুনে ১ হাজার ৭৫৯ এবং জুলাইতে দুই হাজার ৪৬৬ জন। বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আছেন ২২৬ জন, মিটফোর্ড হাসপাতালে ১২৬, শিশু হাসপাতালে ২৫, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ৯৬, হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালে ৫৮, বারডেম হাসপাতালে ১২, রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে ৩০ জন, মুগদা হাসপাতালে ৫০ জন, পিলখানার বিজিবি হাসপাতালে ১৯ জন। এই হিসাবে কেবল সরকারি হাসপাতালেই ভর্তি আছেন ৪১৩ রোগী। এদিকে, বেসরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বর্তমানে ভর্তি আছেন ৪৫, ইবনে সিনা হাসপাতালে ২২, স্কয়ার হাসপাতালে ৩৯, সেন্ট্রাল হাসপাতালে ৭৬, কাকরাইলের ইসলামী ব্যাংক সেন্ট্রাল হাসপাতালে ৫৯, ইউনাইটেড হাসপাতালে ৭, খিদমাহ হাসপাতালে ৯, অ্যাপোলো হাসপাতালে ৩০, ইউনিভার্সেল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ২৭, সালাউদ্দিন হাসপাতালে ৩৫, পপুলার হাসপাতালে ২০ জনসহ ঢাকার ৩৬টি হাসপাতালে মোট ৪১৩ জন রোগী ভর্তি আছেন। আর এসব হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র নিয়েছেন ২০৪২ জন বলে জানায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কন্ট্রোল রুম। জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) সানিয়া তহমিনা বলেন, 'এবারে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে। ঢাকা শহরের ৯৩ ওয়ার্ডে আমরা জরিপ চালিয়েছিলাম গত জানুয়ারিতে। তখনই এডিস মশার লার্ভা পেয়েছিলাম। এই লার্ভা থেকেই কিন্তু এডিস মশা জন্মাবে। আর সেটা উলেস্নখযোগ্যই ছিল।' তবে ডিএনসিসির চেয়ে ডিএসসিসিতে এডিস মশার লার্ভা বেশি পেয়েছিলেন বলেও তিনি জানান। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল, ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালসহ একাধিক হাসপাতালের বেশ কজন চিকিৎসক বলেন, 'চলতি বছরে ডেঙ্গুর ধরন বদলেছে। গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার প্রায় পাঁচ গুণ বেশি রোগী ভর্তি হয়েছেন হাসপাতালগুলোতে। আর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে গিয়ে এই হার কতটা বাড়বে, তা নিয়েও আতঙ্কিত তারা।' জানতে চাইলে ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. খান আবুল কালাম আজাদ বলেন, 'অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার ডেঙ্গু রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি। এটা হতে পারে হাসপাতালগুলো থেকে রিপোর্টিং ভালো হচ্ছে। মানুষ একদিনের জ্বর হলেও চিকিৎসকের কাছে আসছে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, এবার যারা দ্বিতীয়বারের মতো ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন, তারা বেশ বিপদে পড়ছেন। তাদের 'ইমিউন সিস্টেম' নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে। আর তখনই জটিলতা বাড়ছে। এ রকম অবস্থার জন্যও মানুষের বিপদ বেড়েছে।' অধ্যাপক ডা. খান আবুল কালাম আজাদ আরও বলেন, 'আমরা যদি সরকারি ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসা দিতে পারি, তাহলে মানুষকে ঠিক কাউন্সেলিং করে সঠিক চিকিৎসাটা দিতে পারব।' বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুলস্নাহ বলেন, 'ডেঙ্গুতে "সয়লাব" চারদিক। প্রতিদিন প্রচুর রোগী পাচ্ছি। এডিস মশা যদি নির্মূল না করা যায়, তাহলে এটা ঠেকানো যাবে না।' আর মশার বংশবৃদ্ধি বাড়ছেই মন্তব্য করে