ঢাকার ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে এলোমেলো ছক

প্রকাশ | ১৭ জুলাই ২০১৯, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
কর্মদিবসে রাজধানীতে যানজটের এ চিত্র নিত্যদিনের -ফাইল ছবি
সাখাওয়াত হোসেন ঢাকঢোল পিটিয়ে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ঢাকা মহানগরীর গুরুত্বপূর্ণ তিনটি সড়কে রিকশা বন্ধের ঘোষণা দিলেও এর প্রতিবাদে রিকশা মালিক-শ্রমিকদের বিক্ষোভ-আন্দোলনের পর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অনেকটা নীরবে পিছু হটেছে। ফলে এসব সড়কে রিকশা-ভ্যান আগের মতোই নির্বিঘ্নে চলাচল করছে। অথচ রিকশা চালকদের সড়ক অবরোধসহ অন্যান্য আন্দোলন কর্মসূচির কারণে গত ৮ ও ৯ জুলাই টানা দুইদিন নগরীবাসীকে অবর্ণনীয় ভোগান্তি পোহাতে হয়। ভয়াবহ যানজটে এ সময় গোটা মহানগরীর ট্রাফিক ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। পরিবহন সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, শুধু এ ঘটনাই নয়, ঢাকা মহানগর ট্রাফিক পুলিশ, ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন অথরিটি (ডিটিসিএ), বিআরটিএ, বিআরটিসি এবং ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অপরিকল্পিত নানা ছকে রাজধানীর ট্রাফিক ব্যবস্থা অনেকটা লন্ডভন্ড হয়ে পড়েছে। অথচ এরপরও সংশ্লিষ্ট প্রশাসন একের পর এক এলোমেলো পরিকল্পনা গ্রহণ করে চলেছে। রাজধানীতে অবৈধ যান চলাচল নিয়ন্ত্রণে গত ১৯ জুন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকনকে প্রধান সমন্বয়ক করে একটি কমিটি গঠন করে ডিটিসিএ। দুই মাসের মধ্যে এই কমিটি রিকশা, অটোরিকশা ও পার্শ্ববর্তী জেলা থেকে ঢাকায় প্রবেশকারী অবৈধ যানবাহন নিয়ন্ত্রণে কাজ করবে বলে বোর্ড সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। পাশাপাশি রাজধানীতে ট্রাফিক সিস্টেম কার্যকর অটোমেশন সুবিধা চালুর ব্যাপারে ঢাকা মহানগর পুলিশকে নির্দেশনা দেন সেতুমন্ত্রী। তবে ডিটিসি-এর বোর্ড সভায় গৃহীত এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ মাঠে নামা দূরে থাক, কোন কৌশলে তারা এ পথে এগোবে তা-ও এখনো নির্ধারণ করতে পারেনি। সেতুমন্ত্রীর নির্দেশনার পর প্রায় একমাস হতে চললেও ট্রাফিক সিস্টেম কার্যকর অটোমেশন সুবিধা চালুর ব্যাপারে ডিএমপি এখনো কোনো উলেস্নখযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনি। বরং অবৈধ যান নিয়ন্ত্রণে ডিটিসিএ'র সিদ্ধান্তকে পুঁজি করে ট্রাফিক পুলিশের একশ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা তাদের চাঁদাবাজির রেট বাড়িয়েছে। বাইরের জেলার মেয়াদোত্তীর্ণ অটোরিকশা পাড়া-মহলস্নার বিভিন্ন রুটে অবাধে চলাচলের সুযোগ করে দিয়ে থানা পুলিশও সে পালস্নায় যোগ দিয়েছে। এদিকে মেট্রোরেলের নির্মাণ কাজের জন্য সংকুচিত হয়ে পড়া ফার্মগেট থেকে শাহবাগের সড়কে তীব্র যানজট নিরসনে গত ২৭ ফেব্রম্নয়ারি বেশকিছু উদ্যোগ নেয় ডিটিসিএ। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সঙ্গে সমন্বয় করে ফার্মগেট থেকে তেজতুরি পাড়া হয়ে সাত রাস্তা পর্যন্ত ট্রাফিক ডাইভারসন চালু, ওই রাস্তার বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতা দূর, বাংলামোটর থেকে বসুন্ধরা সিটি শপিংমলের সামনে দিয়ে গ্রিন রোড হয়ে ফার্মগেটের আনন্দ সিনেমা হল পর্যন্ত ট্রাফিক ডাইভারসন চালুর ব্যাপারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়। এছাড়া প্রয়োজনমাফিক ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ, প্রকল্প এলাকার কারওয়ানবাজারের আন্ডারপাসের বিকল্প ব্যবস্থা বিবেচনা করা, ফুটপাত ভেঙে রাস্তা আট মিটার চওড়া করা যায় কিনা, তা পরীক্ষা-নিরীক্ষাসহ ব্যবস্থা গ্রহণ, ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট পস্ন্যান চূড়ান্ত করা, যানজট নিয়ন্ত্রণে আইনি এনফোর্সমেন্ট কার্যক্রম জোরদার করারও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। অথচ এরই মধ্যে সাড়ে ৪ মাস পেরিয়ে গেলেও এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ উলেস্নখযোগ্য কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। এর আগে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের নৈরাজ্য থেকে নগরবাসীকে মুক্ত করে