এমপিও: শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে এমপিদের মনকষাকষি

প্রকাশ | ১৭ জুলাই ২০১৯, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
নূর মোহাম্মদ রাজনৈতিক বা বিশেষ বিবেচনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিও পেতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন সংসদ সদস্যরা। দুর্গম, চরাঞ্চল, কিংবা নারী শিক্ষায় বিশেষ অবদান রাখেনি এমন প্রতিষ্ঠানকে 'বিশেষ বিবেচনায়' এমপিও দিতে আধা সরকারি পত্র (ডিও লেটার) দিচ্ছেন এমপিরা। অন্যদিকে এমপিওভুক্তিতে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে যোগ্য প্রতিষ্ঠানকেই এমপিও দিতে চান শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। এ নিয়ে এমপিদের সঙ্গে অনেকটা মনকষাকষি শুরু হয়েছে। গত কয়েক দিন এমপিদের সাক্ষাৎ দেয়া কমিয়ে দিয়েছেন তিনি। সংশ্লিষ্ট শাখা সূত্রে জানা গেছে, বিশেষ বিবেচনায় এমপিও পেতে যেসব সংসদ সদস্য ডিও লেটার দিয়েছেন তার একটি তালিকা চূড়ান্ত করেছে এ সংক্রান্ত কমিটি। সেই তালিকা যাচাই-বাছাই এবং চূড়ান্ত করতে গত সোমবার বিকাল ৫টায় মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অনেকটা গোপনে বৈঠক করেন শিক্ষামন্ত্রী। এ বৈঠক নিয়ে মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে কোথাও কোনো নোটিশ করা হয়নি। তদবির বা এমপিদের চাপ কমাতেই এমন গোপনীয়তা হয়েছে বলে জানা গেছে। এ ব্যাপারে শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যের জন্য তার দপ্তরে একাধিকার সাক্ষাৎ চেয়েও পাওয়া যায়নি। মোবাইল ফোনে ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। তবে বৈঠকের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব জাবেদ আহমেদ। তিনি তার দপ্তরে যায়যায়দিনকে পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন, 'এই বৈঠকের ব্যাপারে কোনো নোটিশ করা হয়নি। আপনি জানলেন কেমনে?' 'এমপিও বাছাই কমিটি'র প্রধান পরে তিনি বৈঠকের কথা স্বীকার করে বলেন, সোমবার মন্ত্রীর সঙ্গে একটি বৈঠক হয়েছে। সেখানে এমপিও-সংক্রান্ত কাজের অগ্রগতি উপস্থাপন করা হয়েছে। রাজনৈতিক বা বিশেষ বিবেচনায় কত প্রতিষ্ঠানের তালিকা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি মন্ত্রী মহোদয় ভালো বলতে পারবেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা গেছে, কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগের তালিকা নিয়ে জটলা তৈরি হয়েছে। এ বিভাগের কর্মকর্তা চান, এমপিও দেয়ার ক্ষেত্রে যোগ্যতা চেয়ে বিশেষ বিবেচনাকে প্রাধান্য দেয়া হোক। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, কারিগরি ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত দুর্গম এলাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়। কর্মকর্তারা বলছেন, নির্ধারিত শর্ত পূরণ করতে পারেনি তারপরও শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায় এমপিও পেতে দেশের বিভিন্ন এলাকার ক্ষমতাসীন দলীয় সাংসদরা আধা সরকারি পত্র (ডিও) দিয়েছেন। এমপিও দেয়ার ক্ষেত্রে চরাঞ্চল, দুর্গত, নারী শিক্ষাসহ আরও কয়েকটি ক্যাটাগরি বিশেষ বিবেচনায় প্রাধান্য দেয়া হবে- শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এমন সিদ্ধান্তের পরই এসব ডিও লেটার আসা শুরু হয়। ইতোমধ্যে দেড় শতাধিক এমপি প্রায় তিন শতাধিক প্রতিষ্ঠানকে বিশেষ বিবেচনায় এমপিও দেয়ার জন্য অনুরোধ করেছেন। ডিও লেটারে এমপিরা এসব প্রতিষ্ঠানের নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার কথা উলেস্নখ করেছেন। এসব প্রতিবন্ধতা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার কারণে এমপিওভুক্তির নির্ধারিত শর্ত পূরণ করতে পারেনি। সেজন্য এসব প্রতিষ্ঠানকে বিশেষ বিবেচনায় এমপিও দেয়ার প্রয়োজন বলেও মনে করেন আইন প্রণেতারা। এসব প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হলে স্ব স্ব অবস্থান থেকে শিক্ষার আলো আরও দ্রম্নত ছড়াতে পারবে বলে উলেস্নখ করেছেন তারা। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সর্বশেষ ২০১০ সালের এমপিও দিতে গিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতির শিকার হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এমপিও নিয়ে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ও প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা উপদেষ্টা ড. আলাউদ্দিনের মধ্যে চরম দ্বন্দ্ব বেধে যায়। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই এবার এমপিওভুক্তিতে স্বচ্ছতার জন্য নতুন পদ্ধতি চালু করা হয়। নতুন নিয়ম অনুযায়ী এমপিও পেতে ইচ্ছুক প্রতিষ্ঠানগুলো অনলাইনে নির্দিষ্ট ফরমে আবেদন করে তার সব তথ্য জমা দিয়েছে। আবেদনের যোগ্যতা হিসেবে ১০০ নম্বর নির্ধারণ করা হয়। সেখানে প্রতিষ্ঠানের বয়স, শিক্ষক-শিক্ষার্থী সংক্রান্ত তথ্য, পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ও পাসের হার, অবকাঠামো ইত্যাদি বিবেচনায় নম্বর দেয়া হয়। সারা দেশের সাড়ে ৭ হাজার প্রতিষ্ঠান এমপিওর জন্য আবেদন করে। সেখান থেকে মাত্র দুই হাজার তিন শ প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত যোগ্যতা অর্জন করে। এর মধ্যে স্কুল-কলেজ প্রায় ১২শ', মাদ্রাসা ৫শ' এবং সাড়ে ৩শ' কারিগরি প্রতিষ্ঠান। নির্ধারিত শর্ত পূরণ করে ফিটলিস্টে জায়গা পায়নি এমন উপজেলাও রয়েছে। আবার একই উপজেলা থেকে ১০টির বেশি প্রতিষ্ঠান ফিটলিস্টে জায়গা পেয়েছে। এগুলো যাচাই-বাছাই করার পর এমপিওতে এলাকাভিত্তিক বৈষম্য কমাতে 'বিশেষ বিবেচনা'য় এমপিও দেয়ার কথা ভাবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এরই প্রেক্ষিতে দুর্গম, চরাঞ্চল, পিছিয়ে পড়া ও নারী শিক্ষায় বিশেষ অবদান রাখছে এমন ক্যাটাগরির প্রতিষ্ঠানকে এমপিও পেতে স্থানীয় সংসদ সদস্যের ডিও লেটার চাওয়া হয়। এরপর ডিও লেটারের হিড়িক পড়েছে মন্ত্রণালয়ে। যা নিয়ে অনেকটা বিব্রত অবস্থায় পড়েছেন মন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টরা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে আরও জানা গেছে, সরকারি দলের মন্ত্রী-এমপিদের প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তি থেকে বাদ পড়লে অসন্তোষের শঙ্কা থেকে এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে উল্টোটা। ফিটলিস্টে ৫-৭টি প্রতিষ্ঠান থাকার পরও বিশেষ বিচেনায় আরও প্রতিষ্ঠান চেয়ে ডিও লেটার দিয়েছেন তারা। তবে এমপিওভুক্তির তালিকা তৈরির সঙ্গে জড়িত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'সফটওয়্যারের মাধ্যমে অমোটেশন পদ্ধতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তালিকা করা হয়েছে। তবে পিছিয়ে পরা হাওড়, পাহাড় ও চরাঞ্চলের বিশেষ কিছু প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হবে। নারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও অগ্রাধিকার পাবে। সেটি খুবই কম। সেজন্য এত ডিও লেটার জমা পড়বে ভাবতে পারেনি। মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বর্তমানে ২৬ হাজার ১৮০টি প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত আছে। এর মধ্যে স্কুল ১৬ হাজার ১৯৭টি, কলেজ দুই হাজার ৩৬৫টি, মাদ্রাসা সাত হাজার ৬১৮টি। এ খাতে সরকারের ব্যয় বরাদ্দ আছে বছরে ১৪ হাজার ১৮২ কোটি টাকা। এ ব্যয় বর্তমানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বাজেটের ৬৩ শতাংশের বেশি। আবেদনকৃত প্রতিষ্ঠানকে এমপিও দিলে বছরে অন্তত আরও তিন হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন। আগামী অর্থ বছরের বাজেটে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তি ও সরকারিকৃত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা ব্যয় মেটাতে অতিরিক্ত চার হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সম্প্রতি এ বিষয়ে অর্থসচিবকে একটি আধা সরকারি পত্র দিয়েছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব। তার আগে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (বেসরকারি মাধ্যমিক) জাবেদ আহমেদের নেতৃত্বে গঠন করা হয় নয় সদস্যের 'প্রতিষ্ঠান বাছাই কমিটি'। কমিটির অপর সদস্যরা হলেন বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান বু্যরোর (ব্যানবেইস) মহাপরিচালক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের যুগ্ম সচিব (বেসরকারি মাধ্যমিক), যুগ্ম সচিব (আইন), মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (মাধ্যমিক), পরিচালক (কলেজ), মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের উপসচিব (কলেজ), জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব (বাজেট)। কমিটির সদস্যসচিব করা হয় যুগ্ম সচিবকে (বেসরকারি মাধ্যমিক-৩)। অন্যদিকে অনলাইনে আবেদন গ্রহণের জন্য ব্যানবেইসের মহাপরিচালক মো. ফসিউলস্নাহর নেতৃত্বে গঠন করা হয় আট সদস্যের কারিগরি কমিটি। এই কমিটিতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিসহ শিক্ষা মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তরের জ্যেষ্ঠ সিস্টেম অ্যানালিস্ট, প্রোগ্রামারসহ বিশেষজ্ঞদের কমিটির সদস্য করা হয়। গত বছরের ৫ থেকে ২০ আগস্ট পর্যন্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তৈরি করা ওয়েবসাইটের মাধ্যমে আবেদন নেয়া হয়। এই কমিটি সফটওয়্যারের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রস্তুত করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরে গ্রেডেশন তালিকা 'প্রতিষ্ঠান বাছাই কমিটির' কাছে উপস্থাপন করেছে।