অধ্যাপক ডা. আব্দুলস্নাহ বলেন, 'মাঝে মাঝেই বৃষ্টি হচ্ছে। সেখানেই এডিস ডিম দিচ্ছে।' যে কারও জ্বর হলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের কাছে যেতে অনুরোধ করে তিনি বলেন, 'বর্তমানে যেহেতু ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি, তাই যে কারণেই জ্বর হলে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে, পরামর্শ নিতে হবে। কারণ, ডেঙ্গু যখন "সিরিয়াস" হয়ে যায় তখন তাকে বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়ে'। তাই জ্বর হলেই অবহেলা না করে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার পরামর্শও দেন তিনি। ডেঙ্গু নিয়ে ঘাবড়াবেন \হনা: মেয়র খোকন এদিকে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীদের দেখতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পরিদর্শন করলেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র সাঈদ খোকন। হাসপাতালের কয়েকটি ওয়ার্ড ঘুরে রোগীদের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। মঙ্গলবার বিকালে মেয়র ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান। পরিদর্শন শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, 'দেশের অনেক জায়গা থেকেই এখানে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে। তাদের খুব ভালোভাবে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। বেশির ভাগ ডেঙ্গু রোগী ৭-১০ দিনের মধ্যে সুস্থ হয়ে যায়। সুতরাং, নগরবাসী ঘাবড়ে যাবেন না, ভয় পাবেন না, মনোবল হারাবেন না, আতঙ্কিত হবেন না।' তিনি বলেন, 'এই সমস্যা থেকে অচিরেই আমরা বেরিয়ে আসব। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি সব দপ্তর সম্মিলিতভাবে ডেঙ্গু প্রতিরোধে মাঠে আছে। আমাদের ভ্রাম্যমাণ মেডিকেল টিম মাঠে রয়েছে। দু-চার দিনের মধ্যে পরিচ্ছন্নতার জন্য টিম গঠন করে দেব যারা প্রতিটি বাসায় গিয়ে ডেঙ্গুর প্রজননক্ষেত্র ধ্বংস করে দিয়ে আসবে। আমাদের সব উদ্যোগ সচল রয়েছে। ডেঙ্গু প্রতিরোধে সবাইকে সচেতন হতে হবে। তাহলে আমরা ডেঙ্গু প্রতিরোধে সক্ষম হব।' পার্শ্ববর্তী দেশের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, 'ভারতের দিলিস্ন, মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর, থাইল্যান্ড, এমনকি আমেরিকায়ও হাজার হাজার মানুষ ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বৈশ্বিক সমস্যা, জলবায়ু পরিবর্তন একটা অন্যতম কারণ এই ডেঙ্গু বিস্তারের জন্য। তবে আমরা বসে নেই।' মেয়র বলেন, ডেঙ্গু মশা ময়লা-আবর্জনার মধ্যে সৃষ্টি হয় না। এটি পরিষ্কার পানিতে বাসাবাড়ির ভেতরে প্রজনন করে। কাজেই বাসাবাড়ির ভেতর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখুন। এক প্রশ্নের জবাবে মেয়র বলেন, 'ফেব্রম্নয়ারি মাস থেকেই ডেঙ্গু মশা নিধনে আমাদের কর্মসূচি চলে আসছে এবং প্রতিদিন চলছে। আমরা আশা করি এটি আর ছড়াবে না।' তিনি বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান, ইমাম, পুরোহিত, অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীর সমন্বয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে কমিউনিটি অ্যাম্বাসেডর নিয়োগ করেছে। প্রতিটি ওয়ার্ডে ২৮ জন করে প্রতিনিধি আছেন, যাদের স্বাক্ষরিত প্রতিবেদন আমার কাছে জমা দেয়া হয়। কাজেই কারও ফাঁকি দেয়ার সুযোগ নেই। এ সময় মেয়র সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিনসহ চিকিৎসকরা।