গণপরিবহন খাতে সুষ্ঠু পরিবেশ ও ট্রাফিক ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে ঢাকায় দুই বছরের মধ্যে পর্যায়ক্রমে ৪ হাজার নতুন বাস নামানোর ঘোষণা দিয়েছিল ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি)। পাশাপাশি ৫ বছরের বেশি পুরান সব বাস নগরীর রাস্তা থেকে তুলে দেয়ারও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। তবে এ পরিকল্পনা গ্রহণের পর দুই বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও নতুন বাস নামানোর ব্যাপারে এখনো কোনো উলেস্নখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। পাইলট প্রকল্পের আওতায় সামান্য কিছু বাস নামলেও তা নগরযাত্রায় সামান্য সুফল বয়ে আনতে পারেনি।  অথচ ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ডিএনসিসি ব্যর্থ হলেও গণপরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার নতুন ছকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এসব বিষয়ে কোনো গুরুত্ব দেয়নি। বরং একই স্রোতে গা ভাসিয়ে গত বছরের ২২ অক্টোবর ঢাকায় নতুন করে সাড়ে চার হাজার বাস নামানোর উদ্যোগ নেয়ার ঘোষণা দেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র সাঈদ খোকন। রাজধানীর সড়কে চার-পাঁচটি কোম্পানির মাধ্যমে এ বাসগুলো নামানো হবে বলে জানান তিনি। পাশাপাশি দুই বছরের মধ্যে ঢাকাসহ আশপাশের সড়ক-মহাসড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রম্নতিও দেন। যদিও এর পর ৯ মাস পেরুলেও এ উদ্যোগ বাস্তবায়নে ডিএসসিসি উলেস্নখযোগ্য কোনো ভূমিকা রাখতে সমর্থ হয়নি। এদিকে নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর রাজধানীর ট্রাফিক ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফেরাতে গত বছরের ১৬ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গভর্ন্যান্স ইনোভেশন ইউনিট যে ১৮টি নির্দেশনা দিয়েছিল তার অধিকাংশ পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন। বিশেষ করে পরিবহন ব্যবস্থাপনা, সড়ক ব্যবস্থাপনা, পরিবহনের ফিটনেস ও লাইসেন্স ব্যবস্থা উন্নয়নে এসব নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল, এসবের সামান্যও বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, রাজধানীতে ১২১টি বাস স্টপেজ থাকলেও বন্ধ হয়নি যত্রতত্র যাত্রী ওঠা-নামা। একইভাবে চলন্ত বাসের দরজা বন্ধ রাখার যে নির্দেশনা ছিল, তাও মানছে না কেউ। ফুটওভার ব্রিজ বা আন্ডারপাসের ১০০ মিটারের মধ্যে ঝুঁকি নিয়ে পারাপার হচ্ছেন পথচারী। সড়ক বিভাজক ফাঁক-ফোকরে ভরা। হকারমুক্ত হয়নি ফুটপাত। আছে অবৈধ পার্কিং। স্বয়ংক্রিয় বৈদু্যতিক সিগনাল চালু হলেও এখনো যানবাহন নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে ট্রাফিক পুলিশের হাতের ইশারায়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনায় ঢাকার আন্ডারপাসগুলোয় বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির কথা বলা হলেও বাস্তবে সে রকম কিছু চোখে পড়েনি। গত ২০০৯-২০১০ সালে ভিআইপি সড়ক, মিরপুর রোড, প্রগতি সরণিসহ কয়েকটি বড় রাস্তায় দাগ কেটে তিনটি, কোথাও চারটি লেন করা হয়। ট্রাফিক পুলিশ শহরের বিভিন্ন স্থানে গাড়িগুলোকে নিজস্ব লেনে চালানোর চেষ্টা করে। তবে কিছুদিন পরেই স্তিমিত হয়ে যায় সেই উদ্যোগ। সড়কে শুরু হয় বিশৃঙ্খলা। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. মিজানুর রহমান বলেন, ফুটপাত হকারমুক্ত করতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যেমন একটা ভূমিকা আছে, তেমনি এখানে রাজনৈতিক সদিচ্ছাও জরুরি। অন্যদিকে ডিএমপি বলছে, সড়কে শৃঙ্খলা আনার কাজে সবচেয়ে বেশি দরকার সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে সমন্বয়। অথচ সিটি করপোরেশন, বিআরটিএ, বিআরটিসি, রাজউক, ডিটিসিএ-সহ অন্যান্য সংস্থার কার্যক্রমের মধ্যে কখনই যথাযথ সমন্বয় হয়নি। ঢাকা মহানগর ট্রাফিক পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মফিজ উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, 'গাড়ি বেহিসাবে বাড়ছে। ফলে সব ধরনের পদক্ষেপ ব্যর্থ হচ্ছে। ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হলে সবার আগে নগরীতে বেহিসাবে গাড়ি চলাচলের সুযোগ বন্ধ করতে হবে।'